বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান

স্টাফ রির্পোটার : লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (হে আল্লাহ হাজির তোমার দরবারে) ধ্বনিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২০ লক্ষাধিক মুসলমান নিজেদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে গতকাল বৃহস্পতিবার পবিত্র হজ্ব পালন করেছেন। ইহ্রামের দু’টুকরো সাদা কাপড় পরিধান করে আরাফার ময়দানে হাজিরা আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেছেন। জীবনের সকল অপরাধের কথা স্মরণ করে আল্লাহর রহমত কামনা করেন। তারা বিশ্বের শান্তি সমৃদ্ধি কামনা করে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। খুতবায় ফিলিস্তিনসহ গোটা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানানো হয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার আরাফার ময়দানে বিশ্বের লাখ লাখ আল্লাহ প্রেমিকের এক মহাসম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সম্মিলনে চলমান বিশ্বের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মসজিদে নামিরায় খুতবা প্রদান করেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য, বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের রাজকীয় উপদেষ্টা শায়খ ড. সাআদ বিন নাসের আশ শিতরি। স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ৩টা ২৫) খুতবা শুরু হয়। চলে প্রায় ২৫ মিনিট। এ সময় সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি শেখ আব্দুল আজিজ বিন আব্দুল্লাহ আল শায়খও উপস্থিত ছিলেন। তিনি সবাইকে সতর্ক করে বলেন, সূর্যাস্তের আগে যেন কেউ আরাফা ময়দান ত্যাগ না করে। যদি কেউ সূর্যাস্তের আগে আরাফা ময়দান ত্যাগ করে তাহলে তার হজ্ব হবে না বলেও তিনি হুশিয়ার করে দেন।

দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর হজের খুতবা দিয়ে আসছিলেন শায়খ আব্দুল আজিজ। গতবার তার স্থলে প্রথমবারের মতো খুতবা দেন মসজিদে হারামের অন্যতম ইমাম ড. আবদুর রহমান আস সুদাইস। আরাফার ময়দানে মসজিদে নামিরায় খুতবা দিয়ে থাকেন হজের খতিব। এই খুতবায় মুসলিম উম্মাহর জন্য থাকে নানা দিক নির্দেশনা।

পবিত্র হজের খুতবায় খতিব শায়খ ড. সাআদ বিন আন নসর আশ শিতরি বলেছেন, আল্লাহ সব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ করেছেন। প্রত্যেকের নিরাপত্তা বিধান করা ইসলামের নির্দেশ। অশান্তি সৃষ্টি করা যাবে না, অশান্তিমূলক কোনো কাজ করা যাবে না, এটা ইসলামে নিষিদ্ধ।

হজের খুতবায় খতিব তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে বলেন। তিনি বলেন, যারা আল্লাহর পথ ধরবেন আল্লাহ তাদেরকে শান্তিতে রাখবেন।

আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, আখেরাত এসবের প্রতি ঈমান সুদৃঢ় করার প্রতি তাগিদ দেন খতিব। মুসলিম উম্মাহকে ঐকবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দেন, বিচ্ছিন্ন না হতে বলেন।

খতিব বলেন, ‘শরিয়তের সৌন্দর্য হলো মানুষের প্রতি অনুগ্রহ ও জীবনের সবক্ষেত্রে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা।’ তিনি বলেন, ‘যারা ইমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে, তাদেরকে আল্লাহ সাহায্য করবেন। ভয় ভীতি দূর করে দেবেন।’

খতিব মুসলিমদেরকে আল্লাহর নির্ধারিত গ-ি না পেরোনোর তাগিদ দেন। কোনো চুক্তি করলে তা রক্ষা করার কথা বলেন।

হজের খতিব মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় এই সম্মেলনে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান কামনা করেন। ফিলিস্তিনে যেন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পবিত্র মসজিদে আকসা যেন আবার মুসলমানদের অধিকারে আসে সেই প্রত্যাশার কথা জানান।

শায়খ ড. সাআদ বিন আন নসর আশ শিতরি বলেন, ‘মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আল্লাহ কৃত্রিম ভেদাভেদ না করতে বলেছেন। তিনি পবিত্র হজের সময় হারাম শরিফে এসে কোনো অনাকাঙ্খিত কর্মকা- না করতে আহ্বান জানান। এখানে এসে দলাদলি না করার ব্যাপারে সাবধান করেন।

খতিব বলেন, আল্লাহর রাসুল সা. আমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে গেছেন, সেই দুটি জিনিস হলো কোরআনে কারিম ও আল্লাহর রাসুলের সুন্নত। প্রতিটি মুসলমানের উচিত এই দুটি জিনিসকে আঁকড়ে ধরা।

তিনি বলেন, কোরআন জীবনের সব ক্ষেত্রের জন্য। এজন্য কোরআনকে আঁকড়ে ধরতে হবে। কোরআন পড়তে হবে, সেই অনুযায়ী চলতে হবে। পরিশেষে খতিব সৌদি বাদশা, হারামাইনের যার খেদমত করছেন এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করেন।

খুতবায় তিনি কুরআন হাদিসের মূলনীতির ভিত্তিতে বিশ্বমুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি পরস্পর ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে শান্তিময় অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

আজ থেকে ১৪শ ২৮ বছর আগে এই দিনে রাসূল (সা.) আরাফার ময়দানে সমবেত লাখো জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি ইসলামের পরিপূর্ণতা ঘোষণা করাসহ জীবন পরিচালনার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেন। 

এবারের খুতবায় ইসলামের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা তুলে ধরে বিশ্বমুসলিমের শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণ কামনা করা হয়। এছাড়া পবিত্র কুরআন হাদিসের উদ্বৃতি দিয়ে ইসলামের বিভিন্ন বিধি বিধান এবং পরকালের পুরস্কার ও শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।

আরাফার ময়দান থেকে বিভিন্ন বার্তা সংস্থা জানায়, পবিত্র হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে বুধবার ফজরের পর থেকেই মক্কার অদূরে মিনা নগরী অভিমুখে লাখো মানুষের ঢল নামে। বেশিরভাগ লোক গাড়িযোগে, আবার কেউ কেউ ৩/৪ ঘণ্টা পায়ে হেঁটে মিনায় পৌঁছান। শ্বেতশুভ্র লাখো তাঁবুতে ঢাকা পড়েছে মিনা নগরী। চারপাশে মহানবীর ম্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নগরীর জাবালে নূর, জাবালে রহমতসহ বিভিন্ন পাহাড়। এ পাহাড়ের একটির নাম হেরা। এই হেরা গুহায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত লাভ করেছিলেন। আরাফার ময়দানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মসজিদ ‘মসজিদে নামিরাহ' থেকে হাজিদের উদ্দেশ্যে প্রতি বছরের মতো খুতবা দেয়া হয়েছে।

খুতবা ও মুনাজাত শেষে সমবেত হাজিরা গতকাল বৃহস্পতিবার যোহর ও আসরের নামায একত্রে আদায় করে সূর্যাস্তের পর মুজদালিফার উদ্দেশ্যে আরাফার ময়দান ত্যাগ করেছেন। হাজিরা বালু ও কংকরময় মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করে মাগরিব ও ইশার নামায আদায় করেন ইশার ওয়াক্তে। এছাড়া পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আযকার ও ইবাদাত বন্দেগির মাধ্যমে রাত্রি যাপন করেন। এখান থেকে তারা ৪৯টি (১৩ জিলহজ্ব পর্যন্ত পাথর মারলে ৭০টি) ছোট আকারের পাথর সংগ্রহ করে আজ শুক্রবার সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই মুজদালিফা থেকে পুনরায় মিনায় ফিরে গিয়ে অদূরে নির্মিত শয়তানের তিনটি প্রতিকৃতির বড় একটি প্রতিকৃতি তথা বড় জামরায় পাথর ছুঁড়ে মারবেন। তারপর কুরবানি করে মাথামু-নের মাধ্যমে পবিত্র হবেন। ইহ্রামের কাপড় ত্যাগ করে সাধারণ পোশাক পরিধান করে হাজিরা মক্কায় ফিরে গিয়ে পবিত্র কা’বা শরিফ তাওয়াফ করবেন। যারা আজ তাওয়াফ করতে পারবেন না তারা কাল বা পরশু তথা ১৩ জিলহজ্ব পর্যন্ত তাওয়াফ করতে পারবেন।

সৌদি গেজেট জানায়, পবিত্র হজের দিনে হাজিদের নির্বিঘেœ হজব্রত পালনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সৌদি সরকার। ইতোমধ্যে হজ মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তা, সিভিল ডিফেন্স কর্মী, নিরাপত্তা কর্মী, ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক এবং মিডিয়া কর্মীদের নিয়োগ দেয়াসহ অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারে করে বিশেষজ্ঞ নিরাপত্তা কর্মীরা আকাশে টহল দিচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কতৃপক্ষ। মাঠে রয়েছে ৩ লাখ আর্মি, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও স্কাউট সদস্যরা। অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রস্তুত রয়েছে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সংবলিত সিভিল ডিফেন্সের গাড়ি ও হেলিকপ্টার।

হাজিদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতে স্থায়ী হাসপাতাল ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র ও এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। আহত হাজিদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে এবং নিহত হাজিদের লাশ স্বযতেœ রাখা হচ্ছে। হাজিদের সুবিধা-অসুবিধা দেখাশোনার জন্য রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কয়েক হাজার কর্মকর্তা।

সৌদি গেজেট থেকে আরো জানা গেছে, নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দে যাতে হাজিগন আরাফা ময়দানে অবস্থান করতে পারেন এ বিষয়টি সার্বক্ষনিক পর্যবেক্ষন করেছেন সুপ্রীম হজ কমিটির চেয়ারম্যান প্রিন্স আব্দুল আজিজ বিন সৌদি বিন নায়েফ এবং মক্কার আমির প্রিন্স খালেদ আল ফয়সাল। 

এদিকে হজ্ব সিকিউরিটি ফোর্সের সহকারী কমান্ডার মেজর জেনারেল খালেদ আল দাবিব জানান, গতকাল আরাফায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রী সেলসিয়াস ও মিনা এবং মুজদালিফায় ৩৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস।

উল্লেখ্য, এ বছর বাংলাদেশ থেকে সরকারি, বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হজ্বযাত্রী ও ব্যবস্থাপনার সদস্যসহ সর্বমোট ১ লাখ ২৭ হাজার ২২৯ জন পবিত্র হজ পালন করছেন। তাদের জন্য ৩৭০টি ফ্লাইট পরিচালিত হয়েছে। তারমধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পরিচালিত ১৯১টি ও সৌদী এয়ারলাইন্স পরিচালিত ১৭৯ টি। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ফিরতি হজ্বফ্লাইট শুরু হবে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাংলাদেশী ৪৫ জন হাজি ইন্তিকাল করেছেন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৪১ জন এবং মহিলা ৪ জন। মক্কায় ৩৮ জন; মদিনায় ৭ জন ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ