শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

চামড়া কেনা বেচায় সরকার নির্ধারিত দাম উপেক্ষিত

ইবরাহীম খলিল : এবারের কুরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনা নিয়ে সারাদেশে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও সরকারি দাম মেনে চামড়া ক্রয় বিক্রয় হয়নি। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ে একই অবস্থা। যে যার মত করে চামড়া কেনা বেচা করেছে। সরকার নির্ধারিত রেটের বালাই নেই। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বেশি দামে কুরবানির পশু কেনা হলেও চামড়ার দাম নিয়ে হতাশ সবাই। তারা বলছেন যে, চামড়া নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা মানে গরিবের পেটে লাথি মারা। কারণ চামড়ার এই টাকা গরীবকে দান করে দেওয়া হয়। কেউ পকেটে নেয় না। 

ঈদের দিন রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলেও সায়েন্স ল্যাবরেটরির সামনে যানজট ছিল দুপুর থেকে। কারণ শনিবার দুপুর থেকেই সেখানে ধানমন্ডি, কলাবাগান, গ্রিনরোড ও শাহবাগসহ নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্যানগাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা, ঠেলাগাড়ি ও রিকশায় করে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা সেখানে চামড়া নিয়ে হাজির হওয়ায় রীতিমতো যানজট লেগে যায়।

ঈদ উপলক্ষে পাড়া-মহল্লার যে সকল তরুণ সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে চামড়া কিনেছেন তারা মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে দরদাম করে চামড়া বিক্রি করছেন। মৌসুমী এসব চামড়া ব্যবসায়ী এখান থেকে চামড়া কিনে পুরনো ঢাকার পোস্তা কিংবা সরাসরি ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করবেন।

জানা গেছে, ঈদের দিন সাইন্স ল্যাবরেটরিতে দুপুর ১২টার পর থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত মাঝারি গরুর চামড়া ৭/৮শ’ ও বড় গরুর চামড়া সাড়ে ১১শ থেকে সাড়ে ১৩শ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু বিকেল ৩টা থেকে চামড়ার দাম আগের তুলনায় দুই থেকে তিনশ টাকা পর্যন্ত কমে যায়। কয়েকজন খুচরা বিক্রেতার অভিযোগ, দর দাম ঠিক হওয়ার পরও অনেক ক্রেতা টাকা দেয়ার সময় কম দিচ্ছেন।

 সেন্ট্রাল রোডের মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী রমজান বলেন, সরকার ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ টাকা ও ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৪০ থেকে টাকা নির্ধারণ করে দিলেও অধিকাংশ মানুষ না বুঝে না শুনেই চামড়ার ব্যবসায় নেমে পড়ে। যারা বুঝে শুনে চামড়া কেনেন তারা ভালো দাম পান। কেউ বর্গফুটের হিসাব না কষেই বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে হায় হুতাশ করে।

রাজধানী ঢাকায় পোস্তা চামড়া বাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্ক্রিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, পোস্তার একশ বছরের ইতিহাসে চামড়ার বাজার এতোটা খারাপ কখনও যায়নি। আগে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা দুই/তিনদিন পর্যন্ত পোস্তায় চামড়া নিয়ে আসতেন। রাস্তাঘাটে ভারি যানবাহনের লাইন লেগে থাকত। অথচ ঈদের দিন দিবাগত রাত ৩টার পর কেউ আর চামড়া নিয়ে আসেনি।

 নেপথ্যে কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়ার ফ্যাক্টরি স্থানান্তর হওয়া, ট্যানারি মালিকরা পোস্তার ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা না দেওয়া আর টাকা না পাওয়ায় তারা পাইকারি ব্যবসায়ীদের টাকা বকেয়া রাখায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

চামড়া নিয়ে একই অবস্থা দেখা গেছে গ্রামগঞ্জেও। গ্রাম পর্যায়ে নানা সিন্ডিকেট এবং মৌসুমী ব্যবসায়ীরা যে যার মত করে চামড়া কিনেছেন। তারা নানা দোহাই দিয়ে বিক্রেতাদের ঠকিয়েছেন। অবস্থা এমন হয়েছে যে, ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে কেনা পশুর চামড়ার দাম মাত্র ৬০০/ ৭০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। ১০/১২ হাজার টাকার ছাগলের চামড়া ৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এতে হতাশ হয়েছেন বিক্রেতারা। বিশেষ করে চামড়ার টাকা গরিবের হক হওয়ায় তার ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন কম দাম পেয়ে। গফরগাঁওয়ের পাগলা গ্রামের বাসিন্দা মাসুম ১২ হাজার টাকার ছাগল কুরবানি দিয়েছিলেন। তিনি ছাগলের চামড়া মাত্র ৫০ টাকা বিক্রি করেছেন। তার অভিযোগ নিজেতো আর চামড়ার টাকা খাবো না। মাত্র ৫০ টাকায় চামড়া বিক্রি করে খুবই খারাপ লাগছে। ৬৫ হাজার টাকার গরুর চামড়া ৭০০ টাকায় বিক্রি করে একই উপজেলার আবদুল আওয়াল বলেন, এই টাকা থেকে ভাগ বাটোয়ারা করে কয়জন গরীবকে দেব বুঝতে পারছি না। শুনি দেশের বাইরে চামড়া রফতানি করে বিদেশী টাকা আসে। কিন্তু আমরা চামড়া বিক্রি করে কেন দাম পাই না বুঝতে পারছি না। 

সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকায় গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। যা ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। অন্যদিকে খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২০ থেকে ২৫ টাকা, বকরির চামড়ার প্রতি বর্গফুট ১৫ থেকে ১৭ টাকা এবং মহিষের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ২৫ টাকা। কিন্তু চামড়া কেনা বেচার ক্ষেত্রে এসব দামের কোন প্রভাব পড়েনি। যার যার ইচ্ছে মত সিন্ডিকেট করে চামড়া কেনা বেচা করেছেন

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মেহেরপুর কিন্তু মেহেরপুরের চামড়া ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্ধারিত মূল্যের তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামত দামে চামড়া কিনছেন। তাদের দাবি, ট্যানারি মালিকদের কাছে টাকা বাকি ও চামড়ার চাহিদা না থাকার কারণে তারা কম মূল্যে চামড়া ক্রয় করছেন। মেহেরপুর শহরের বড় বাজার ও গাংনী উপজেলা শহরের মাংস বাজার হচ্ছে জেলার সবচেয়ে বড় চামড়ার বাজার। মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী ছাড়াও কোরবানি পশু মালিকরা এ দু’টি বাজারে চামড়া বিক্রি করেন।

বিক্রিতারা জানান, ছাগলের চামড়া প্রতিটি ৫০-৭০ টাকা এবং গরুর চামড়া প্রতিটি ৫০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করলে আরও বেশি দর পাওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বর্গফুট হিসেবে চামড়া ক্রয় করতে নারাজ। এ কারণে ব্যবসায়ীদের নির্ধারণ করা দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন কোরবানি পশুর মালিকরা।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাওয়া খবরে বলা হয়েছে- কোরবানির পশুর চামড়া কিনে বেকায়দায় পড়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চামড়া ব্যবসায়ীরা। এবার কম দামে চামড়া কিনলেও পাইকারদের কাছে ভাল দাম পাচ্ছেন না তারা। চামড়া প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা লোকসান গুণতে হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে চামড়ার আশানুরূপ দাম না পাওয়া অন্যদিকে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত লবনের দাম বৃদ্ধির কারণে লোকসানের আশঙ্কা করছেন পাইকাররাও। তাছাড়া প্রকৃত দাম না পেলে চামড়া অবৈধভাবে ভারতে পাচার হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ