শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

হত্যার রোডম্যাপে ওরা উড়িয়েছে লাল পতাকা

মিয়ানমারের রাখাইনে চলছে গণহত্যা। রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, তাই প্রাণ বাঁচাতে তারা ¯্রােতের মতো বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আনান কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নে মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ওআইসিভুক্ত দেশের কূটনীতিক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্রিফিং-এ বাংলাদেশ এই অনুরোধ জানিয়েছে। এছাড়া রাখাইনের দীর্ঘস্থায়ী এই সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো সমর্থন চেয়েছে। উল্লেখ্য যে. বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে ওই ব্রিফিং-এ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাও রাখাইন রাজ্যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গার প্রাণহানিকে গণহত্যা বলে উল্লেখ করেছেন। এখন বিবেচনার বিষয় হলো, রাখাইনে গণহত্যার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর তার বিচারে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণহত্যার বিচারের ব্যাপারে আমরা বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সোচ্চার হতে দেখেছি। আমরা আশা করবো, রাখাইনে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার বিচারের ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সোচ্চার হবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে আন্তরিকতার পরিচয় দেবে। রাখাইনে গণহত্যার বিচারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনই সোচ্চার না হলে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ ও নিশ্চিহ্ন করার তৎপরতায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরো আগ্রাসী হয়ে উঠবে। উল্লেখ্য যে, রাখাইন রাজ্য জুড়ে সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে অভিযান শুরুর পর এখন সীমানা সন্নিহিত এলাকাকে ‘আর্মি অপারেশন জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। সেনা পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে রাখাইন রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছে মাইকিং। মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ জীপ ও চাইক্কাযোগে কিছু রোহিঙ্গাকে বাধ্য করে আঞ্চলিক ভাষায় এই মাইকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মাইকিং-এ ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘রোহিঙ্গারা এ দেশ ছেড়ে চলে যাও, তোমরা বাঙালি, বাংলাদেশ তোমাদের দেশ।’ এমন অবস্থায় রক্তাক্ত জনপদ রাখাইনে ১৬ দিনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর এখন আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হলো। এদিকে রোহিঙ্গাশূন্য গ্রামগুলোতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী উড়িয়ে দিয়েছে লাল পতাকা। পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা যাতে তাদের গ্রামগুলোতে পুনরায় ফিরে আসতে না পারে সে লক্ষ্যেই লাল পতাকা উড়ানো হয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

বর্তমান পরিস্থিতিতে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আনান কমিশন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে বলেছে, তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বলেছে, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন মানবিক সেবার অধিকার দিতে বলেছে রোহিঙ্গাদের। এদিকে মিয়ানমারে জাতিসংঘের তদন্ত দলকে কাজ করতে দেয়া, আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং রাখাইনে সহিংসতায় যুক্ত লোকজনের বিচার- এ তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের বিবেকবান মানুষরা আনান কমিশনের সুপারিশের দ্রুত বাস্তবায়ন চায়। আমরা মনে করি, আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রথমেই প্রয়োজন হবে উদ্ধত ও বেপরোয়া মিয়ানমারকে আকাশ থেকে মাটিতে নামানো। আর এ কাজে সাফল্য পেতে হলে এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমারের শাসক তথা সেনাবাহিনীকে গণহত্যার অভিযোগে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ লক্ষ্যে কতটা তৎপর হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

তবে বর্তমান সভ্যতায় পৃথিবী যেভাবে চলছে, তাতে মজলুমের পক্ষে কার্যকর ভূমিকা পালনের মতো নীতিবান নেতা ক’জন অবশিষ্ট আছেন? বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকটে চীন ও ভারত যেভাবে নিষ্ঠুর মিয়ানমার সরকারকে সমর্থন জানালো, তাতে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে আর কোনভাবেই সম্মান করা যায় না। এই গ্রহে এখন তো সক্ষমরা আর অন্যায়কে প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে চায় না। কূটনীতির বাতাবরণে এমন এক চাতুর্যের পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়েছে যেখানে মানবতার কোন স্থান নেই। তথাকথিত বিশ্লেষকরাও বে-লেহাজের মতো বলে যান, বড় রাষ্ট্রগুলো তো নিজেদের স্বার্থেই কাজ করে যাবেন। ন্যায়-অন্যায় যেন কোন বিষয়ই নয়। এ কারণেই মিয়ানমারের দৌরাত্ম্য চলতে পারছে।

এমন প্রেক্ষাপটে বিবেকবান মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সু চির মুখোশ উন্মোচনের দাবি ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিষয়ে নীরব থেকে অং সান সু চি নোবেল শান্তি পুরস্কারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন নোবেল বিজয়ী বেশ কয়েকজন নারী। ৮ সেপ্টেম্বর নোবেল বিজয়ী নারীরা এক চিঠিতে সু চিকে লিখেছেন- যাদের কেউ নেই তাদের রক্ষায় আপনার সোচ্চার হওয়ার জন্য আর কত রোহিঙ্গাকে মরতে হবে, আর কত রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হবে, আর কত সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন হতে হবে? চিঠিতে আরো লেখা হয়েছে- আজ আপনার নীরবতা নোবেল শান্তি পুরস্কার ও এর মর্যাদায় একটি কালো ও বিব্রতকর ছায়া ফেলেছে, যে মর্যাদাকে রক্ষা করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই চিঠিটি লিখেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন নাগরিক জোডি উইলিয়াম, ইরানের শিরিন এবাদি, লাইবেরিয়ার লেইমাহ বোয়ি এবং আরো চার নোবেল বিজয়ী নারী। এর কিছুদিন আগে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানের নাগরিক মালালা ইউসুফ জাই এক টুইটার বার্তায় রাখাইন পরিস্থিতিকে হৃদয়বিদারক এবং নিন্দনীয় উল্লেখ করে সু চিকে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর তাগিদ দিয়েছিলেন। মালালা আরো বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে আমি বারবার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অমানবিক ও নিন্দনীয় ভূমিকার নিন্দা জানিয়ে আসছি। সু চির কাছেও আমি একই ভূমিকা প্রত্যাশা করি। বিশ্ব তার যথাযথ পদক্ষেপের অপেক্ষায় আছে, অপেক্ষায় আছে রোহিঙ্গা মুসলিমরাও।’

দুঃখের বিষয় হলো, সু চি কাক্সিক্ষত ও সঙ্গত ভূমিকা পালন করেননি। বরং তিনি যেন একটি মুখোশ পরে আছেন। তার আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করলে মুখোশ পরার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কানাডার দৈনিক দ্য স্টার এক খবরে জানিয়েছে- চার বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় জোডি উইলিয়ামস, শিরিন এবাদি ও লেইমাহ রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অটোয়াভিত্তিক নোবেল উইমেনস ইনিশিয়েটিভ-এর পরিচালক রেচেল ভিনসেন্টও। বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির বক্তব্যে হতাশা ব্যক্ত করেছেন ভিনসেন্ট। শুধু তিনিই নন, বৈঠকে অংশগ্রহণকারী অন্য নারী নোবেল বিজয়ীরাও হতাশ ছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি। ভিনসেন্ট আরো বলেন, আমাদের মনে হয়েছিল রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে সোচ্চার হওয়া সঠিক পদক্ষেপ। কিন্তু বৈঠকের পর মনে হয়েছে, আমাদের উদ্বেগ জনসম্মুখে প্রকাশ করা প্রয়োজনীয়।

প্রসঙ্গত ভিনসেন্ট বলেন, মিয়ানমারে যখন সু চি গৃহবন্দী ছিলেন তখন নোবেল বিজয়ী নারীরা তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সামরিক সরকারের অনুমতি নিয়ে মিয়ানমারে গিয়ে দেখা পর্যন্ত করেছিলেন জোডি উইলিয়ামস। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া শাখার ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন বলেন, যখন বিশ্বের মানুষকে তাদের স্বাধীনতাকে সু চি ও কারাবন্দী গণতান্ত্রিক নেতাদের মুক্তির জন্য কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন তখন সু চি একটি অলিখিত প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তিনি সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছেন। বিশ্ব-সম্প্রদায়ের যারা তাকে সমর্থন করেছিলেন, এই আচরণ তাদের প্রতি চপেটাঘাতের মতো। আসলে সু চির আচরণে তার মুখোশ বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। এ কারণে হয়তো চেঞ্জ ডট আরজি নামের ওয়েব সাইটে সু চির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতে প্রায় ৩ লাখ ৯০ হাজার লোক একটি অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন। এছাড়া সু চির কানাডার নাগরিকত্ব বাতিলের আহবান জানিয়েও একটি আবেদন করা হয়েছে। এমন আবেদনকে আমরা সঙ্গত বলেই মনে করি। 

কারণ যে মানুষ নিজ দেশের নাগরিকদের নাগরিকত্ব হরণ এবং তাদেরকে হত্যা ও ধর্ষণের পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়াকে সমর্থন করে তার অন্য দেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব পাওয়ার কোন অধিকার থাকে না। বিষয়টি সু চি আদৌ উপলব্ধি করেন কিনা তা আমরা জানি না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ