বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ব্রেস্ট ক্যান্সার : সহজ প্রতিরোধ ব্যবস্থা

-ডা. জিএম ফারুক
ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সার পাশ্চাত্য (৩৫-৫৫) অতি সাধারণ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। প্রতি বছর এ রোগের প্রকোপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফুসফুসের ক্যান্সারের পরেই ব্রেস্ট ক্যান্সার এখন মহিলাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী অক্টোবর মাসকে ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতার মাস হিসাবে পালন করা হয়। বিশেষভাবে শিল্প সমৃদ্ধ পাশ্চাত্য দেশগুলোতেই ব্রেস্ট ক্যান্সার বেশি দেখা যায়। এ জন্য ব্রেস্ট ক্যান্সারকে Disease of Civilisation বলা হয়ে থাকে।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ : স্তনে চাকা বা পি- থাকা (ব্যথাবিহীন ৬৬%)। স্তনের আকারে পরিবর্তন হওয়া। স্তনের বোটা ভিতরে ঢুকে যাওয়া। স্তনের বোঁটা থেকে অস্বাভাবিক রস ক্ষরণ। স্তনের চামড়ার রঙ পরিবর্তন। বগলতলায় চাকা বা পি- থাকা।
ব্রেস্ট ক্যান্সার যাদের বেশি হয় : ব্রেস্ট ক্যান্সারের নিশ্চিত কারণ অজানা। তবে জেনেটিক কারণ অন্যতম। যে সব পরিবারের নিকটাত্মীয়ের অন্তত দু’জন ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীর ইতিহাস থাকে, তাদের চার থেকে ছয়গুণ বেশি সম্ভাবনা থাকে ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার। এছাড়া যাদের অল্প বয়সে (১২ বছরের নীচে) মাসিক শুরুর ইতিহাস, অধিক বয়সে (৫০ বছরের পরে) রজোনিবৃত্তি (Menopause), অধিক বয়সে প্রথম গর্ভধারণ (৩০ বছরের পর), যারা নিঃসন্তান, অধিক সময় গর্ভনিরোধক বড়ি সেবন, হরমন থেরাপী গ্রহণ, স্থূলতা (Obesity), অ্যালকোহল সেবন ইত্যাদি কারণে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে থাকে। এছাড়া অধিক চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ, বসা কাজের অভ্যাস, ব্যায়াম না করা, ক্রমাগত মানসিক চাপও ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য দায়ী বলে বর্তমানে চিহ্নিত। অন্যদিকে যে সব মহিলার জরায়ু কিংবা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে, তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। আবার ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীর ফুসফুস, বোন, লিভার ক্যান্সার প্রবণতা থাকে।
ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ : মেয়েদের মাসিক শেষ হওয়ার পর পরই একটি নির্দিষ্ট দিনে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করতে হবে। ব্রেস্টে কোন ধরনের চাকা বা কোন ধরনের অস্বাভাবিকতা থাকলে সাথে সাথেই চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তবে ব্রেস্টে চাকা থাকা মানেই কিন্তু ক্যান্সার নয়। শতকরা ১০ ভাগ চাকা হয়তো ভবিষ্যতে ক্যান্সার হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। অন্তত ২০ বছর বয়স থেকে সকল মেয়েকেই নিজ স্তন নিজেই পরীক্ষায় অভ্যস্ত হওয়া দরকার। (নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষার কৌশল নিকটস্থ কোন স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স বা চিকিৎসকের নিকট থেকে শিখে নিতে হবে)।
খাবার দাবারের ক্ষেত্রে চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। ফলমূল বেশি বেশি খেতে হবে। ভিটামিন এ এবং সি জাতীয় ফলমূল বেশি খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। যে সব খাবারে বিটা ক্যারোটিন রয়েছে, যেমন- গাজর, মিস্টি আলু এবং সবুজ শাক সবজি প্রচুর খেতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। যাদের ওজন বেশি অবশ্যই তাদের ওজন কমাতে হবে। মানসিক চাপ থাকলে সাইকোথেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। ধর্মীয় অনুশীলন মেনে চলতে হবে। জীবন যাত্রায় নৈতিকতা এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।
ব্রেস্ট ক্যান্সার : প্রধান শ্রেণীবিভাগ : নন ইনভেসিভ গ্রুপে রয়েছে ডাক্টাল কারসিনোমা ইন সাইটো, ইনট্রাডাক্টাল কারসিনোমা, লবিউলার কারসিনোমা ইন সাইটো। ইনভেসিভ গ্রুপে রয়েছে ইনফেলট্রেটিং ডাক্টাল, মেডুলারি, লবিউলার, টিউবুলার, মিউসিনাস, প্যাপিলারি, স্রিব্রিফরম। এছাড়া রয়েছে, ইনফ্ল্যামেটরি কারসিনোমা, প্যাগেটস ডিজিজ। এর মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগ ইনভেসিভ ডাক্টাল কারসিনোমা এবং ইনভেসিভ লবিউলার কারসিনোমা ১০ ভাগ।
ব্রেস্ট ক্যান্সার : স্তর বিন্যাস : ক্যান্সার নির্ণয়ে স্তর বিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থাৎ ক্যান্সারটি নির্দিষ্ট অঙ্গে বা জায়গায় রয়েছে না অন্য কোথাও ছড়িয়েছে, তা জানার বিষয়ই হচ্ছে স্তর বিন্যাস (Staging)। ক্যান্সার স্তর বিন্যাসে TNM পদ্ধতিই বেশি ব্যবহৃত। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ স্তর বিন্যাস করা হয়ে থাকে। রোগের গতি-প্রকৃতি এবং চিকিৎসা পরিকল্পনার জন্য স্তর বিন্যাস জানা জরুরি।
ব্রেস্ট ক্যান্সার : প্রয়োজনীয় পরীক্ষা : ইমেজিং পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে ডায়াগনস্টিক মেমোগ্রাম, আলট্রাসাউন্ড, এমআরআই (MRI)। সার্জিক্যাল পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে বায়োপসি (bipsy)। টিউমার মার্কারের মধ্যে রয়েছে সিইএ (CEA), সিএ-১৫-৩ (CA-15-3), বা সিএ-২৭.২৯। এছাড়া রক্তের সিবিসি (CBC) সহ অন্যান্য পরীক্ষা। আরও প্রয়োজন হতে পারে বুকের এক্স-রে, বোনস্ক্যান, সিটি স্ক্যান, পিইটি স্ক্যান, ইত্যাদি। রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসকের অভিজ্ঞতাই বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। তবে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা, মেমোগ্রাফি এবং এমএনএসি (FNAC)। এ তিন পরীক্ষা দারাই আধুনিক চিকিৎসা নির্ণয় করা হয়।
আধুনিক চিকিৎসা : আধুনিক চিকিৎসা বলতে অ্যালোপ্যাথি। এ পদ্ধতিতে সার্জারী, রেডিয়েশন থেরাপি, কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি, ইমিউনোথেরাপী এবং জিন থেরাপি দ্বারা ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা : হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞান ভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি। নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতির আলোকে শক্তিকৃত ওষুধের সূক্ষ্মমাত্রার প্রয়োগে এ পদ্ধতির চিকিৎসা পরিচালিত। প্রয়োজনীয় শিক্ষা, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যদি এ পদ্ধতির চিকিৎসা দেয়া যায়, তবে রোগীরা ভাল উপকার পেয়ে থাকেন। বিশেষভাবে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক হওয়া দরকার। বাণিজ্যিকভাবে যে কেউ ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা প্রদান এক ধরনের পেশাগত অপরাধ। হোমিওপ্যাথি জগতে এ ধরনের অপরাধ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছেৎ। অথচ হোমিওপ্যাথি একটি উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে অনেক ভাল ভাল ওষুধ রয়েছে, যা যথাযথ নিয়মে প্রয়োগ করতে পারলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগীরা ভাল থাকতে পারেন।
এখানে মনে রাখতে হবে, হোমিওপ্যাথিতে রোগ নির্ণয়ই শেষ কথা নয়। রোগীর সামগ্রিক চরিত্র বিবেচনা করে ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। রোগ, রোগের গতি প্রকৃতি এবং রোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে দক্ষতা না থাকলে শুধু লক্ষণাবলী দ্বারা চিকিৎসা সম্ভব নয়।
অথচ হোমিওপ্যাথিতে আজকাল অনেকেই নিজেকে ক্যান্সার চিকিৎসক দাবি করছেন, কিন্তু ক্যান্সার সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই নেই। এ ধরনের চিকিৎসকদের খপ্পরে পড়ে অনেক রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার কথা আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছে। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ক্যান্সার সোসাইটি অফিসে প্রতিনিয়ত এ ধরনের অভিযোগ আসছে। যেহেতু এ সোসাইটির সাথে আমাদের সংশ্লিষ্ট রয়েছে। তাই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সাথে যারা জড়িত তাদেরকে অনুরোধ জানাব। আপনি আপনার যোগ্যতা সম্পর্কে সচেতন হোন। ব্যবসা নয়, মানবিকতাই হবে চিকিৎসার উদ্দেশ্য। অর্গাননের প্রথম ভাষ্যটি স্মরণে রাখুন: চিকিৎসকের প্রধান দায়িত্ব এবং পেশাগত কর্তব্য হচ্ছে অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ করা।
হোমিওপ্যাথিতে সুস্থতার ধারণাটি ব্যাপক। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার আদর্শ হচ্ছে, দ্রুত, নিরাপদে রোগীর দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য লাভে প্রচেষ্টা চালানো।
তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের যথাযথ জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন না করলে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত যে, ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে তার আরোগ্য সুনিশ্চিত। এ জন্য ডিগ্রীপ্রাপ্ত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকরা ক্যান্সার বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে এ ধরনের রোগীদের উন্নত সেবা প্রদানে অগ্রহণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। আর রোগী সমাজেরও উচিত, সেবা গ্রহণের পূর্বে তার চিকিৎসকের যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। আজকাল বিভিন্ন ওয়েবসাইটে দেখা যায়, কয়েকটি ওষুধ, যেমন, থুজা, কনিয়াম, ফাইটোলাক্কা, কারসিনোসিন প্রভৃতি ওষুধ দ্বারা তারা সব ব্রেস্ট ক্যান্সার ভাল করার দাবি করছেন। হতে পারে তারা হয়তো ভাল ফল পেয়েছেন।
কিন্তু সেখানে কোন পর্যবেক্ষণ সমীক্ষণ ফলাফল নেই। তাই চিকিৎসকরা এ ধরনের নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের ব্যাপারে নির্ভরশীল না হওয়াই ভাল। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার নিয়ম অনুযায়ী রোগীর সামগ্রিক চরিত্র বিবেচনায় যে কোন ওষুধই নির্বাচিত হতে পারে এবং এতেই রোগী বেশি উপকৃত হবেন।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ক্যান্সার সোসাইটি রোড-১১, বাড়ি-৩৮ নিকুঞ্জ-২, কিলক্ষেত, ঢাকা-১২২৯। ফোন : ০১৭১২-৮১৭১৪৪, ০১৭৪৭১২৯৫৪৭।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ