শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

নজরুল এত বিশাল ভান্ডার দিয়ে গেলেন কি অবহেলা করার জন্যে?

-শফি চাকলাদার
‘ঈদ-আল-আযহা’ হয়ে গেল। মিডিয়া চ্যানেলসমূহ ৭/৮ দিনব্যাপী উৎসব আয়োজন করল। কিন্তু ‘নজরুল’ কোথায়? প্রতিদিনের গানে গানে অনুষ্ঠান হয়েছেও অন্য মাত্রায়। কোন কোন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ভাবলেন আনন্দ উৎসব। আনন্দ উৎসব তাই নিতম্ব দোলানোতে ক্যামেরা তাক লাগালে ক্ষতি কি? নজরুল বলেছিলেন, “মাজা দুলিয়ে পারিয়ে যাব ভবনদীর পার”-এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নজরুল সাথে সাথে এ-ও বলেন, “রীতিমত কাব্য। বুঝবার কোন কষ্ট হয় না, আল্লা বলতে এবং নবিকে সার করতে উপদেশও দেওয়া হল, মাজাও দুলল এবং ভবনদী পারও হওয়া গেল। যাক, বাঁচা গেল- কিন্তু বাঁচল না কেবল কাব্য।” নজরুলের এ লেখার প্রায় ৯০ বছর পর আমরা কিন্তু উৎসব পেলেই মাজা র‌্যান্ডম দোলাচ্ছি কিন্তু এতে ‘ঈদ’ উৎসবের মান-মর্যাদায় ঘা লাগে কিনা সে স্থানটুকুই অর্জন করতে সম্ভব হয়নি। ঢাকায় কমপক্ষে ত্রিশটির মতো চ্যানেল রয়েছে। প্রতিটি চ্যানেলে যদি পাঁচজন করে সাংস্কৃতির সাথে যুক্ত আছে ধরা যায় তবে প্রায় দেড় শতাধিক ব্যক্তি এই ধরনের অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছে। তারা কি কেউ ‘নজরুল’ পড়েননি? আমি এখানে রবীন্দ্র নিয়ে প্রসঙ্গ তুলছি না কারণ রবীন্দ্র’র কোন ইসলামিক ভাবনা/লেখা নেই এমনকি রবীন্দ্র সংগীতের মুসলমান শিল্পীরা পর্যন্ত ইসলামি গান করেন না ইসলামি অনুষ্ঠানে আসেন না। তাই বলছি চ্যানেলসমূহের এই সকল অনুষ্ঠানের কর্তা-ব্যক্তিরা কি সত্যি এখনো ‘নজরুল’ সম্পর্কে অপ্ত? ‘ঈদজ্জোহা’ নাটিকায় পাঁচটি গান রয়েছে, এছাড়াও আরো দশটি গান পাওয়া যায় যা ঈদজ্জোহার অনুষ্ঠানে গীত হবার মতো। তবে বিটিভি’র রামাদান-এ ইফতার পরবর্তী অনুষ্ঠানে যখন ‘মোহররমের চাঁদ এলো ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়’ গীত হতে পারে তখন সব গানই তো গীত হতে পারে নয়কি? লক্ষ্য করুন বিটিভি কর্তৃপক্ষের কী দারুন জ্ঞান ভান্ডার সামনে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উৎসব সেখানে হচ্ছে মোহররমের মর্সিয়া/শোকের গান। কি দারুণ সিলেকশন? আমি গেলবারে ইফতার পরবর্তী (ইফতার চলাকালিন) সময়ে ‘মোহররমের চাঁদ এল ঐ’ চলাকালিন ফোন করেছিলাম যে এটা আপনারা করছেন কি? পরবর্তীতে দু-একদিন গ্যাপে আবার শুরু হল এবারও হল- এরা সম্ভবত ‘ঠ্যাঙ্ক’ শব্দটিকে খুব ভালবাসে। শুনবে কেন? তারা কি কম জানতা? নইলে চান্স পেল কি করে? যে চান্স দিয়েছে তারওতো ‘নজরুল’-না জানতা’র গৃহে বসবাস? এদের কাছেই আমার প্রশ্ন অনুযোগ-উৎসব অনুযায়ী অন্তত ৭/৮ দিন ক্রমাগত অনুষ্ঠানাদির (বস্তাপচা শব্দটি না-ই ব্যবহার করলাম- কারণ প্রজন্মকে তারা এসব অনুষ্ঠান সহ্য করার মতো তৈরি করে ফেলেছে) মধ্যে ২/৩টি অনুষ্ঠান  ৪০ মিনিটের বা বেশি-কম সময় নির্ধারিত করে জাতিকে অনুপ্রাণীত করে। ঈদুল আযহার ইতিহাস সম্বলিত একাধিক গান নজরুলের রয়েছে সেগুলো নির্বাচিত করে যাদের মুখ দেখা যায় তাদের নয় অচেনা উপস্থাপকের মাধ্যমে প্রচার করতে অসুবিধে কোথায়? হয়তো এমন একদিন আসবে যে প্রজন্ম জানবেই না যে নজরুলের ঈদুল আযহা নিয়ে কোন রচনাই নেই। কিম্বা হিন্দুদের উৎসবাদির কোন গানই নেই। নজরুলের ‘গজল’গুলো হয়তো অনুষ্ঠান কর্তার নামেই প্রচারিত হচ্ছে। খ্যায়াল-শাস্ত্রীয় সঙ্গীত-ঠুংরী নিয়ে তো ইতিমধ্যেই বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচলিত হয়ে গেছে। কোন এক চ্যানেলের এক উপস্থাপক বীরদর্পে উচ্চারণ করলেন নজরুলের বর্ষার উপর গান খান বিশেক হবে? কিম্বা রবীন্দ্রনাথই যখন ইসলমী গান রচেননি তাহলে নজরুল কি রচবেন? ছায়ানটের বৈশাখী অনুষ্ঠানে ‘সৃজন-ছন্দে নাচ আনন্দে’ পরিবেশনে নির্বাচিত হতে পারে কিন্তু ইসলামি গান নির্বাচিত হতে পারে না। মাইক যখন হাতে বলতে অসুবিধা কোথায়? বিভ্রান্তি ছড়াতে অসুবিধে নেই- এরাই মনে করিয়ে দেয় শরৎচন্দ্রের “বাঙ্গালী বনাম মুসলমানের খেলা চলছে” বাক্যকে। আমাদের চ্যানেলসমূহে বেশকিছু বুদ্ধিজীবীর তথাকথিতদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় নজরুল জন্মদিনে এসে নজরুলের জন্য ‘টেবিল ভেঙে ফেলে থাপ্পড় মেরে বক্তার পর বক্তার কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে সারা বছরব্যাপী কখনো কোনো সাহিত্য সঙ্গীত আলোচনায় এসে নজরুলকে একদম উচ্চারণই করেন না। একজন চাদর মুড়ি দেয়া বুদ্ধিজীবী তো আসেন শুধু রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে। এ ধরনের কথা সমীচীন কিনা তা বোঝার দরকার কি? তারপর কিছু নজরুল শিল্পী আছেন যারা গানের ফাঁকে ফাঁকে কথা বলার মাঝে বলেন এটা শুদ্ধ এটা আদি-এই দু’টো শব্দ সমগ্র নজরুল সঙ্গীতকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এখন দর্শক-শ্রোতা গান শোনার সময় বলেই দেন এটা কি শুদ্ধ না অশুদ্ধ, এটা আদি নাকি বর্তমান? এটা বিকৃত নাকি অবিকৃত? যারা স্বরলিপি করে বাহবা কুড়োচ্ছেন-তাদের জন্য বলি মৃণাল কান্তি ঘোষের গাওয়া ‘এ কূল ভাঙে’ কিম্বা ‘কা-ারী গো কর কর পার’-এর কোন কোনো স্থানে কণ্ঠ থ্রো এমনভাবে পর্দায় লাগিয়ে করেছেন তা বর্তমানের কোন শিল্পী তেমন করে কণ্ঠ থ্রো করতে পারবেন? আব্বাস উদ্দিন আহমদ কিম্বা কে. মল্লিক কিম্বা হাসির গানগুলোতে রঞ্জিত রায় যেমন করেছেন তা বর্তমানে তেমন কোনো শিল্পী করতে পারবেন। মূলত রবীন্দ্র-রজনী-অত’ল-দ্বিজেন্দ্রর ‘নায়কী’ সঙ্গীতের মতো করে নজরুল প্রবর্তিত গায়কী, শিল্পী স্বাধীনতা, বৈঠকী মেজাজের গানগুলোকে ভাবলে তাদের নজরুল সঙ্গীতের মহাসমুদ্রে না পড়েই থাকাই ভালো। নজরুলের ‘অগ্নিগিরি’ গল্পের একটি সংলাপ-‘মাদ্রাসায় না পড়ে সে যদি খানায় পড়তো ডোবায় পড়তো-তাতেই বা কার কি ক্ষতি হতো।’ ঠিক সে রকম করেই বলা যায় ‘নজরুলের’ বিশাল সুর ভান্ডার নির্মিত হয়েছে নজরুলের অপরিসীম মেধার কারণে যে মেধার মসল্লা ছিল গায়কী, শিল্পী স্বাধীনতা, বৈঠকী-তাকে ঐ রবীন্দ্র বা নায়কী মানসিকতার শিল্পী দ্বারা কাজ করলে নজরুলের বিশালতায় বাধাপ্রাপ্ত হবেই। নজরুল শিল্পীর দায়িত্বে অরিজিন উদ্বুদ্ধ নজরুল থেকেই হলে ‘আদি’ শুদ্ধ এসব শব্দের কোনো দরকার পড়তো না। -শুধু বিভ্রান্তি ছাড়া। যাই হোক আমার অনুযোগ-কেন এই চ্যানেলসমূহ ঈদ অনুষ্ঠানমালায় অবাধে টাকা খরচ করে। কেন সেখানে ঈদ অনুষ্ঠানে ঈদের গান নিয়ে বিশেষ করে নজরুল অনুষ্ঠান হয় না। শুধু গান নয় সেখানে নজরুলের একাধিক কবিতা, ঈদ উদ্বুদ্ধকরণ প্রবন্ধ, নাটিকা, বৈচিত্র্য সহায়কা হতেই পারে। লক্ষ্য করুন কত কত গান বা রচনা রয়েছে এর একটি তালিকা তুলে ধরছি-
০১। নতুন চাঁদের তকবির শোন, কয় ডেকে ঐ মুয়াজ্জিন, ০২। ঈদজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ এলো আবার দুসরা ঈদ, ০৩। ঈদজ্জোহার তকবির শোন ঈদগাহে, ০৪। নাই হলো মা বসন-ভূষণ এই ঈদে আমার, ০৫। ছয় লতিকার ঊর্ধ্বে আমার আরফাত ময়দান, ০৬। আমি হজ্জে যেতে পাইনি বলে কেঁদেছিলাম রাতে, ০৭। ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক হো, ০৮। আজি ঈদ ঈদ ঈদ খুশির ঈদ এলো ঈদ, ০৯। কাবার জিয়ারতে তুমি কে যাও মদিনায়, ১০। আঁধার মনের মিনারে মোর/হে মুয়াজ্জিন, দাও আজান, ১১। ইয়া রাসূলুল্লাহ। মোরে রাহ দেখাও সেই কাবার, ১২। খুশি লয়ে খোশরোজের আয় খেয়ালী খোশ নসিব, ১৩। চলরে কাবার জিয়ারতে চল নবীজীর দেশ, ১৪। জাগে না সে জোশ লয়ে আর মুসলমান, ১৫। দুখের সাহারা পার হয়ে আমি চলেছি কাবার পানে, ১৬। রাখিসনে ধরিয়া মোরে, ডেকেছে মদিনা আমায়, ১৭। শহীদী ঈদগাহে দেখ আজ জমায়েত ভারি। (০৮ থেকে ১৭ পর্যন্ত উভয় ঈদেই পরিবেশিত হতে পারে)। কবিতা-কোরবানী, শহীদী ঈদ, রীক সর্দার কবিতায় ৪০-৪১ স্তবক, চল চল চল গানটিতে শহীদী ঈদের সেনারা সাজ, মোবারকবাদ কবিতায়, ঈদের চাঁদ, বকরীদ,। নাটিকা ঈদজ্জোহ, জনসাহিত্য প্রবন্ধে শাখ-ই-নবাত কবিতায়। শেষ করছি এই লিখে যে ঢাকার চ্যানেলসমূহ বলে থাকে ঐতিহ্য, ইতিহাসকে উপস্থাপন করা-তা কি তারা করছেন? নাকি বলার মধ্যেই থাকা। যে কোনো ঈদে গাওয়ার মতো গান- ‘খোদা এই গরিবের শোনো শোনো মোনাজাত’ গানটির উল্লেখ করে বলছি প্রতি উৎসব অনুষ্ঠানে উৎসব অনুযায়ী প্রোগ্রাম যেন স্থান পায়। আর প্রতিটি উৎসব-অনুপাতে গান নজরুলেই আছে। আশা করবো ‘নজরুল’ যেন সে সামনে পায়। ‘নজরুল’কে বাদ দিয়ে কোনো ঐহিত্য গড়া হবে মহাভ্রান্ত। বাংলার মুসলমানদের সংস্কৃতির পথে ‘নজরু’ই সে পথ দেখিয়েছেন। আজ যে অগ্রসরে পৌঁছেছি তার কারণ শুধু ‘নজরুল’ এটা মনে রাখতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ