শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বন্যায় আর্থিক ক্ষতি শুধু হাওরাঞ্চলেই ৫ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা

 

স্টাফ রিপোর্টার : বন্যার কারণে এ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় এমন পূর্বাভাসই পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের গবেষণায় দেখায়, এ বছরের বন্যার আর্থিক ক্ষতি শুধু হাওরাঞ্চলেই ৫ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা। যা কৃষি খাতে জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সিপিডি ‘বন্যা-২০১৭: ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও বন্যা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরে পূর্বাভাসের কথা জানায়। এ উপলক্ষে আয়োজিত সংলাপ অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-এমপিসহ বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। 

সংলাপে বন্যার কারণে দেশের বেশির ভাগ এলাকার সড়ক ও বেড়িবাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও বাঁধ মেরামতে ‘হরিলুট’ হতে পারে বলে অভিযোগ করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। তার এই অভিযোগের জবাবে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বন্যা-পরবর্তী সংস্কার কাজ নিয়ে লুটপাট হতে পারে, তবে ‘হরিলুট’ হবে না। একই সময়ে মন্ত্রী হাওরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির কথা স্বীকার করেন। তবে তিনি হাওরে বন্যার জন্য আবারও ইঁদুর ও স্থানীয়দের বাঁধ কাটাকে দায়ী করলেন।

সিপিডি’র বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় উক্ত সংলাপে আরো বক্তব্য রাখেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্রনাথ শম্ভু, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বিশেষ ফেলো ড. এম আসাদুজ্জামান, সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন প্রমুখ। 

ওই অনুষ্ঠানে বন্যার কারণে দেশের বেশির ভাগ এলাকার সড়ক ও বেড়িবাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- এমন তথ্য তুলে ধরেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও বাঁধ মেরামতে লুটপাটের মচ্ছব হতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারকে সাবধান হতে হবে। এসব সংস্কার কাজে সংসদ সদস্যদের দূরে রাখতে হবে। স্থানীয় জনগণকে কাছে রাখতে হবে ও সম্পৃক্ত করতে হবে।

বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ড. আইনুন নিশাতের এসব অভিযোগের জবাবে পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বন্যা পরবর্তী সংস্কার কাজ নিয়ে লুটপাট হতে পারে, তবে ‘হরিলুট’ হবে বলে আমি মনে করি না। কিছু দুর্নীতি হতে পারে যেটা আমরা বন্ধ করতে পারি নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজে কোনো দুর্নীতি হয় না-এমন কথা আমি বলব না। কিন্তু দুর্নীতির কারণে বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়েছে, এটা আমি মানতে রাজি না।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন কারণে বন্যা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, মূলত বাংলাদেশের উজানে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম বৃষ্টি হওয়ায় বন্যার পানি বাঁধ উপচে মূল ভূখন্ডে প্রবেশ করেছে। হাওরে বাঁধ উপচে পানি ঢোকার পাশাপাশি ৫শ’টি স্থানে কৃষক বাঁধ কেটে দেয়ায় সেখান দিয়েও পানি ঢুকেছে। আর দিনাজপুরে বাঁধের ওপরে একটি ফুলগাছ ছিল। সেটি ভেঙে গিয়ে ওই ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে বন্যা হয়েছে। দেশের অনেক এলাকায় ইঁদুর এসে বাঁধ ফুটো করে দেয়ায় সেখান দিয়ে পানি ঢুকেছে। 

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, এবছরে তিন বার বন্যা হয়েছে। তবে বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়নি। অতিবৃষ্টির কারণে পানি বাঁধ দিয়ে উপচে পড়েছে।

ধীরেন্দ্রনাথ শম্ভু বন্যা পরবর্তী সংস্কার কাজে সংসদ সদস্যদের দূরে রাখার বিষয়ে অধ্যাপক আইনুন নিশাতের পরামর্শের সমালোচনা করে বলেন, সংসদ সদস্যরা জনপ্রতিনিধি। তারা এলাকার উন্নয়নের কাজে সব সময় সম্পৃক্ত থাকেন। বন্যা পরবর্তী কাজে তাদের দূরে রাখা হবে কেন, তা আমি বুঝতে পারছি না।

সিপিডি তাদের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করে বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রয়োজন। আর যেটুকু বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তার বড় অংশ এখনো বিতরণ করা হয়নি।

এসব ব্যাপারে ধীরেন্দ্র দেবনাথ সম্ভু বলেন, যদি বিতরণ করা না হয়ে থাকে, তবে সেটা রাষ্ট্রের ফান্ডেই থেকে গেছে। কেন বিতরণ করা হয়নি সেই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ইঁদুরে বাঁধ কাটার কারণে নাকি মেরামত ত্রুটির কারণে বাঁধ ভেঙে বন্যা হলো, তা ভেবে দেখার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রীকে আহ্বান জানান। সিপিডি তাদের গবেষণায় দেখায়, এ বছরের বন্যার আর্থিক ক্ষতি জিডিপির ০.৩৫ শতাংশ থেকে ০.৪৪ শতাংশ। ড. দেবপ্রিয় বলেন, জলবায়ুর যে পরিবর্তন হচ্ছে, সেটাকে বিবেচনায় না নিতে পারলে আগামী দিনে বন্যা ব্যবস্থাপনায় কার্যকারিতা সীমিত হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, এ বছর বন্যার কারণে বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন। আমন ও আউশের ক্ষতি এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।

বিআইডিএস’র সাবেক পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, দেশে বড় অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগে আগ্রহ বেশি। কিন্তু তা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে খুব বেশি আগ্রহ দেখা যায় না।  তিনি বলেন, এখানে খাদ্য সম্পর্কে একটা অনিশ্চয়তার ব্যাপার আছে। এই অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছিল, কারণ সরকারের ঝুলিতে এমন কিছু ছিল না। এটা সবাই জানতো সরকারের ঝুলিতে কিছু নেই, সরকারের কিছু করার ক্ষমতা নেই। বোরোর নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষতি, আমনের সম্ভাব্য ক্ষতি এবং সরকারের ঝুলিতে না থাকা, এই সবকিছু মিলেই বর্তমান খাদ্য পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বন্যা পরবর্তী পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভাল না থাকায় পানিবদ্ধতার কারণে আমন ধানের উৎপাদন প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ কম হতে পারে। 

সিপিডি জানায়, সম্প্রতি হাওর অঞ্চলে পাহাড়ি ঢল ও মওসুমী আগাম বন্যায় দেশের ৩২টি জেলায় ফসল, ফসলী জমিসহ ঘর-বাড়ি, স্থাপনা ও রাস্তাঘাট বিলীন হয়। সরকারিভাবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা না হলেও, বেসরকারি গবেষণা অনুযায়ী, শুধু হাওরাঞ্চলেই ৫ হাজার তিনশো কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যা কৃষি খাতে জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। একইসঙ্গে আগস্টে মওসুমী আগাম বন্যার কবলে দেশের ৩২টি জেলায় শুধু ঘড়-বাড়ির ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। বন্যার কারণে এ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ সংলাপে দেশের বন্যা, দুর্যোগ ও পানি বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। তারা বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কাজে কৃষি খাতকে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো শুষ্ক মওসুমে মেরামত করার পরামর্শ দেন তারা। বক্তারা আরো বলেন, বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তার একটি বড় কারণ দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরতে না পারা। তবে বন্যার কারণেই যে দ্রব্যমূল্যের এমন চিত্র, তা মেনে নেয়া যায় না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ