শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

হয়রানির শিকার হন রাস মেলার পুণ্যার্থীরা ॥ বেপরোয়া অপরাধীরা

খুলনা অফিস : সুন্দরবনের দুবলার চরে রাস উৎসবে দর্শনার্থীদের অনুমতি ফি গত বছর থেকে বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে রাজস্ব বেড়েছে বন বিভাগের। এদিকে মাঠ পর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাতে প্রকৃত পুণ্যার্থীরা অনেক সময় হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আবার হরিণ শিকারীদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ারও অভিযোগ উঠছে। ফলে একদিকে বন বিভাগের ওপর মেলায় আগতদের নেতিবাচক ধারণা জন্মাচ্ছে, অন্যদিকে প্রকৃত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। অপরাধীরা আরও অপরাধ প্রবন হয়ে উঠছে। সরেজমিন যেয়ে এবং একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

এদিকে আজ ২ নবেম্বর বৃহস্পতিবার থেকে দুবলার চরে রাস পূর্ণিমার তিন দিনের উৎসব শুরু হবে। এ উৎসবকে ঘিরে সব ধরনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। বনবিভাগ দুবলা চরে যাতায়াতে দর্শনার্থী ও পূর্ণার্থীদের জন্য আটটি রুট নির্ধারণ করেছে। র‌্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ডসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা এ সব রুটের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়ে নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবে। 

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর থেকে সুন্দরবনের দুবলার চরে রাস মেলায় আগতদের দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যারা রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে পূজা অর্চনা করবেন তাদেরকে পুণ্যার্থী ধরা হয়েছে। পুণ্যার্থীদের ৩ দিনের জন্য জনপ্রতি অনুমতি ফি ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অপর দিকে মেলা উপভোগ করার জন্য আগতদের দর্শনার্থী ধরা হয়েছে। দর্শনার্থীদের ৩ দিনের জন্য জনপ্রতি অনুমতি ফি ২১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

আরও জানা যায়, পশ্চিম বন বিভাগ থেকে গত বছর ৩ হাজার ৬৬৪ পুণ্যার্থী ও ৪ হাজার ৬৭৬ র্দশনার্থী অনুমতি ফি দিয়ে মেলায় যায়। জলযানের অনুমতি দেয়া হয় নলিয়ান স্টেশন হতে ১৬১টির, কাশিয়াবাদ থেকে ৮টির ও বানিয়াখালী থেকে ৯টির। পশ্চিম ও পূর্ব বিভাগ মিলে শুধু মেলা উপলক্ষে রাজস্ব আদায় হয় ১৯ লাখ ২৯ হাজার ৪১১ টাকা।

নলিয়ান স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা মো. মকরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, খুলনা রেঞ্জে সব চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে নলিয়ান থেকে। তাদের রাজস্ব আদায় ছিল ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৪৬৯ টাকা।  তিনি আশা প্রকাশ করছেন এবার রাজস্ব আদায় আগের বছরের থেকে বেশি হতে পারে।

এদিকে বন বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী বেশ অনিয়মের সাথে জড়িত। খুলনার ডুমুরিয়ার মির্জাপুর গ্রাম থেকে একটি ট্রলারে ৩০ জন পুণ্যার্থীরা গত বছর দুবলার চরে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে ৪ জনের মানত ছিল দুবলার চরে পুণ্যস্নানের সময় প্রত্যেকে একটি করে মোট ৪টি ছাগলের বাচ্চা উৎসর্গ করবেন। ওই ট্রলারে সেই মানতের ৪টি ছাগল ছিল। পথিমধ্যে বন বিভাগের একটি টহল টিম তাদের ট্রলার চেক করে ছাগল বনে নেয়া নিষেধ বলে জানায়। পুণ্যার্থীরা বিষয়টি অবহিত নয় জানিয়ে ছাগল ৪টি বনে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুমতি চায়। কিন্তু নিজেকে বন প্রহরী ওয়ালিউর রহমান মিলন দাবি করে এক কর্মকর্তা ওই পুণ্যার্থীদের সাথে ব্যাপক অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন এবং ছাগল ৪টি তাদের বোর্ডে নিয়ে যান।  বন প্রহরী ওলিউর রহমান মিলন ছাগল ৪টি নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন তা পাটকোস্টায় জমা করা হয়েছে। তবে পাটকোস্টা ক্যাম্পের ইনচার্জ হেমায়েত হোসেন বলেন, তাদের কাছে এ ব্যাপারে তথ্য নেই।

খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এস এম সোয়াইব খান বলেন, পুণ্যার্থীদের হয়রানী করার কোন সুযোগ নেই। তবে এ জাতীয় কোন ঘটনা হয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হবে। এ দিকে গত বছর একটি টহল টিম রান্না করা অবস্থায় হরিণের মাংসসহ একটি ট্রলার আটক করে। পরে ৯০ হাজার টাকার বিনিময়ে সেই ট্রলার ছেড়ে দেয়া হয় বলে জানা গেছে। মাঠ পর্যায়ে এ রকম অনেক অনিয়ম হলেও জনবল সংকট ও মোবাইল সংযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন থাকায় সঠিক প্রতিকার কম হচ্ছে। যে কারণে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। এই সুযোগে প্রকৃত অপরাধীরা রেহাই পাচ্ছে।

সার্বিক বিষয় নিয়ে বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক আমিরুল হুসাইন চৌধুরী বলেন, মাঠ পর্যায়ে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর খোঁজ নেয়া কঠিন। সকলকে নির্দেশনা দেয়া আছে মেলায় আগতদের সার্বিক জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করার। এর কোন ব্যত্যয় ঘটলে এবং সেটা প্রমাণ হলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

রাসমেলায় নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা, বাড়ছে দূষণ ঃ সুন্দরবনের দুবলার চরে প্রতি বছর নবেম্বরে রাস পূর্ণিমা উৎসব উপলক্ষে তিন দিনের মেলা বসে। এ মেলায় বিভিন্ন এলাকা থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী, পুরুষ ও দর্শনার্থীসহ লক্ষাধিক লোক আসে। অথচ এ এলাকায় এখনও গড়ে ওঠেনি স্যানিটেশন ব্যবস্থা। ফলে মানববর্জ্যসহ নানা বর্জ্য যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা হচ্ছে। এতে পানি ও পরিবেশ দূষণ বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন খুলনার নাগরিক ও পরিবেশ কর্মীরা।

পরিবেশবাদীদের মতে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে হলে স্যানিটেশনের এ ধরনের ছোট ছোট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকেও মাথায় রাখতে হবে। এ বিষয়গুলো স্বল্প মেয়াদে বা আপাতত ক্ষতিকর মনে না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এর ক্ষতির প্রভাব ব্যাপক হতে পারে।

খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, দুবলার চরে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে জেলেরা অবস্থান নেন। তবে, সংখ্যা খুবই কম থাকে। আর রাসমেলা উপলক্ষে সেখানে লক্ষাধিক লোকের আগমন ঘটে। ফলে রান্নাসহ নানা বজ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। মানববর্জ্যও যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে। যার সুদূর প্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পানি ও পরিবেশের ওপর। এ বিষয়টি সমাধানের জন্য নাগরিক নেতারা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং এ বছরই সুষ্ঠু স্যানিটেশন ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে খুলনা থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে দুবলা চর যেতে একদিন সময় লাগে। এ জন্য লঞ্চ বা বড় যানবাহন ভাড়া করা প্রয়োজন। আর লক্ষাধিক লোকের জন্য প্রয়োজনীয় স্যানিটেশন ব্যবস্থা করার জন্য অর্থও প্রয়োজন। সব মিলিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এ পদক্ষেপ নেয়া কঠিন। দূরত্বের কারণেও এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ