শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মগ জলদস্যু হার্মাদ এবং সুবেদার শায়েস্তা খাঁ

সাজজাদ হোসাইন খান : ইতালিয়ান পর্যটক নিকোলা মনুচি বাংলায় এসেছিলেন ষোলশ তেষট্টি সালে। তিনি আরাকানি ‘মগ’দের স্বভাব বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন তারা দস্যু, বর্বর, তষ্কর। তারা প্রদেশের সর্বত্র গমন করত, নর-নারী, শিশু, সোনা-রূপা অপহরণ করত। তারা মায়ের কোল থেকে শিশুদের ছিনিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করত। পূর্ববাংলা ভ্রমণকালে মগ জলদস্যুদের বর্বরতা প্রত্যক্ষ করে মনুচি তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে মন্তব্য করেছেন, এরা সমগ্র মানব নামের অযোগ্য। প্রায় পাঁচশ’ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও মগ হার্মাদদের স্বভাবের এতটুকু বদল হয়নি। বরং আরো দুর্বিনীত, আরো অভব্য হয়ে উঠে এসেছে। সাম্প্রতিককালে বার্মার মগ সেনারা যেভাবে আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, মনুচি জীবিত থাকলে মগদের চরিত্র বা স্বভাব নিয়ে মন্তব্যে আর কি কি শব্দ ব্যবহার করতেন কে জানে। হিং¯্র জন্তু-জানোয়ারের সাথে তুলনা করতে দ্বিধান্বিত হতেন না হয়তো বা। অবশ্য এদের কার্যকলাপ এখন জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারদের স্বভাবেরও নিচে নেমে যাচ্ছে। হত্যা-লুণ্ঠন এবং অসভ্যতা এতটাই প্রসারিত হয়েছে ওরা তাদের পূর্ব-পুরুষদের আচরণকেও যেন অতিক্রম করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। অত্যাচার অবিচারে মগরা যেনো এখন আরো বেপরোওয়া। আরাকান বর্তমানের রাখাইন রাজ্যে তাদের ধ্বংসযজ্ঞে তামাম বিশ্ব বিবেকই যেন আতংকিত, বিস্মিত, বিমূঢ়।

অবিবেচনা অসভ্যতা এবং অসত্য প্রচারের প্রায় দু’মাস অতিক্রান্ত হতে চললেও নির্যাতন-নিপীড়নের অবসানের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উজাড় হচ্ছে জনপদ, জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম। পুরুষ নারী বৃদ্ধ শিশু কেউই রেহাই পাচ্ছে না মগ সেনাদের বীভৎষতা থেকে। বিচার বিবেচনা যেনো এখানে গৌণ একটি বিষয়। আরাকান রাজ্যকে জনশূন্য করতে হবে এটিই বর্তমানে মূল উদ্দেশ্য বার্মার সেনাবাহিনী এবং সু চির। সে লক্ষ্যেই যেন তাদের অগ্রযাত্রা। বার্মা সেনাবাহিনীর বাধাহীন এই অগ্রযাত্রার খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রাণভয়ে লাখ লাখ আরাকানী (রোহিঙ্গা) বাংলাভাষীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে, ঘটছে। বিশেষ করে সে এলাকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতিই মগদের ঈর্ষার অনল নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। আরাকানে যাদের বসবাস প্রায় হাজার বছর আগ থেকে। যদিও মগরা প্রচার করছে রোহিঙ্গারা এ অঞ্চলের নয় ওরা বাংলাদেশী। এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য সু চির প্রশাসন প্রায়শই তুলে আনে। যেটি ইতিহাসসিদ্ধ নয়। বর্তমানের ঝামেলাটিও সৃষ্টি করেছে বিশ্বকে এমনি একটি কৌশলকে সামনে এনে। আরাকান বরাবরই ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য, দু একবার হাত বদল হলেও। ইংরেজ আমলেই আরাকান পরিচয়হীন হয়, নিঃস্ব হয়। এরপর থেকেই তাদের ভাগ্য বিরম্বনার দিন শুরু।

আরাকানে মুসলিমরা বসতি গাড়ে হাজার বছর আগ থেকেই। মুসলিম বণিকগণ এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আসতো। তাদেরই কেউ কেউ স্থায়ীভাবেই রয়ে যায়। লাগোয়া সীমান্ত হওয়ায় বাংলাদেশের চাটগাঁও-কক্সবাজার থেকেও বিপুলসংখ্যক লোক সে সময় আরাকানে পাড়ি জমিয়েছে রুজিরোজগারের আশায়। তাদেরই বংশধররা শত শত বছর থেকে সে অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। তাছাড়া মোগল আমলে আরাকানের বিশাল একটি অংশ বাংলাদেশের সাথেই যুক্ত ছিল। বার শতকের শেষ দিকে সোনারগাঁওয়ের বিখ্যাত প-িত শিক্ষাবিদ শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা আরাকানে মুসলিম বসতি বিস্তারে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। তাছাড়া আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা হতো। বাংলা সাহিত্যের একটা সোনালী অধ্যায় আরাকান রাজসভাকে ঘিরেই তৈরি হয়েছিল। আরাকানের মন্ত্রিসভা এবং প্রশাসনেও ছিল বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষী মুসলমান। মধ্যযুগের মহাকবি সৈয়দ আলাউল আরাকান রাজসভায়ই কাব্য চর্চা করতেন। তাই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বর্তমানে যারা রাখাইন রাজ্যে বসবাস করছেন তারা সবাই তৎকালীন জনগোষ্ঠীরই সন্তান-সন্ততি। রাখাইন রাজ্যের ভূমিপুত্ররাই এখন ভূমিহারা এ কেমন অবিচার। বর্তমান মগ প্রশাসন ঘোষণা দিচ্ছে রাখাইনের রোহিঙ্গারা বার্মার নাগরিক নয়। কিন্তু ইতিহাস তো এর বিপরীত ভাষ্যই ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণায় মগ সেনাবাহিনী সু চি গংরা কর্ণপাত করছে না। বা করার প্রয়োজন অনুভবও করছে না। এই প্রয়োজন অনুভব করানোর ব্যাপারেও বিশ্ব বিবেক এবং আমরা তেমন কোনো শক্ত পদক্ষেপ নিতে পেরেছি বলে তো মনে হয় না। যুক্তিকে যারা গ্রাহ্যের মধ্যে আনতে অস্বীকার করে তাদের ব্যাপারে ভিন্ন মনোভঙ্গি আনাটাই তো জরুরি। এই জরুরি বিষয়টি যতদিন পর্যন্ত অনুভব না হবে ততদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গা নির্যাতনে যবনিকাপাত আসবে কিনা এ ব্যাপারে চিন্তার অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। হঠাৎ করেই বার্মার মনে হলো রোহিঙ্গা মুসলিমরা তাদের নাগরিক নয়। যদিও তারা কিছুদিন আগেও নাগরিক বলে বিবেচ্য হতো, পার্লামেন্টেও প্রতিনিধি ছিল। এখন ভিন্ন সুর ভিন্ন চেহারা। বর্তমানের চেহারা আর অতীতের মগ জলদস্যুদের চেহারা যেন অভিন্ন-অবিকল। ঔদ্ধত্যেরও একটা সীমা থাকে, তাদের বুঝি সেটিও নেই। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সমঝোতার এবং সহযোগিতার প্রস্তাব নিয়ে বার্মায় গেলেন, বৈঠককালীন সময়ও মগ সেনারা রাখাইনে জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ রাখেনি। মানুষ নিধন এবং বিতারণেও রাশ টানেনি। স্বভাবের কতটা বিকৃতি ঘটলে এমন আচরণ চেহারায় উৎকটভাবে প্রকাশ পায়- তা হয়তো বলাইবাহুল্য। তাই আলাপ-আলোচনা বা বন্ধুত্ব-সৌহার্দ্যে কতটা ফলোদয় হবে এ থেকে উপলব্ধি করার বোধহয় সময় এসে গেছে।

এরিমধ্যে বিপুলসংখ্যক বিদেশী নাগরিক ক’দিন আগেও যারা বার্মার নাগরিক ছিল প্রাণভয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। গত দু’মাস থেকে এরা এখানে অবস্থান করছে। মানবিক কারণে এদেরকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই বিপুল জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে অসম্ভব একটি কর্মযজ্ঞ। এমতাবস্থায় বিশ্ব জনগোষ্ঠী হয়তো সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে। ইতিমধ্যে করছেও কেউ কেউ। কিন্তু ক’দিন। শেষমেষতো এ বোঝা বাংলাদেশের ঘাড়কেই বেদনাবিধুর করে তুলবে। যতই দিন যাচ্ছে ততটাই স্পষ্ট হচ্ছে আমরা বন্ধুদের উষ্ণ স্পর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। যে সুযোগে প্রতিবেশী বার্মা বা মিয়ানমার বাংলাদেশকে রক্তচক্ষু প্রদর্শনে সাহসী হয়ে উঠছে। ওরা আমাদের আকাশসীমা লংঘন করে বার বার, সীমান্তে ঝামেলা করে, আমরা এসবের সাহসী কোনো জবাব দিতে দ্বিধাবোধ করি। একসময় মগ-হার্মাদদের অত্যাচার দস্যুতায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল বাংলার জনপদ। পানিপথেও মগ জলদুস্যুদের আতঙ্কে অস্থির থাকতে হতো বাণিজ্যিক নৌযান বণিকদের। ইতালীয়ান পর্যটক মনুচিই কেবল নয় তখনকার বাংলাতে ভ্রমণে আসা আরো অনেক পর্যটকই মগ জলদস্যুদের স্বভাবের এমন বর্ণনাই রেখেছেন তাদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে। শত শত বছর অতিক্রান্ত হলেও বার্মার মগদের চরিত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে তো মনে হয় না। সাম্প্রতিককালে মগ সেনারা এর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

শায়েস্তা খাঁ যখন ভাটি বাংলার সুবেদার। মগ জলদস্যু এবং হার্মাদদের অত্যাচার তখন তুঙ্গে। গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে ছাড়খার করে দিতো। এক অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করেছিল মগরা। মগদের আতঙ্কে আতঙ্কিত থাকতো মানুষজন। অবশেষে মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ মগ হার্মাদদের নিপীড়ন থেকে বাংলার জনগণকে উদ্ধার করেছিলেন। মগ পর্তুগীজদের শক্তিমত্তা সমূলে বিনাশ করেছিলেন। ইদানীং যেভাবে মগ-উত্তরসূরীদের ঔদ্ধত্য সীমার বাইরে চলে আসতে চাচ্ছে এমতাবস্থায় তো নতুন কোনো শায়েস্তা খাঁর অপেক্ষা ব্যতিরেকে আর কোনো গত্যন্তর দেখছি না। তবে যুক্তির পথই হলো মসৃণ এবং সুখকর, যদি এ যুক্তি প্রতিপক্ষ গ্রাহ্যের মধ্যে আনতে দ্বিধা না করে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ