শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ফেনীর সরকারী-বেসরকারী ভবনে নাজুক অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা

* ২৭টি ভবন ব্যতিত গুরুত্বপূর্ণ অনেক ভবনের নেই ফায়ার সার্ভিস ছাড়পত্র
* বহুতল ভবনের বেইজমেন্ট ফ্লোরে চলছে ঝুঁকিপূর্ণ হোটেল-রেস্তোঁরার ব্যবসা
* নেই জরুরী বহির্গমন পথ, এসেম্বলি পয়েন্ট, এলার্মিং সিস্টেম
* অল্প সংখ্যক ভবনে রয়েছে ফায়ার এস্টিংগুইশার, নেই তদারকি
* ঝুঁকিতে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ
এম এ হায়দার, ফেনী সংবাদদাতা: ফেনী শহরের প্রধান প্রধান সরকারী-বেসরকারী ও বহুতল সহ সহ¯্রাধিক ভবনে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন ব্যবস্থা অত্যন্ত ঢিলেঢালা। সরেজমিন তথ্য সংগ্রহে বেরিয়ে আসে গুরুত্বপূর্ণ ভবন মালিক ও কর্তৃপক্ষের দায়সারা ব্যবস্থাপনার নানা চিত্র। অভিযোগ রয়েছে, অর্পিত দায়িত্ব পালনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অবহেলার। সচেতনতার অভাব রয়েছে বাড়ী মালিক, বসবাসকারী ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অফিসের কর্তাব্যক্তিদের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বহুতল ভবনের সংজ্ঞায় না পড়লেও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা জজ আদালত ভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, ফেনী সরকারী কলেজ, জেলা পরিষদ ভবন, জেলা রেকর্ড রুম ও আধুনিক সদর হাসপাতালসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারী স্থাপনায় আগুন নেভানোর জন্য নেই পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা। আছে শুধু কিছু এস্টিংগুইশার (সিলিন্ডার)। তাও আবার তদারকির অভাবে থেকেও না থাকার মতো অবস্থা। সরকারী ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, এসব ভবনে অগ্নি নির্বাপনের জন্য রক্ষিত এস্টিংগুইশার মেয়াদ হারিয়েছে কয়েক বছর আগেই। এভাবেই অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে অগ্নি নির্বাপনে ম্যানুয়েল এ সিস্টেমও।
বাংলাদেশ ইমারত নির্মান বিধিমালা (বিএনবিসি) অনুযায়ী, ৬ তলা ও ততোধিক বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচিত হবে। বিভিন্ন ভবনে ঘুরে দেখা গেছে, ভবন নির্মানের সময় এসব ভবনের বেশির ভাগেরই অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা মাথায় রাখা হয়নি, কেনা হয়নি কোন সরঞ্জামও। অগ্নিকান্ডের মুহুর্তে দ্রুত বের হওয়ার জন্য নেই কোন জরুরী বহির্গমন পথ (ইমার্জেন্সি এক্সিট ওয়ে)। নেই এসেম্বলি পয়েন্ট (সুরক্ষিত কক্ষ), এলার্মিং সিস্টেম ও স্মোক ডিটেক্টর । আবার বেশিরভাগ ভবনে নেই ম্যানুয়েলি ব্যবস্থাও।
এস্টিংগুইশার সম্পর্কে এক ব্যবসায়ী এ প্রতিবেদককে বলেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহৃত স্ট্রিংকলার মেশিন, হাইড্রেন মেশিন ও পানি ছাড়া এস্টিংগুইশার হল ছোটখাট আগুন নেভানোর এক ম্যানুয়েল ব্যবস্থার নাম। এটি বড় ধরণের আগুন নেভানোর সক্ষমতা নেই। সাধারণত ৩ ধরণের এস্টিংগুইশার রয়েছে। যেমন, তৈলাক্ত আগুনে ব্যবহৃত হয় ফোম আল্ট্র্যামারিন। যার মূল্য কেজি ৭০/৮০ টাকা। বিদ্যুৎ দ্বারা সৃষ্ট আগুন ও মেশিনারীতে লাগা আগুনে ব্যবহৃত হবে (যেমন কম্পিউটারে) কার্বন ডাই-অক্সাইড। এটির দাম ১০০/১২০ টাকায় ও কাগজ, বাঁশ ও কাঠের অগ্নিকান্ডে ড্রাই ক্যামিকেল পাউডার ব্যবহার করতে হয়। পাউডার কেজিপ্রতি ১৩০/১৫০ টাকায় পাওয়া যায়। তিনি জানান, এস্টিংগুইশারে ব্যবহৃত উপাদান যেমন- ফোম, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও ড্রাই ক্যামিকেল পাউডারের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। মেয়াদ পেরিয়ে গেলে এস্টিংগুইশার পুশের মাধ্যমে আগুন নেভানো শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে অসম্ভব। অথচ মেয়াদ হারিয়ে বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সামান্য মূল্যের এস্টিংগুইশার উপাদান পরিবর্তন করেনা বেসরকারী ভবন মালিক এমনকি সরকারি অফিসগুলোতেও। এতে করে অগ্নিকান্ডের হাত থেকে সুরক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে ঝুঁকি বেড়ে যায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে পুরো দায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন কর্তৃপক্ষের। কেননা ভবনে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন ব্যবস্থা, ফায়ার সার্ভিস লাইসেন্স প্রদান, এস্টিংগুইশারে থাকা মেয়াদ, ভবন সমূহে ফায়ার ফাইটিং ফ্লোর প্ল্যানসহ সামগ্রিক বিষয় দেখার দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যার হাউজ ইন্সপেক্টরের। কিন্তু তাদের তদারকি ও ভবন সংশ্লিষ্টদের সচেতনতার অভাবে ফেনী শহরের অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন ব্যবস্থা খুবই নাজুক।
ফায়ার সার্ভিস স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ফেনী শহরের শুধুমাত্র ২৭টি ভবন ব্যতিত কোন ভবনেরই বসবাস ও ব্যবহারের অনুমতি নেই। এ ২৭টি ভবন ব্যতিত কোন বহুতল ভবন মালিকই ফায়ার সার্ভিসের পূর্ববর্তী ফায়ার ফাইটিং ফ্লোর ও অগ্নি প্রতিরোধ প্ল্যান এবং পরবর্তী পর্যায়ের বসবাস ও ব্যবহার ছাড়পত্র নেয়নি। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ফাহমিদা হক বসবাস ও ব্যবহারের লক্ষ্যে পূণ: ছাড়পত্র গ্রহণ না করার দায়ে এসএসকে সড়কের করিম টাওয়ার কর্তৃপক্ষকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করেছে।
এছাড়া বহুতল ভবনের ছাড়পত্র না নিয়েই দিব্যি ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করে আসছেন আল কেমী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আবার অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা নেই তৎসংলগ্ন আল বারাকাসহ শত শত ভবনের। সূত্রটি জানায়, যে যার ইচ্ছেমত ভবন নির্মান আর ব্যবহার করে যাচ্ছে। এতেকরে ফেনী শহরের ৩১ হাজার পরিবারের লাখ লাখ মানুষ প্রতি মুহুর্তেই অরক্ষিত অবস্থায় জীবন যাপন করে আসছে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে আরো জানা গেছে, বানিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে ৩০ ও আবাসিক ভবনের জন্য ২৫ ফুট রাস্তা থাকার শর্ত দেয়া হলেও ইমারত বিধিমালা না মেনেই সংশ্লিষ্টরা ভবন নির্মান করে আসছে। অনুমতি না নিয়ে ভবন নির্মান কিভাবে সম্ভব এমন প্রশ্নে ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রতিবেদন ফায়ার সার্ভিসের হেড কোয়ার্টারে সুপারিশ আকারে প্রেরণ করি; অনুমোদনের দায়িত্ব আমাদের নয়। তদারকির দায়িত্বতো আপনাদের এমন প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের আধুনিকায়ন ও আমার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে হয়তো অনেক ভবন নির্মান হয়ে থাকতে পারে।
এসময় তিনি অপর্যাপ্ত জনবল ও প্রশিক্ষণের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমাদের রয়েছে প্রথম শ্রেণির ফায়ার স্টেশন, ৬ হাজার ৮শ লিটারের একটি পানিবাহী পরিবহন, একটি দ্বিতীয় কল গাড়ী, ১টি তৃতীয় কল গাড়ী, একটি এ্যাম্বুলেন্স ও চতুর্থ কলের একটি টহল গাড়ী। টহল গাড়ীটি সকাল ৭ টা থেকে রাত সাড়ে ৮ টা পর্যন্ত হাইওয়েতে টহলরত অবস্থায় থাকে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ