শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

পথ হারিয়েছে নীতিভ্রষ্ট রাজনীতি

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। রায়ে মন্তব্য করা হয়, রাজনীতির নামে সংঘবদ্ধ অপরাধে যুক্ত হচ্ছেন কিছু তরুণ, তাঁদের কারণে পুরো ছাত্র রাজনীতি কলঙ্কিত হচ্ছে। হাইকোর্টের রায়ে ছাত্রনেতাদের ছাত্রাবাসের প্রশাসন চালানো, জোর করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে নিয়ে যাওয়ার মত প্রবণতারও সমালোচনা করা হয়েছে। তথাকথিত কিছু রাজনীতিবিদ নিজেদের স্বার্থে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়। আদালত আরও বলেছেন, টাকাওয়ালা এবং ক্ষমতাশালী লোকেরা এক ধরনের দায়মুক্তি ভোগ করেন। এক্ষেত্রে পুলিশ এবং অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা, চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরি করে অপরাধীদের সহায়তা করেন। রায়ে ছাত্ররাজনীতি, রাজনীতিবিদ, পুলিশ ও বিভিন্ন পেশার কর্মকর্তাদের তৎপরতা প্রসঙ্গে যে চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে নাগরিকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বিশ্বজিৎ হত্যার রায় আমরা পেয়েছি, কিন্তু বিশ্বজিতকে আর পাওয়া যাবে না। বিশ্বজিৎ কাজ করতেন পুরানো ঢাকায় দরজির দোকানে। কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তিনি, খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সংগ্রামটুকুই করছিলেন। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর সকালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে কাজে যাওয়ার সময় বাহাদুর শাহ পার্ক সংলগ্ন এলাকায় হতভাগ্য এই তরুণকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের একদল কর্মী। রক্তাক্ত শরীরের বিশ্বজিতকে মারধর ও কোপানোর ছবি দেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়। শুরু থেকেই বিশ্বজিৎ হত্যা নিয়ে গণমাধ্যম যতখানি সরব ছিল, ততখানি তৎপর ছিল না পুলিশ। বিশ্বজিৎ হত্যাতদন্তে নানা অসংগতিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিচারিক আদালতের রায়ে ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এর পর মামলা হাইকোর্টে আসে। গত ৬ আগস্ট হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই ৮ জনের মধ্যে ২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন, ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন ও ২ জনকে খালাস দেয়। উল্লেখ্য যে, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ওই ২ জন এখনও পলাতক রয়েছেন।
একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, ছাত্ররাজনীতির অপচর্চার কারণেই বিশ্বজিতকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ছাত্র রাজনীতির নামে হানাহানি ও সংঘাত নিয়ে বিভিন্ন সময় সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু অনাকাক্সিক্ষত কর্মকা-গুলো বন্ধ হয়নি বরং বেড়েই চলছে। প্রথম আলোর এক হিসেবে দেখা যায়, ২০০৯ সাল থেকে গত ৮ বছর ১০ মাসে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই অন্তত ৬১ জন নিহত হয়েছেন। টেন্ডার, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব কারণে দেশের অন্তত ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদে বন্ধ ছিল। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ছাত্ররাজনীতি ঐতিহ্যবিচ্যুত হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন শক্তি কাজ করে থাকে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন হতে হবে। তাঁর মতে, ছাত্ররাজনীতি থাকতে হবে; তবে সেটা প্রথাগতভাবেই থাকতে হবে, তা নয়। সঠিক নেতৃত্বকে কিভাবে সামনে আনা যায় তা নিয়েও ভাবতে হবে। তাঁর বক্তব্য আদালতের রায় এবং অভিজ্ঞজনের মতামতের ভিত্তিতে উপলব্ধি করা যায়, কি কি কারণে ছাত্ররাজনীতি পথভ্রষ্ট হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে ছাত্ররাজনীতিকে কাক্সিক্ষত পথে কারা ফিরিয়ে আনতে পারেন সে বিষয়টিও স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যথা ব্যক্তিরা যথাদায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন কী?
শুধু ছাত্র রাজনীতি নয়, বড়দের রাজনীতিও পথ হারিয়েছে। বিশ্বরাজনীতির অবস্থা আরো ভয়াবহ এবং নীতিভ্রষ্ট। বর্তমান সভ্যতায় ন্যায় ও মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর আকাল চলছে, এ কথা আমরা জানি। বিশ্বনেতাদের আচার-আচরণে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে ঘটনাপ্রবাহে বিভিন্ন প্রসঙ্গে ন্যায় ও মানবীয় গুণাবলীর প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়টিও কারো কারো বক্তব্যে ও আচরণে লক্ষ্য করা যায়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এশিয়া সফরের শুরুতেই জাপান গমন করেন। শনিবার জাপানে অবতরণের পর রাজধানী টোকিওর পশ্চিমে ইউকোতা বিমানঘাঁটিতে যান ট্রাম্প। সেখানে তিনি ইঙ্গিতে উত্তর কোরিয়ার প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, অতীতে যারা যুক্তরাষ্ট্রকে অবমূল্যায়ন করেছে তাদের জন্য এর ফলাফল সুখকর হয়নি। কোনো ব্যক্তি, সৈরশাসক কিংবা কোনো শাসন-কাঠামোর উচিত হবে না যুক্তরাষ্ট্রকে অবমূল্যায়ন করা। জাপানের পরই ট্রাম্পের দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার কথা। এমন সময় উত্তর কোরিয়ার প্রতি ট্রাম্পের হুঁশিয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তেমন চিত্র লক্ষ্য করা যায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইনের সম্পর্কটা তেমন উষ্ণ নয়। উত্তর কোরিয়া নিয়ে ট্রাম্পের বাগাড়ম্বরকে খুব ভালোভাবে নেয়নি দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান প্রশাসন। বরং উত্তর কোরিয়ার  সঙ্গে আলোচনা বাড়াতে চান দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট। আমরা মনে করি, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের এমন দৃষ্টিভঙ্গিতে শুভবুদ্ধির পরিচয় রয়েছে। এখন দেখার বিষয় হলো, উত্তর কোরিয়ার  নেতা যুদ্ধংদেহী মনোভাব পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে শান্তির পথে আসেন কিনা। আসলে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ চায়, পৃথিবীর শাসকরা যেন যুদ্ধংদেহী মনোভাব পরিহার করে ন্যায়ের চেতনায় আলোচনার মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধান করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মানুষের এমন আকাক্সক্ষার বিষয়টি কতটা উপলব্ধি করেন সেটাও দেখার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অবশ্য সঠিক বিষয় উপলব্ধির জন্য মানবীয় গুণাবলীরও প্রয়োজন রয়েছে।
শাসক হিসেবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চালচিত্র তেমন পছন্দ নয় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ-এরও। ‘দ্য লাস্ট রিপাবলিকানস’ নামক গ্রন্থের লেখক মার্ক কে অ্যান্ডেগ্রোভের সাথে সাক্ষাৎকারে সিনিয়র বুশ বলেন, ‘আমি তাঁকে (ট্রাম্প) পছন্দ করি না। তাঁর সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না, তবে এতটুকু জানি, তিনি দাম্ভিক।’ বিবিসির খবরে বলা হয়, বইটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বোঝাতে ‘ব্লোহার্ড’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন সিনিয়র বুশ। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান অনুযায়ী, শব্দটি দাম্ভিকতায় বোগা কিংবা তর্জন-গর্জন করা লোকজনকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। আরো মজার তথ্য হলো, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাবেক এই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট (সিনিয়র বুশ) ভোট দিয়েছিলেন ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে। এমন ঘটনায় উপলব্ধি করা যায়, মৌলিক মানবীয় গুণাবলী খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমান সভ্যতার শাসকরা বিষয়টি উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ