শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সেরা কোচের হঠাৎ বিদায়

নাজমুল ইসলাম জুয়েল : বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ নিয়ে আরেক পশলা ঝড় বয়ে গেল। কোন প্রকার নোটিশ না দিয়েই গত ১০ নভেম্বর পদত্যাগ করেন চন্দিকা হাতুরুসিংহে। অথচ ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত তার জাতীয় দলের কোচ থাকার কথা ছিল। সাফল্যের বিবেচনায় বাংলাদেশের সেরা কোচ হিসেবে তার নাম থাকবে সবাই উপরে। টেষ্ট ও ওয়ানডে দু’জায়গাতেই উন্নতির ছাপ স্পষ্ট হয় তার মেয়াদে। এবারের চলে যাওয়ার ঘটনাটি একটু ভিন্নতা পেয়েছিল। বাংলাদেশে ঘটনা ঘটার পর অনেক কিছুই জানা যায়। বোঝা যায়। এমনকি তার অনেক ডালপালাও গজায়। এ যেমন চন্দিকা হাতুরুসিংহের পদত্যাগ ইস্যু। ক’দিন যাবত বিপিএল’র ব্যাট ও বলের জমজমাট লড়াই ছাপিয়েও জাতীয় দলের কোচ হাতুরুসিংহের পদত্যাগ ইস্যুই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে দেশের ক্রিকেটে। যত আলাপ আলোচনা, জল্পনা-কল্পনা ও গুঞ্জন- সবই বাংলাদেশ জাতীয় দলের এই কোচকে নিয়ে। এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে, শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত হাতুরু পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন বিসিবিতে। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন আনুষ্ঠানিকভাবেই জানিয়েছেন তার পদত্যাগ পত্র পাঠানোর কথা। তবে হাতুরু উপাখ্যান শেষ কি-না? তা জানাননি বোর্ড প্রেসিডেন্ট। বরং বোর্ড থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, ‘চন্দিকা হাতুরুসিংহেকে বাংলাদেশে আসতে বলা হয়েছে। বিসিবি সিইও নিজামউদ্দীন চৌধুরী সুজন তার সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাকে বাংলাদেশে আসার কথাও বলেছেন।’ আগেরদিনই বিসিবি মুখপাত্র, মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস সংবাদ মাধ্যমকে এমন খবরই জানিয়েছেন। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘হাতুরুর সঙ্গে বিসিবি সিইও’র কথা হয়েছে। তাকে বাংলাদেশে আসতে বলা হয়েছে। হাতুরু আসলে কথা বার্তা হবে। তারপর বলা যাবে হাতুরু উপাখ্যান সত্যি সত্যিই শেষ হচ্ছে কি না, নাকি তিনি থাকবেন। আর তিনি যদি না আসেন, তাহলে ধরে নেবো, হাতুরু সত্যিই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছেন বা দিতে চাচ্ছেন।’ জালাল ইউনুস এমন কথা বলার ২৪ ঘণ্টা না যেতেই মিলেছে আসল খবর। সেই আসল খবর হলো, ‘সত্যি সত্যি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে চন্ডিকা হাতুরুসিংহের যাবতীয় সম্পর্ক শেষ। এ লঙ্কান আর বাংলাদেশ জাতীয় দলকে কোচিং করাবেন না। বিসিবি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কথা এখনও জানানো হয়নি। তবে ভেতরের খবর হলো, হাতুরুসিংহে আর বাংলাদেশে আসবেন না। কোচিংও করাবেন না।’ বিসিবি এ খবর এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে না জানালেও একদম ভিতরের খবর, ‘হাতুরু ইস্যু শেষ। তিনি আর বাংলাদেশকে কোচিং করাচ্ছেন না- এটা এখন পুরোপুরি নিশ্চিত।’ এদিকে হাতুরুসিংহে যে বাংলাদেশের সঙ্গে সব রকম ক্রিকেটীয় সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলছেন, তার আরও একটা প্রমাণ মিলেছে। হাতুরু তার টুইটার ওয়াল থেকে বাংলাদেশ চ্যাপ্টার তুলে ফেলেছেন। বিসিবি’র একাধিক দায়িত্বশীল কর্তার কাছে হাতুরু ইস্যু সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে, তারা কেউ কোনরকম আনুষ্ঠানিক মন্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে বিষয়টি এখন বোর্ড পরিচালকদের প্রায় সবাই জেনে গেছেন।
তাঁর বাংলাদেশ অধ্যায় শেষই বলতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিসিবিও তাঁর আশা ছেড়েই দিয়েছে। বাংলাদেশে আর আসছেন না চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। হাথুরুর সাম্প্রতিক পদক্ষেপ সেটাই পরিষ্কার করে দিয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশ অধ্যায়টাই মুছে ফেলেছেন এই শ্রীলঙ্কান কোচ। তিনি আসছেন না এই পদক্ষেপ এটাই শুধু নির্দেশ করে না, তার ওয়াল থেকে বাংলাদেশ অধ্যায় মুছে দেওয়াটা প্রচ- ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ। দক্ষিণ আফিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের পর হুট করে পদত্যাগ করেন হাথুরু। তাকে বুঝিয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে দক্ষিণ আফ্রিকায় উড়ে গিয়েছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। গত ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ দল ঢাকায় ফিরলেও তিনি চলে যান অস্ট্রেলিয়াতে, যেখানে তার পরিবার বসবাস করছে। এরপর বিসিবি তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাতে প্রথমদিকে সাড়া দেননি কোচ। তবে গত কয়েকদিন আগে বিসিবি’র যোগাযোগে সাড়া দিয়েছেন তিনি। কোচ থাকেন বা না থাকেন একবার ঢাকায় আসার প্রতিশ্রুতি দেন বিসিবিকে। ঢাকায় আসলে আরেকবার তাকে রাজি করানোর চেষ্টা করা হবে বলে মনে করা হচ্ছিলো। কিন্তু হাথুরুর সর্বশেষ পদক্ষেপে সেই সম্ভাবনাও একরকম শেষ হয়ে গেল। টুইটার প্রোফাইল থেকে বাংলাদেশ অধ্যায় মুছে ফেলার অর্থ পরিষ্কার। তিনি আর বাংলাদেশে আসছেন না। তিনি যে প্রায় তিন বছর বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন সেটাও অস্বীকার করেছেন এর মাধ্যমে। ক’দিন আগেও তার প্রোফাইলে লেখা ছিল, চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, হেড কোচ বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল এবং সাবেক শ্রীলঙ্কান টেস্ট ও ওয়ানডে খেলোয়াড়। এখন বাংলাদেশ অধ্যায় মুছে তার নামের পর লেখা হয়েছে, পেশাদার ক্রিকেট কোচ ও সাবেক শ্রীলঙ্কান টেস্ট ও ওয়ানডে খেলোয়াড়। তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারে বাংলাদেশই প্রথম ও একমাত্র জাতীয় দল। এখানে তিনি ছিলেন বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেতনভুক্ত কোচ। তার অধীনে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলে একটি দল। অথচ এমন গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে মুছে দিয়েছেন তার প্রোফাইল থেকে। এটা যে তিনি প্রচন্ড ক্ষোভ থেকে করেছেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে এখন কোচ নিয়োগে নিয়ে কোন তাড়া নেই বিসিবির। ‘তিনি মেইলের উত্তর দিচ্ছেন না। ফোনও বন্ধ রেখেছেন। আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করছি। তার সঙ্গে সরাসরি কথা না হওয়া পর্যন্ত আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব না।’ বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের এমন কথার একদিন পরই চন্ডিকা হাথুরুসিংহের নাগাল পাওয়া গেছে। টাইগারদের কোচের আসন ছাড়তে পদত্যাগপত্র দিয়ে রাখা এই লংকানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে পেরেছেন বিসিবি’র প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন। তবে ফলপ্রসূ কোনো সমাধান-বাণী শোনাতে পারেননি তিনি। প্রধান কোচ হিসেবে হাথুরুসিংহের জায়গায় তাই বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তবে তাড়াহুড়া করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থাটি। একই সঙ্গে চলছে হাথুরুকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও। ভালো কোচের সন্ধান পাওয়া কষ্টসাধ্য সেটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে জালাল বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা যেন একটা ভালো কোচ নিয়ে আসতে পারি। তবে ভালো কোচ পাওয়া এত সহজ নয়। হঠাৎ করেই আপনি কোনো ভালো কোচ পেয়ে যাবেন না। এখন ভালো মানের ও প্রফেশনাল কোচদের অনেক চাহিদা। যদি আমরা তিন মাসের মধ্যে সে রকম কোনো কোচ না পাই, তাহলে কোনো স্থানীয় কোচ দিয়ে ব্যবস্থা নিব।’ স্থানীয় কোচদের মধ্যে আলোচনায় আছে খালেদ মাহমুদ সুজনের নাম। জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়কও জানিয়েছেন, কোচ হওয়ার প্রস্তাব পেলে সেটা সানন্দে গ্রহণ করবেন। দায়িত্বটাকে নিতে নিতে চান চ্যালেঞ্জ হিসেবে।
এদিকে এখনই শ্রীলংকা দলে কবে যোগ দিতে পারেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। লংকান ওপেনার দিমুথ করুণারত্নের মন্তব্যে যেন তেমনটাই প্রকাশ পেয়েছে। পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে এ মুহূর্তে ভারতে অবস্থান করছে শ্রীলংকা দল। বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট একাদশের বিপক্ষে একটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলছে তারা। প্রস্তুতি ম্যাচের একপর্যায়ে হাথুরুসিংহে প্রসঙ্গে কথা বলেন করুণারত্নে। জানান, শ্রীলংকা দলের কোচ হিসেবে হাথুরুকে দেখতে চান। ২৯ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান বলেন, ‘আমিও মিডিয়াতে শুনেছি হাথুরুসিংহে আমাদের কোচ হতে যাচ্ছেন। এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তাই এটা নিয়ে নিশ্চিত করে বলার সময় হয়নি। এটা বোর্ডের সিদ্ধান্ত, আমরা সে সিদ্ধান্ত শোনার অপেক্ষায় আছি। অবশ্যই তিনি জাতীয় দলের কোচ হলে আমাদের জন্য ভালো হবে। কারণ বর্তমান দলের অনেক ক্রিকেটারের সঙ্গেই তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমি জুনিয়র লেভেলে তার অধীনে ছিলাম। এটা আমাদের জন্য ভালো খবর। তবে তিনি আসবেন কিনা, সেটা এখনো জানি না।’ গত জুনে গ্রাহাম ফোর্ড শ্রীলংকার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর থেকেই লংকান বোর্ড (এসএলসি) হাথুরুর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তাকে রাজি করাতে কুমার সাঙ্গাকারার দ্বারস্থও নাকি হয়েছিল এসএলসি। শোনা যাচ্ছে, আগামী দু-এক মাসের মধ্যে নতুন কোচের নাম ঘোষণা করবে শ্রীলংকা। হাথুরুসিংহে রাজি হলে সম্ভবত এ সময়ের আগেই নতুন কোচ পেয়ে যাবেন করুণারত্নেরা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সফরই হবে লংকান কোচ হিসেবে হাথুরুর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেছেন হাথুরু।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ