বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

সামাজিক অবক্ষয়-মেরুদন্ডে পক্ষাঘাত

অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান : প্রকৃতি আর মানুষের নিবিড় মিলনেই গড়ে ওঠে সমাজ। ক্ষয়, হ্রাস, ধ্বংস, বিলোপ, বিনাশ, ঘুণেধরা ও পচনের মত লক্ষণকেই অবক্ষয় হিসেবে অবহিত করা যায়। সামাজিক অবক্ষয় বলতে সমাজ উন্নয়ন ও সভ্যতার বিপরীতে অসামাজিকতা, অসভ্যতা, অনৈতিকতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াকে বুঝায়।
মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য এই অপূর্ব অমিয়বাণী ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই গঠিত হয় সমাজ ব্যবস্থা। যাতে করে সমাজের মানুষ আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানবতাবাদী ও আলোকিত মানুষ হতে পারে। নম্রতা, ভদ্রতা, বিনয়ী, উদারতা, সহমর্মিতা, সৌজন্যবোধ, মমত্ববোধ, শিষ্টাচার, সত্যবাদী, কর্তব্যপরায়ণতা, সাম্যবাদী, ধর্মবাদী, মৌলবাদী, দর্শনবাদী, সৎ ও কর্মজীবী আদর্শ মানুষ হতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সামাজিক অবক্ষয় : আজকের বিশ্ব সমাজ  ব্যবস্থার, বাস্তবতা  ভিন্ন প্রকৃতির। সমগ্র বিশ্ব আজ ধর্মকে রাজনীতি থেকে কৌশলে নির্বাসিত করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপি অমৌলবাদী নামধারী ধার্মিকরাই রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কর্তৃত্ব নেতৃত্ব দিচ্ছে। অপরদিকে উপরোক্ত মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন ধর্মপ্রেমী মৌলবাদীরা পণবন্দি হয়ে পড়েছে তাদের গভীর ষড়যন্ত্র আর কুটকৌশলী কুটনীতিতে।
ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবিক মূল্যবোধের আজ দারুন সংকট। সমাজের সর্বস্তরে নৈতিক আধ্যাত্মিক, দার্শনিক ও ধার্মিক চিন্তা চেতনার পরিবর্তে আস্থাহীনতা, অমানবিকতা, অসভ্যতার মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলেছে। কৃত্রিমতা, চাতুরতা, স্বার্থপরতা, তিক্ততা, হীনমন্যতা, ইর্ষা, ক্রোধ, অহমিকা, দাম্ভিকতা, অনাচার অবিচার, অকৃতজ্ঞতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা, যৌনাচার,অবিচার, অমিতাচার, নৃশংসতা, বারবনিতা, বহুগামিতা, যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই,সাম্প্রদায়িক, উগ্রবাদী, বিশেষ করে নৃশংসতা, ও  বিকৃতিকর  যৌনাচার ,প্রবণতা  বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। আত্মহত্যা, এসিড  নিক্ষেপের মতো  নাশকতা, বিদেশী অপসংস্কৃতি ও বিকৃতি যৌনাচারের ছবি প্রদর্শনী, মাদক দ্রব্যের সয়লাব, যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধির  নানাবিধ ক্যামিক্যাল মিশ্রিত  ওষুধ সেবন ও ব্যবহারের  সুযোগ ও সন্ত্রাস বৃদ্ধির ফলে বিশ^ব্যাপি দৃশ্যত সুখ বাড়লেও স্বস্তি, শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে।
বাংলাদেশে সামাজিক অবক্ষয় ঃ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়ে যে সব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, সে সব কারণ তো আছেই, সেই সাথে আরো কিছু বিশেষ কারণে বাংলাদেশে সামাজিক অবক্ষয় এখন চরম পর্যায়ে। হঠাৎ করেই লোক সমাজে সামাজিক  অপরাধের পরিমাণ পূর্বের  তুলনায় বহু গুনে বেড়ে গেছে।  গত ৯ বছরে  ৫৮ জন সাংবাদিক খুন, ২০১৬ সালের প্রথম ৮ মাসে সারা দেশে ৩০৬১ খুনের ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে ৬২ টি খুনের কারণ ছিল সামাজিক ও পারিবারিক। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন পারিবারিক, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের কারণে ঘরে ঘরে তৈরী হচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়ের ক্ষেত্র। পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্রুত বাড়ছে অপরাধ ও অস্থিরতা। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই,রাহাজানি, অত্যাচার, ষড়যন্ত্র, খুন, গুম, অপহরণ, পণ আদায়, ঠকবাজী, প্রতারণা, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, যৌতুক, মাদক, বাল্যবিবাহ, চোরাচালানী, মজুদখোরী, ব্লু-ফ্লিম,পর্ণসাহিত্য, বিজাতীয়, আকাশ সংস্কৃতির  অবাধচর্চা, ফেসবুক, অমিতাচার, পরকীয়া প্রেম, ঝগড়া, কলহ,বিরোধ, গোপনে অবৈধ মেলামেশা, ইভটিজিং, এসিড  নিক্ষেপ, নারী ও শিশু ধর্ষণ, শিশু খাদ্যে  বিষক্রিয়া,  চাঁদাবাজী, বোমাবাজী,  বিদুৎতের  লোডসেডিং, কোচিং ব্যবসা, সাইবার ক্রাইম, সাইবার, মসজিদ, মন্দির,উপাসনালয়ে হামলা, হত্যা, দান বাক্স ও জুতা চুরি ইত্যাদি অনৈতিক কর্মকান্ড সামাজিক নিরাপদ পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত  করছে।
বৈশি^ক কারণে ও প্রকৃতিক  বিপর্যয়, ও ভারসাম্যতা হারানোর  প্রভাব সমাজে অবক্ষয়ের মাত্রা বৃদ্ধিকরে থাকে  যেমন- নদ-নদী  খাল-বিল  অবৈধভাবে দখল করে  সেখানে স্থাপনা নির্মাণ  অতিবৃষ্টি  অনাবৃষ্টি, ভয়াবহ বন্যা , খরা,  উত্তাপ বেড়ে গিয়ে হিমালয় ও মরু দেশের বরফ গলে সমুদ্রের উচ্চতার মাত্রা বেড়ে  যাওয়া ইত্যাদি। সম্প্রতি জরিপে দেখা যায় বিশ্বে জলবায়ু ঝুঁকিতে বাংলাদেশ  ষষ্ঠস্থানে  অবস্থান। শব্দদূষণ, মাটিদূষণ, পানিদূষণ,  বায়ূদূষণ, বজ্যদূষণ রাসায়নিকদূষণ  সমাজ  জীবন যাত্রার প্রভাব ফেলছে ফলে নানা বিধি সংকট সৃষ্টিতে সামাজিক অবক্ষয়  নেমে  আসছে। সেই সাথে অবাধে বৃক্ষ নিধন, বনাঞ্চল  উজার করা, পাহাড় কাটা, আবাদি জমিতে ফ্লাটবাড়ী, কল কারখানা নির্মাণ, ইটের ভাটা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, হাস-মুরগী গরু ছাগলের  খামারের বর্জ্যদ্রব্য সামাজিক পরিবেশকে কলুষিত করছে। শুধু শহরে নয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পানের দোকান, সেলুনের দোকান, চায়ের দোকান ও হোটেলগুলোতে বিদেশী অশ্লীল ছবির সি.ডি, ডি.ভি.ডি প্রদর্শিত হচ্ছে অবাধে। পাশাপাশি স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতে দামী দামী মোবাইল সেট অবাধে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেই সাথে যৌন উত্তেজনাকর টেবলেট ও তরল ওষুধ বিক্রির ও ব্যবহারের মাত্রা চরমভাবে বেড়ে যাওয়ায় সমাজে ঘটছে অনাচার ও অমিতাচার। আগে গায়- গ্রামের মানুষ ঘরের জানালা খুলে ঘুমাতো এখন জানালা খুলে তো দূরের কথা বন্ধে রেখেও দুশ্চিন্তায় রাত পার করতে হয়।  দেশে জনস্বাস্থ্যের অবক্ষয় ঃ আয়তনের তুলনায় দেশে জনসংখ্যা আধিক্যতা দিন দিন বেড়েই চলেছে, তদুপরি বিদেশীদের আগমনে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। দেশে অনিরাপদ খাদ্য ঝুঁকিতে ষোল কোটি মানুষ। অনিরাপদ খাদ্যের সয়লাব মূলত গণহত্যার সামিল। অনিরাপদ খাদ্যের ঝুঁকির কারণে সামাজিক ভাবে মানুষ অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি লোক বয়োবৃদ্ধ, বেকার সংখ্যা তিন কোটি, মানুষিক রোগির সংখ্যা দেড় কোটি। দেশে প্রতিবছর ৫.২% শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, পুষ্টিহীনতার কারণে ৯২ লাখ শিশু রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। ৫% সিরোসিস বা ক্যান্সারে মৃত্যু বরণ করছে। ধুমপানের কারণে দেশের ৮০ লাখ মানুষ ফুসফুস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ সহ নানাবিধ রোগাক্রান্ত হচ্ছে। সেই সাথে কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ ধোঁয়া ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া, নালা- নর্দমা, ড্রেন ও শহর উপকূলীয় নদীর পানি দূষণ, অপরিচ্ছন্নতা, মশা- মাছির উপদ্রব, জীবানুযুক্ত পানীয়, খাদ্য সমাজ জীবনে এবং পরিবেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া মারাত্মক অবক্ষয় বিষয়টি ত্বরান্বিত করছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশ দপ্তরের তথ্যানুযায়ী দেশে হত্যাকান্ডের ৪০% সংঘটিত হচ্ছে পারিবারিক কলহের কারণে। দেশে প্রতিদিন খুন হচ্ছে ১৪-১৫ জন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সূত্রে জানা যায় খোদ রাজধানীতে প্রতি বছর পাঁচ হাজার সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে। এর ৭৫% স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাক দেয়া হচ্ছে। মানসিক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন এর পেছনে থেলো সিন্ড্রম এর প্রভাব রয়েছে। সম্প্রতি আইন ও শালিস কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয় গত ৬ মাসে আইন শৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু বরণ করে ৯০ জন।
সামাজিক অবক্ষয়ের আরও কতিপয় কারণ ঃ দেশে জননিরাপত্তাঝুঁকি, জন্মহারঝুঁকি, বিদেশি আগমনঝুঁকি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, শিক্ষাঝুঁকি, খাদ্যঝুঁকি, বাসস্থানঝুঁকি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ঝুঁকি, বায়ু দূষণঝুঁকি সহ নানা রকম ঝুঁকির কারণে সামাজিক পর্যায়ে ব্যাপক দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। সেই সাথে সন্ত্রাসঝুঁকি, জঙ্গীঝুঁকি, অবৈধ অস্ত্রঝুঁকি, এসিডঝুঁকি সামাজিক জীবনকে মারাত্মক ভাবে ব্যাহত করছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, আইন শৃংখলার অবনতি, ক্রসফায়ারে হত্যাকান্ড, বিচার বহির্ভুত খুন, বিচারের নামে প্রহসন, বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, এমপি মন্ত্রীদের উচ্চ বিলাসবহুল বাজেট, গণমাধ্যমগুলোকে আইনী পেষণে রাখা।
চলমান বহুল প্রচারিত পত্রিকা ও টেলিভিশনে সম্প্রচারে নিষিদ্ধকরণ দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে দারুন হতাশা নেমে আসার কারণে সমাজ জীবনে নীরবে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিদিন ভোরে খবরের কাগজে ও সার্বক্ষণিক ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোতে আমরা কি দেখছি? সমাজ উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বিপরীতে সমাজ ব্যবস্থায় চরম অবনতি ও অবক্ষয়ের খবরা খবরের পরিমাণ বেশি। দেশের নানাস্থানে ঘটে যাওয়া পৈশাচিক, আতঙ্কিত, নিষ্ঠুর, লোমহর্ষক, বীভৎস সংবাদগুলো জাতির বিবেককে মারাত্মক ভাবে আহত করছে। চলমান গণতন্ত্রের নমুনা, মানবতা ও মানবাধিকারের  হালচিত্র দেখে মনে হয় আমরা এ কোন দেশে বাস করছি? বর্তমানে কি হচ্ছে এদেশে? এটিই কি সোনার বাংলা? স্বাধীন বাংলা? জয় বাংলা?
পিতা- মাতা কর্তৃক সন্তান ও সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতা হত্যার মত ন্যক্কার ও কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটছে এদেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরী থেকে চলন্ত ট্রেন, চলন্ত বাসে আগামি দিনের কর্ণধার শিক্ষার্থীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হত্যার পর লাশের উপর নৃত্য করা হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের, শিশুদের ও নারীদের  উপর চলছে নির্যাতনের মহড়া। সর্বত্র  ভীতি, আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা আর অনিরাপত্তার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছি আমরা। হতাশ হয়ে পড়ছে সুশীল সমাজ, সাদা মনের মানুষ, সমাজ বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, অভিজ্ঞ মহল, মানবতাবাদী, পরিবেশবাদী আর সেই সাথে এদেশের নাগরিকরা। কারণ একটির পর একটি বীভৎস ঘটনা ঘটেই চলেছে। ম্লান করে দিচ্ছে অতীতের ভীভৎস রেকর্ড। সব মিলিয়ে গোটা সমাজ ব্যবস্থায় নেমে এসেছে এক চরম হতাশা, অমানিশার অন্ধকার ও ক্লান্তিকাল।
এ অবক্ষয় থেকে মুক্তির উপায় বের করার জন্য উচ্চতর গবেষণা জরিপ ও পর্যবেক্ষণ করার এখনি সময়। কারণ কি কি কারণে সামাজিক অবক্ষয় ঘটছে? কারা এর জন্য দায়ী? কি উপায়ে এর প্রতিকার সম্ভব? এ বিষয়ে প্রথমে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের এগিয়ে আসতে হবে, সেই সাথে এগিয়ে আসতে হবে দেশের সর্বস্তরের গণমানুষকে। তাহলে হয়তো সামাজিক অবক্ষয়ের মাত্রা কমিয়ে এদেশকে মহাদুর্যোগ থেকে বাঁচানো সম্ভব। তা নাহলে দেশের ভবিষ্যৎ পরিনতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ সুশাসন হবে বিলুপ্ত।
-জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক গবেষক।
ই-মেইলঃ [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ