শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

শ্রীলংকার ঔপন্যাসিক অনুক অরুদপ্রগাশম

 

হোসেন মাহমুদ : শ্রীলংকার লেখক অনুক অরুদপ্রগাশম ২০১৭ সালের ডিএসসি প্রাইজ ফর সাউথ এশিয়ান লিটারেচার  পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ দি স্টোরি অব এ ব্রিফ ম্যারেজ’ (একটি স্বল্পস্থায়ী বিয়ের গল্প) উপন্যাসের জন্য তিনি এ পুরস্কারে ভূষিত হন।  ঢাকার বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত ১৬ থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত তিনদিন ব্যাপী ঢাকা লিটারেচার ফেস্টিভ্যালের শেষ দিনে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। পরপর চার বছর ধরে ভারতীয় লেখকরা এ পুরস্কার লাভ করার পর এবার শ্রীলংকার আরেকজন লেখক এ পুরস্কার পেলেন।   

দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের যে কোনো জাতিগোষ্ঠি বা জাতিভুক্ত লেখকের দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি, রাজনীতি, ইতিহাস বা জনগণ বিষয়ক লেখার জন্য প্রতি বছর এ পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে। ইতোমধ্যেই এটি একটি বিশিষ্ট সাহিত্য পুরস্কারের মর্যাদা লাভ করেছে। এ পুরস্কারের অর্থমূল্য ২৫ হাজার ডলার। ভারতের সুরিনা নারুলা ও মানহাদ নারুলা ২০১০ সালে এ পুরস্কার প্রবর্তন করেন। ২০১১ সাল থেকে নিয়মিত ভাবে এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত যারা পুরস্কার পেয়েছেন তারা হচ্ছেন এইচ.এম. নাকভি -‘হোম বয়’ (পাকিস্তান)-২০১১, শেহান করুণাতিলকা- ‘চায়নাম্যান’ (শ্রীলংকা)-২০১২, জিত থাইল- ‘নারকোপোলিস’ (ভারত)-২০১৩, সাইরাস মিস্ত্রি-‘ক্রনিকল অব এ কর্পস বিয়ারার’ (ভারত)-২০১৪, ঝুম্পা লাহিড়ি-‘দি লোল্যান্ড’ (ভারত)-২০১৫ ও অনুরাধা রায়-‘স্লিপিং অন জুপিটার’ (ভারত)-২০১৬।    

‘ দি স্টোরি অব এ ব্রিফ ম্যারেজ’ তরুণ লেখক অনুকের লেখা প্রথম উপন্যাস।  রণাঙ্গনে শ্রীলংকার সেনাবাহিনী ও তামিল টাইগারদের মধ্যে আটকাপড়া এক তামিল তরুণের হৃদয়স্পর্শী কাহিনীর ভিত্তিতে উপন্যাসটি রচিত।  পুরস্কার গ্রহণের পর বক্তব্য রাখতে গিয়ে অনুক বলেন, এ উপন্যাসটি প্রকাশের জন্য শ্রীলংকার অনেক প্রকাশকের দ্বারস্থ হয়েছি। কিন্তু বইটি প্রকাশে তারা খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। পরে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গ্রান্টা প্রকাশ করেছে। এই পুরস্কার শ্রীলংকাবাসীদের উৎসর্গ করলাম। পুরস্কারের অর্থ শ্রীলংকার উত্তরাঞ্চলে কর্মরত সংস্থাগুলো, রোহিঙ্গা মুসলমান ও মানবতার সেবায় নিবেদিত কাশ্মীরি সংগঠনগুলোকে দান করব।  

তিনি আরো বলেন, লেখকরা রেস কার ড্রাইভার নয়। আমরা কোনো ধরনের রেসে নেই। আমরা সবাই নীরবে কাজ করছি। আমরা লিখি, কারণ আমাদের বিশ^াস যে এমন কিছু জিনিস আছে যা কথায় বলা যায় না। এ পুরস্কার আমার কাছে তত আনন্দময় নয়, কারণ আমার এ উপন্যাসটি এমন বিষয়ে যা অত্যন্ত বিষাদময়।

জুরি কমিটির সভাপতি ভারতের নারীবাদী লেখিকা ঋতু মেনন অনুকের উপন্যাসকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস আখ্যায়িত করে বলেন, এ উপন্যসে বেশ কিছু ব্যতিক্রমধর্মী গুণ রয়েছে। তিনি বলেন, লেখকরা কোনো এলাকা বা দেশের সীমার মধ্যে আবদ্ধ নন।  ডিএসসি পুরস্কারের জন্য ২০১৭ সালের জন্য উপস্থাপিত সাহিত্য কর্মগুলো একই সাথে ছিল চ্যালেঞ্জিং ও বিপুল আনন্দের খোরাক। আমাদের দীর্ঘ তালিকায় থাকা ১৩টি উপন্যাসের সবগুলোই ছিল অসাধারণ গল্প সমন্বিত। তাদের প্রত্যেকের কণ্ঠই সুস্পষ্ট ভাবে দক্ষিণ এশীয়। 

পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা অন্য চারটি উপন্যাস হচ্ছে অরবিন্দ আদিগার ‘সিলেকশন ডে’, অঞ্জলি জোসেফের ‘ দি লিভিং’, করণ মহাজনের ‘ দি এসোসিয়েশন অব স্মল বম্বস’ ও স্টিফেন অলটারের ‘ ইন দি জঙ্গলস অব নাইট’। অনুক অরুদপ্রগাশমের ‘ দি স্টোরি অব এ ব্রিফ ম্যারেজ’ ডিলান টমাস পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকায় ছিল। ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল পত্রিকা এটিকে ২০১৬ সালের সেরা ১০টি উপন্যাসের তালিকাভুক্ত করে। এনপিআর, দি বস্টন গ্লোব, বাজফিড, দি গ্লোব, দি মেইল ও এনট্রোপি ম্যাগাজিন উন্যাসটিকে ২০১৬ সালের অন্যতম সেরা উপন্যাস বলে আখ্যায়িত করে। দি ফিনান্সিয়াল টাইমস-এর সমালোাচনায় বলা হয়, এটি উপন্যাসের মিনি মাস্টারপিস।  

অনুক অরুদপ্রগাশমের জন্ম শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে ১৯৮৯ সালে। ২০০৬ সালে পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ২০১০ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ^দ্যিালয় থেকে ¯œাতক হন।  তিনি এখন নিউইয়র্কে বাস ও কলম্বিয়া বিশ^বিদ্যালয়ে দর্শনে পিএইচডি করছেন।  প্রায়ই শ্রীলংকা ও ভারত ভ্রমণে আসেন। ২৮ বছর বয়স্ক এ লেখক ইংরেজি ও তামিল ভাষায় লিখে থাকেন। ‘দি স্টোরি অব এ ব্রিফ ম্যারেজ’ তার প্রথম ও একমাত্র উপন্যাস। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এটি প্রকাশিত হয়। ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান, ডাচ ও চেক ভাষায় উপন্যাসটি অনূদিত হয়েছে বা হওয়ার পথে। 

১৯৮৩-২০০৯ সাল পর্যন্ত তামিল গেরিলাদের সাথে শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর লড়াই চলে। এ যুদ্ধ শেষ হয় ২০০৯ সালের মে মাসে। শেষের দেড় বছরে তামিল গেরিলারা কোণঠাসা হয়ে পড়তে শুরু করে।  সে লড়াইয়ের পটভূমিতে রচিত এ উপন্যাসের দুই প্রধান চরিত্র দীনেশ ও গঙ্গা। সে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, অমানবিক পরিস্থিতির  মধ্যে সদ্য কৈশোর পেরনো তরুণ দীনেশ চারপাশে স্বজনহারাদের কান্না, শ্র্যাপনেলে ক্ষত বিক্ষত লাশ, এক শিবির থেকে আরেক শিবিরে আশ্রয় খুঁজে ফেরা সব হারানো মানুষকে দেখে দেখে ক্লান্ত। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে অপরিসীম কষ্ট-যন্ত্রণায় নিষ্পিষ্ট দীনেশ ঘুমাতে পারে না।  এক পর্যায়ে আরো বহু বিপর্যস্ত মানুষের সাথে একটি শিবিরে আশ্রয় নেয় সে। এরই মধ্যে স্ত্রী ও পুত্রকে হারিয়ে একমাত্র সন্তান কিশোরী কন্যা গঙ্গাকে নিয়ে ভীষণ ভাবে বিপন্ন এক বৃদ্ধের সাথে পরিচয় হয় তার। তিনি যে করেই হোক, মেয়েকে বিয়ে দিতে চান দীনেশের সাথে। কারণ বিয়ে না হলে তামিল গেরিলারা তাকে নারী গেরিলা বাহিনীতে নিয়ে যাবে, নইলে  সে সরকারী সৈন্যদের ধর্ষণের শিকার হবে।  তার করুণ আকুতিতে প্রকৃতই বিপন্ন বোধ করে দীনেশ।  বিয়ে তো  আনন্দ, জীবনের সেরা উৎসব। এই ভয়াবহ অমানবিক পরিবেশে বিয়ে করা বা আনন্দ-উৎসবের প্রশ্নই আসে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানবিক আবেদনেরই জয় হয়।  খুব তড়িঘড়ি করে বিয়ে হয় তাদের।  নাম মাত্র বিয়ে। কিন্তু দীনেশ ও গঙ্গার জীবন প্রেম, ভালোবাসায় রঙিন হয়ে ওঠার আগেই নামে অনিবার্য ট্র্যাজেডির করুণ কালো ছায়া। তাদের অসম্পূর্ণ দাম্পত্য জীবনের করুণ পরিণতি তথা হাহাকার জাগানো বর্ণনা পাঠককে স্থবির করে। প্রচন্ড গোলাবর্ষণ, বারুদের গন্ধ, আগুন আর ধোঁয়ায় দিশেহারা অবস্থ্।া তার মধ্যে দীনেশ খুঁজে ফেরে গঙ্গাকে। পায় না। তবুও তন্ন তন্ন করে খোঁজে আর খোঁজে। অবশেষে সন্ধান মেলে তার।  গোলাবর্ষণের নিহত গঙ্গা পড়ে আছে Ñ‘ তার বাম চোখ আধা খোলা, ছিন্নভিন্ন ঠোঁটের ডান অংশ মাটিকে চুম্বন করছে।’ কোনো কোনো সমালোচক বলেছেন,  এ উপন্যাসে শ্রীলংকার তামিল জনগোষ্ঠির মর্যাদাহীনতা, ধ্বংস, মুত্যু, হাহাকার, বিপন্ন, বিধ্বস্ত অবস্থার যে ছবি ফুটে উঠেছে তাতে বহু তামিলের পক্ষেই এ উপন্যাস পড়া কঠিন।   

২০১১ সালের জুলাই বা আগস্ট থেকে তিনি উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন। শেষ করেন ২০১৪-র অক্টোবরে। এর ঘটনাকালের ব্যাপ্তি মাত্র ২৪ ঘণ্টা। ১৯৩ মুদ্রিত পৃষ্ঠার মধ্যে উপন্যাসটি শেষ হয়েছে। এ উপন্যাস লেখার জন্য তিনি তামিলদের সশস্ত্র লড়াইয়ের ২৬ বছরের ইতিহাস পড়েছেন, যুদ্ধের শেষ মাসগুলোর কথা ভেবেছেন, যে সব স্থানে যুদ্ধ হয়েছে সে সব স্থান ঘুরে দেখেছেন, বেঁচে যাওয়া লোকদের সাথে কথা বলেছেন,  দক্ষিণ ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোতে তাদের সাক্ষাতকার শুনেছেন, মনোচিকিৎসক ও গবেষকদের  নেয়া তাদের সাক্ষাতকার পড়েছেন এবং  সে সময়ের তোলা নানা ছবি ও ফুটেজ দেখেছেন। তিনি যুদ্ধের ইতিহাস লেখেননি, যুদ্ধকে উপন্যাসের পটভূমি করেছেন। ফিনান্সিয়াল টাইমস-এ প্রকাশিত  এ বইয়ের সমালোচনায় এটিকে যুদ্ধকালীন ভালোবাসার উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি আরেকটি উপন্যাস লেখায় হাত দিয়েছেন, এক-তৃতীয়াংশ লেখা হয়েছে। নাম ঠিক হয়নি। 

তিনি জানান, যে উপন্যাসটি পড়ে তিনি লেখক হতে উদ্বুদ্ধ হন সেটি হচ্ছে ‘ দি ম্যান উইদাউট কোয়ালিটিজ।’ ১৯৩০-এর দশকে অস্ট্রেলিয়ার লেখক রবার্ট মুসিল-এর লেখ্।া এটি তিন খন্ডে লেখা একটি অসমাপ্ত উপন্যাস, কিন্তু তার প্রিয়।  তার ভাষায়, আগে এ রকম উপন্যাস তিনি পড়েননি। 

তার প্রিয় লেখকদের একজন হলেন সোভিয়েত জামানার লেখক আন্দ্রেই প্লাতোনভ। তার লেখা একটি নভেলা ‘সোল’ নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। এটি তিনি কয়েকবার পড়েছেন। তার আরেকজন প্রিয় লেখক হলেন হাঙ্গেরির পিটার নাদাস। তার ‘এ বুক অব মেমোরিজ’ অনুকের খুব প্রিয়। তার আরেকটি প্রিয় বই স্যামুয়েল বেকেট-এর ‘দি আননেমেবল।’  নিজের উপন্যাস ‘দি স্টোরি অব এ ব্রিফ ম্যারেজ’ লেখার সময় এটি তিনি বহুবার পড়েছেন। 

নিজের জীবন সম্পর্কে তিনি বলেন, তিনি তামিল হলেও উত্তরের জাফনায় নয়, দক্ষিণের কলম্বোতে বেড়ে উঠেছেন। মধ্যবিত্ত, কিন্তু পরে বিত্তশালী হয়ে ওঠা পরিবারের সন্তান তিনি। তাই তামিল হলেও কোনো অসুবিধা হয়নি।  তাদের পরিবার এখন কলম্বোর এলিট শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।  তিনি শিক্ষা লাভ করেছেন ইংরেজি মাধ্যমে। তবে শেষের দিকের ৬-৭ বছর তামিল ভাষা শিখেছেন। তামিল ভাষায় কিছু কিছু লিখছেনও। এখন পর্যন্ত তিনি মূলত ইংরেজিতে লিখলেও এটি তার কাছে ঔপনিবেশিক ভাষা বলে মনে হয়। তিনি বলেন, শ্রীলংকা, ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার ইংরেজিভাষীদের আমি ঘৃণা করি। তামিল ভাষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শ্রীলংকা ও ভারতের বাইরে এ ভাষা পৃষ্ঠপোষকতা পায় না, এমনকি শ্রীলংকাতেও  তেমন নয়। আমি ইংরেজির পাশাপাশি তামিলেও লিখছি, তবে তা অন্যদের সাথে শেয়ার করতে বিব্রত বোধ করি। তবে শেষ পর্যন্ত আমার মাতৃভাষায় (তামিল) আমি সাহিত্য রচনা করব। এটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ