শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

খুলনা অঞ্চলে অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া

খুলনা অফিস : খুলনা অঞ্চলে ওষুধ নিয়ে রীতিমতো নজিরবিহীন নৈরাজ্য চলছে। অভিযানে মিলছে ভেজাল ওষুধ। নিষিদ্ধ ভারতীয় ওষুধ ছাড়াও সরকারি ওষুধও পাওয়া যাচ্ছে ফার্মেসীগুলোতে। দেশে তৈরি গুণ-মানহীন ফুড সাপ্লিমেন্টও বিদেশি স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। ওষুধ ফামের্সির পাশাপাশি অধিকাংশ হোমিও ফার্মেসিরই নেই ওষুধ বিক্রির অনুমোদন।
সম্প্রতি র‌্যাব-৬ ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। মূলত দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ প্রশাসনের উদাসীনতা, ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
খুলনার ড্রাগ সুপারের কার্যালয় সূত্র মতে, খুলনা জেলায় হোমিও ফামের্সি লাইসেন্সধারী রয়েছে ১৩৫টি। এর মধ্যে নগরীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত সংখ্যা ১১৩টি। আপাতত লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি ড্রাগ সুপার মাহমুদ হোসাইন বদলি হওয়ার পর গত ৯ আগস্ট মো. মাসুদুজ্জামান ড্রাগ সুপার হিসেবে খুলনায় দায়িত্ব পান। তিনি লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসিগুলো ও নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রি বন্ধে নগরী ও উপজেলাগুলোতে অভিযান পরিচালনা করেন। গত নবেম্বর মাসে নগরীর ৩টি ফামের্সিতে নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রির অভিযোগে জরিমানাও করেন। এরপরই তাকে প্রত্যাহার করা হয়। বর্তমানে খুলনা ড্রাগ সুপার হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন রেহান হাসান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ড্রাগ সুপার মো. মাসুদুজ্জামান উপজেলার মধ্যে কয়রা ও পাইকগাছায় নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রি বন্ধ ও লাইসেন্সবিহীন ওষুধ ফার্মেসিগুলোতে অভিযান পরিচালনা করেন। সেখানে কয়েকটি ফার্মেসিকে জরিমানা করেন। এরপরই নগরীর শান্তিধাম মোড় এলাকায় অভিযানে প্রায় ৩টি ফামের্সিকে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ৩৭ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এ সব কারণে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট (বিসিডিএস) খুলনা জেলা শাখার কিছু কর্মকর্তা বেসামাল হয়ে পড়েন। এরপরই ওই ড্রাগ সুপারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়।
জানা গেছে, উল্লিখিত হোমিও ফার্মেসি লাইসেন্স বাদে নগরী ও উপজেলাগুলোতে গড়ে উঠেছে হোমিও ফার্মেসি। এ সব লাইসেন্সবিহীন হোমিও ফামের্সিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা রেকটিফাইড স্পিরিট (আরএস) বিক্রি করছেন। এর ক্রেতা হচ্ছে মাদকসেবীরা।
খুলনা জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে রেকটিফাইড স্পিরিট (আরএস) হোমিও ফার্মেসিগুলোত ব্যবহার বা বিক্রির জন্য সংস্থার থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করতে হয়। বর্তমানে খুলনা জেলাতে মোট ৯টি হোমিও ফার্মের্সিতে আরএস লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি নবায়ন করা হয়। বাকি দুইটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় এর উপ-পরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, হোমিও ফার্মের্সিতে রেক্টিফাইড স্পিরিট (আরএস) বিক্রি ও ব্যবহারের জন্য যারা আমাদের থেকে লাইসেন্স নিয়েছেন, শুধুমাত্র তারাই বিক্রি ও ব্যবহার করতে পারবেন। যেসব ফার্মেসিগুলোতে লাইসেন্স নেই তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। এদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, জনবল সঙ্কট থাকার কারণে সবদিকে অভিযান পরিচালনা করতে বেগ পেতে হচ্ছে। তারপরেও তাদের টিম দিন-রাত অভিযান পরিচালনা করছেন।
জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আরাফাত উল আলম বলেন, সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এমন কোন কিছু উৎপাদন, ভেজাল ওষুধ বিক্রির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। সেক্ষেত্রে তিনি বলেন, এই সব বিষয়ে স্থানীয় সাধারণ জনগণসহ সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
খুলনা ড্রাগ সুপার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. রেহান হাসান বলেন, স্থানীয় খুলনার কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির (বিসিডিএস) কিছু কর্মকর্তা খুলনার ড্রাগ সুপার মো. মাসুদুজ্জামানের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই তিন সদস্য কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে তিনি কিছুই বলতে পারবেন না।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় ‘ক’ সার্কেলের পরিদর্শক মো. আহসান হাবিব বলেন, তার আওতাধীন নগরীতে ৩টি হোমিও ফার্মেসির রেকটিফাইড স্পিরিট (আরএস) লাইসেন্স আছে। যারা লাইসেন্স ব্যতীত আরএস বিক্রি বা ব্যবহার করবেন তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন (২২) গ ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে। ২ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৯-১০ বছর জেল হওয়ার পাশাপাশি জরিমানার বিধান রয়েছে।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) খুলনা জেলা শাখার সভাপতি এডভোকেট এনায়েত আলী বলেন, যারা ওই সব ভেজাল ওষুধ উৎপাদন করছেন তাদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেয়া উচিত। অনেক সময় এ ব্যবসার সাথে রাজনৈতিক প্রভাবও জড়িত। প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে অসহায়। যেসব ফার্মেসিীগুলো বিক্রি নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রি করছেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ফার্মেসিগুলো থেকে সাধারণ মানুষ ওষুধ কিনছেন। তারা জানেন না কোনটি ভেজাল আর কোনটি আসল। এ ব্যাপারে তিনি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান।
খুলনা জেলা শাখার বিসিডিএস (অবৈতনিক) সম্পাদক কবির উদ্দিন বাবলু বলেন, ড্রাগ সুপার মো. মাসুদুজ্জামান এর আচরণগত কারণে তার বিরুদ্ধে বিসিডিএস এর কিছু সদস্য অভিযোগ দিয়েছিলেন। অভিযানের কারণে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
উল্লেখ্য, গত ২২ নবেম্বর হেরাজ মার্কেটে র‌্যাব-৬ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম ৩ দফা অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ও ফিজিসিয়ান স্যাম্পল থাকার অপরাধে দুইটি ফার্মেসীকে জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর মধ্যে হেনা মেডিকেল হলকে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ থাকার অভিযোগে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক খুলনা জেলা শাখার বিসিডিএস (অবৈতনিক) সাবেক সম্পাদক এস এম আজিজুর রহমানের। এর আগে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য অধিদফতর, ওষুধ ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে নগরীর পাইকারী ওষুধের বাজার হেরাজ মার্কেটে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে খুলনা কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতির সভাপতিসহ ১৬ জন ব্যবসায়ীকে ১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া ২৯ নবেম্বর নগরীর খালাসী মাদরাসার সামনে খুলনায় ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতকরণের অভিযোগে হাফিজুর রহমান (৫০) নামের এক ব্যক্তিকে ৬ মাসের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
খুলনা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আরাফাতুল আলম ভোক্তা অধিকার আইনের আওতায় এই সাজা প্রদান করেন। ওই হোমিও ওষুধ ও ফুড সাপ্লিমেন্ট কোন ধরনের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা ছাড়াই ওষুধ তৈরি ও সেবন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ