শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

গোলাম মোস্তফার কবিতায় রাসুলপ্রেম

ড. এম এ সবুর : গোলাম মোস্তফা রাসুলপ্রেমিক কবি। ইসলাম-রাসুলপ্রেম তার সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তার কবিতা-গানের বেশির ভাগই রাসুলপ্রেমে উজ্জীবিত। মহানবী হযরত মুহম্মদ সা. এর সিরাত রচনায় তার কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়। তার রচিত বিশ্বনবী যেমন বাঙালি পাঠক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত তেমনি তার রচিত ‘ইয়া নবী সালাম আলাইকা’ কবিতাটি মুসলিম ঘরে ঘরে ও মিলাদ মাহফিলে বহুল পঠিত। তাছাড়া রাসুল সা. এর প্রশংসায় তার রচিত ‘নিখিলের চিরসুন্দর সৃষ্টি আমার মোহাম্মদ রাসুল’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদ রাসুল’ ইত্যাদি গান-কবিতা মুসলিম সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়। রাসুল সা. এর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে তার সাহিত্য জীবনের শুরুর দিকেই তিনি ‘হযরত মোহাম্মদ’ কবিতা রচনা করেন। এ কবিতায় তিনি হযরত মুহম্মদ সা. এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবের অন্ধকার অবস্থার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে রাসুল সা.কে সেই অন্ধকার বিদারক আখ্যা দিয়ে বলেন, 

এই ঘোর দুর্দিনে এলো কে গো বিশ্বে,

উজলিয়া দশদিশি, তরাইতে নিঃস্বে!

মুখে তার প্রেমবাণী, করুণা ও সাম্য, 

বিশ্বের মুক্তি ও কল্যাণ কাম্য।

প্রায় একই ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে তার ‘ফাতেহা-ই-দোআজদহম’ কবিতায়। এতে তিনি হযরত মুহম্মদ সা. এর জন্মদিনের বর্ণনা দিয়ে এবং তাঁকে স্বাগত জানিয়ে লিখেন, 

আমিনার গৃহে আজি বেহেশতের শোভা অনুপম।

দিকে দিকে উঠিতেছে নব ছন্দে বন্দনার গান

স্বাগতম! স্বাগতম! ধরণীর হে চিরকল্যাণ!

হরযত মুহম্মদ সা. শুধু মুসলিম কিংবা আরবদের জন্য নয় বরং বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত। তাই তাঁর জন্মোৎসব শুধু মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত নয় বরং বিশ্ববাসীর জাতীয় উৎসব। এ জন্য গোলাম মোস্তফা রাসুলের জন্মোৎসবে বিশ্বের সব মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, 

হে নিখিল ধরাবাসী! মুসলিমের লহ নিমন্ত্রণ,

এ উৎসব নহে শুধু আমাদের একান্ত কখন!

নাসারা-খৃষ্টান এসো, এসো বৌদ্ধÑচীন, 

মহামানবের এ যে পরিপূর্ণ উৎসবের দিন।

রাসুলপ্রেমিক কবির কল্পনায় হযরতের জন্মদিনে বিশ্ব প্রকৃতিতে এক মহোৎসবের আয়োজন হয়েছিল। ঐতিহাসিক-দালিলিক ভিত্তি না থাকলেও রাসুলভক্ত কবি মনে করেন তাঁর জন্মদিনে সারা বিশ্ব বেহেস্তের সুগন্ধিতে মোহিত হয়েছিল, সেদিন আকাশে-বাতাসেও মহাআনন্দের জয়গান ধ্বণিত হয়েছিল; ফিরেস্তাগণও চঞ্চল চিত্তে সে আনন্দে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। আর বেহেস্ত হতে বিশ্ব নারীনেত্রী বিবি হাজেরা এবং হযরত মরিয়ম আ. ধাই হয়ে এসেছিলেন। কবির ভাষায় রাসুলের জন্মদিনের দৃশ্য এ রকম, 

আকাশ দিয়েছে তার রক্ত রাঙা অরুণ-কিরণ,

বেহেশ্তের সুধা-গন্ধ আনিয়াছে মৃদু সমীরণ;

ছুটাছুটি করিতেছে দিকে দিকে ফেরেশ্তার দল, 

সারা চিত্ত তাহাদের আজিগো যে পুলকÑ চঞ্চল!

এসেছে ‘হাজেরা’ বিবি, আসিয়াছে বিবি ‘মরিয়ম’, 

আমিনার গৃহে আজি বেহেশতের শোভা অনুপম! 

মক্কার কুরাইশ বংশে হযরত মুহম্মদ সা.-এর জন্ম কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয় বরং আলকুরানের বর্ণনা মতে মহানবী সা. এর পূর্ব পুরুষ হযরত ইব্রাহীম ও তদীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল আ.- এর প্রার্থনার ফল এবং হযরত ঈসা আ.- এর সুসংবাদ।  আর গোলাম মোস্তফার ভাষায়, 

‘আমিনা’ মা-র কোলে খুদা রাখ্ল সে সওগাত

‘ইবরাহিমের দোয়া’ সে আর ‘ঈসার সুসংবাদ’।

হযরত মুহম্মদ সা. চল্লিশ বছর বয়সে মক্কার অদূরে হেরা পর্বতে নবুওয়াত লাভ করেন। এ সময় আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে হযরত জিব্রাইল আ. মুহম্মদ সা.-এর নিকট প্রথম অহি নিয়ে আসেন। মহানবী সা.-এর নবুওয়াত লাভ ইসলামের ইতিহাসে তথা বিশ্ব ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ এ নবুওয়াতের মাধ্যমে আধুনিক ইসলাম তথা মুহম্মদী শরিয়তের যাত্রা শুরু হয় এবং আইয়্যামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগের অবসানের সূত্রপাত ঘটে। নবুওয়াত লাভের ঐতিহাসিক এ ঘটনা কবি গোলাম মোস্তফা অনূদিত কাব্যগ্রন্থ মুসাদ্দাস-ই-হালী তে বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

চক্রবালে উঠ্ল যেন ভাগ্য-চাঁদিমা

দূর হ’ল সব বিশ্ব হতে আঁধার কালিমা!

ছুট্ল না তা কিরণ বটে অল্প কিছুক্ষণ, 

রেসালাতের চাঁদে ছিল মেঘের আবরণ; 

কালের স্রোতে চল্লিশ সাল গুজরে গেল যেইÑ

‘হেরা’- গিরির উর্ধ্বে সে চাঁদ উদয় হল সেই!

নবুওয়াত লাভের মাধ্যমে হযরত মুহম্মদ সা. আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহিদ প্রচারের জন্য আদিষ্ট হয়ে প্রথমে মক্কার কুরাইশ বংশের লোকদের কাছে তাওহিদ তুলে ধরেন। কিন্তু কুরাইশ নেতা আবু জহল ও তার অনুসারীরা রাসুলের দাওয়াত কবুল করেনি বরং বিরোধীতা করেছে। এমনকি তাওহিদ প্রচার বন্ধ করার লক্ষ্যে হযরত মুহম্মদ সা. কে হত্যার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল। আবু জহলের এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণা গোলাম মোস্তফার লিখনীর মাধ্যমে চিত্রিত হয়েছে এভাবে-

এ বিপুল সঙ্ঘ- মাঝে যে আজি দাঁড়াবে 

ছিন্ন করি আনিবারে মোহাম্মদ- শির, 

পঞ্চশত স্বর্ণমুদ্রা, শত উষ্ট্র সনে 

সানন্দ হৃদয়ে তারে দিব উপহার।

হযরত মুহম্মদ সা. আল্লাহর মনোনীত নবী ও রাসুল। তাঁর রক্ষক আল্লাহ নিজে। মানুষের কোন ষড়যন্ত্র ও অনিষ্ট তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। যে কুরাইশরা হযরতকে নির্যাতন-নিপীড়ন করে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য করেছিল এবং যারা রাসুল সা. কে হত্যা করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করেছিল, তাঁর বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ করেছিল; মাত্র আট বছর পর তারাই মক্কা বিজয়ের সময় মুহম্মদ সা.-এর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। যে উমর রা. মহানবীকে হত্যার জন্য মুক্ত তরবারী নিয়ে ছুটেছিল সে উমরই ইসলাম কবুল করে হযরতের একনিষ্ট সহচর, খলিফা হয়ে বিশ্বের বুকে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। ঐতিহাসিক এসব ঘটনা কবি তুলে ধরেছেন এভাবে, 

তারপর এলো আরব-মরুতে খোদার রসূল-নূরুন্নবী,

কোরেশ আসিল কতল করিতে বিশ্বের সেই আলোক-রবি

বলো কে মরিল? মোহাম্মদ? না আততায়ী সেই কোরেশ জাতি। 

ঘাতক শেষে যে রক্ষক হয়ে ধারায় রাখিল অতুল খ্যাতি।

হযরত মুহম্মদ সা. ছিলেন অসাধারণ গুণে গুণান্বি^ত একজন মহামানব। দুর্বলকে তিনি কখনও বঞ্চিত করেননি বরং সাহায্য করেছেন। পথ হারানো মানুষদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। ধনী-গরিব তার কাছে ছিল অভিন্ন। তাঁর কাছে মানুষের কোন ভেদাভেদ ছিল না; ছিল না সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ও বৈষম্য। ক্ষমা, দয়া-প্রেম ছিল তাঁর চরিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা হযরত মুহম্মদ সা. কে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি উত্তম চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত’ (আলকুরআনুল কারীম, ৬৮:৪)। মহানবী হযরত মুহম্মদ সা.-এর উত্তম চরিত্রের গুণাবলীকে গোলাম মোস্তফা কবিতায় চিত্রিত করেছেন এভাবে- 

দূর্বলে করে না সে নিপীড়ন হস্তে

আর্তেরে তুলে দেয় শুভাশীষ মস্তে, 

ভ্রান্তরে বলে দেয় মঙ্গলÑ পন্থা

রক্ষক, বীরÑ নহে ভক্ষক হন্তা।

 

ভিক্ষুকে টেনে নেয় আপনার বক্ষে,

ছোট-বড় ভেদ-জ্ঞান নাহি তার চোক্ষে,

মানুষের অকাতরে করে না সে ক্ষুদ্র,

হোক্ না সে বেদুইনÑ হোক্ না সে শূদ্র। 

রাসুল সা. ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তিনি ছিলেন প্রেম-ভালবাসা, ক্ষমা-ন্যায়ের মূর্তপ্রতীক। তাঁর প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল না কখনও। যারা তাঁকে অত্যাচার-নির্যাতনে জর্জরিত করেছিল তাদেরকেই উদার চিত্তে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাঁর ক্ষমার দৃষ্টান্ত অসংখ্য। মক্কা বিজয়ের দিনে সাধারণ ক্ষমা তারই উজ্জলতম নিদর্শন। মক্কার কাফির কুরাইশরা নিজেদের অপকর্মের কারণে মক্কা বিজয়ের দিনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। যে কোন শাস্তির জন্য তারা প্রস্তুতও ছিল। কিন্তু ক্ষমার অনুপম আর্দশ মহানবী হযরত মুহম্মদ সা. সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। কবি গোলাম মোস্তফা হযরতের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা উল্লেখ করে বলেন, 

কহিলেন নবী হাসি তখন-

“ভেবেছো ঠিকই বন্ধুগণ!

          কঠোর দন্ড হবে বিধান!

ধরো সে দ-- কহিনু সাফ্Ñ

সব অপরাধ আজিকে মাফ্,

          যাও সবে, দিনু মুক্তিদান।”

হযরত মুহম্মদ সা. ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী-রাসুল। সর্বোপরি তিনি একজন মানুষ; রাসুলপ্রেমে নিমজ্জিত ও প্রবল আবেগে আপ্লুত হয়েও সে কথা ভুলে যাননি কবি গোলাম মোস্তফা। তবে হযরত মুহম্মদ সা. মানুষ হলেও সাধারণ মানুষ নন, তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসুল; যা মহানবী সা. নিজেই বলেছেন। আর তা গোলাম মোস্তফার ভাষায়, 

আমার চেয়ে তোমরা ত কেউ বান্দাতে নও কম, 

তুমি-আমি এক- বরাবর দুর্বল ও অক্ষম। 

তোমায় আমায় প্রভেদ যেটুক নয়-ক সে অদ্ভুত

আমি শুধু বান্দা নহি- আমি খোদার দূত।

ইসলামের মূলমন্ত্র তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ। কিন্তু খৃষ্টানরা হযরত ঈসা আ. কে এবং ইহুদীরা হযরত ওযায়ের আ. কে আল্লাহর পুত্র বলে তাওহিদ পরিপন্থী বিশ্বাস করে। তাই হযরত মুহম্মদ সা. নিজেই তাঁর অনুসারীদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তারা যেন তাঁকে ইহুদী-খৃষ্টানদের মত আল্লাহর পুত্র বলে ধারণা না করে। রাসুল সা.-এর এই নিষেধাজ্ঞা গোলাম মোস্তফা অনূদিত কাব্যগ্রন্থ মুসাদ্দাস-ই-হালী তে উল্লেখ আছে এভাবে,

নাসারাদের মতন কেহই পড়ো না ধোঁকায়

খুদার বেটা বলে যেন পূজো না আমায়।

মহানবী সা. এর অনুপম আদর্শ ও নির্দেশনাবলী অনুসরণ করে মুসলিমরা এক সময় উন্নতি ও সম্মানের চরম শিখরে পৌঁছেছিল। কিন্ত বিশ শতকের মুসলিম সমাজ ছিল নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত। বিভিন্ন দেশে তারা ছিল দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ। অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও বিভিন্ন কুসংস্কারে অধঃপতিত ছিল মুসলিম সমাজ। বিশ শতকের মুসলমানদের এসব অধঃপতনের জন্য রাসূলের আদর্শচ্যুত হওয়ার বিষয় সমকালীন দার্শনিক ও কবি ইকবাল রচিত শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া কাব্যগ্রন্থে উল্লেখ আছে। আর তা গোলাম মোস্তফা অনুবাদ করেন এভাবে, 

কারা, বল, ত্যাগ করেছে আমার পাক রাসূলের পাক বিধান,

মুহম্মদের পয়গাম আর তোমাদের কারো নাই স্মরণ।

তবে হতাশ-নিরাশ হওয়ার কারণ নাই, মুসলমানগণ আবারও রাসুলের আদর্শ অনুসরণ করলে তাদের হৃত গৌরব ফিরে পাবে এবং বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। তাই কবি অধঃপতিত মুসলিমদেরকে রাসুলের ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ এবং তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, 

তুচ্ছরে আজ করগো উচ্চ- প্রেমে ও পূণ্যে কর মহৎ 

মুহম্মদের নামের আলোকে উজ্জ্বল কর সারা জগৎ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ