শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

শৃঙ্খলা বিধিমালায় খর্ব হয়েছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

সংগ্রাম রিপোর্ট : নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালার গেজেটে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। রাষ্ট্রপতির হাতে নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ন্যস্ত করা হলেও আদতে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবেন তারা। সরকারি কর্মচারীদের মতোই বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনেই হবে। ফলে বিচার বিভাগ পৃথককরণের উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত হবে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালার গেজেট প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় আইন বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা এই অভিমত দিয়েছেন।
যদিও সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দাবি করেছেন, বিচারকদের শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালার সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব হয়নি বরং বেড়েছে। সংবিধান মেনেই উচ্চ আদালতের সঙ্গে পরামর্শ নিয়ে নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়নি, ক্ষমতাও কমেনি।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও মাসদার হোসেন মামলার কৌঁসুলি ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেছেন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির আচরণ ও শৃঙ্খলাবিধিমালার গেজেট যে প্রক্রিয়ায় হয়েছে সেই প্রক্রিয়াটি সংবিধান বহির্ভূত। এই বিধিমালা করতে গিয়ে আইন মন্ত্রণালয় অধস্তন আদালতের বিচারকদের নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ করে ফেলেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের নিজ কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে তিনি এ কথা বলেন। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে আমীর-উল ইসলাম বলেন, সম্পূর্ণ বিষয়টি প্রেসিডেন্টের উপর ন্যস্ত। প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে আলোচনা করে এটি করবেন। কিন্তু এখানে যা করা হয়েছে তাতে আইন মন্ত্রণালয় বা আইনমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের ভূমিকা পালন করতে পারে না। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার যে বিষয়টি ছিল সেটা মন্ত্রণালয় থেকে দূরে রাখার জন্য, এখন সেই মন্ত্রণালয় চেপে বসেছে। এতে করে সাংবিধানিক যে প্রক্রিয়া সেটি ব্যাহত হয়েছে।
আমীর-উল ইসলাম বলেন, এই বিধি করতে গিয়ে আইন মন্ত্রণালয় বিচারকদের নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ করে ফেলেছে। জুডিশিয়াল সার্ভিসকে ১৩৩ অনুচ্ছেদের অধীনে নিয়ে গেছেন। ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই রুলস (বিধিমালা) করার কথা। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন কাজ সম্পাদন করার কথা এই রুলসে লেখা নেই। এখানে আইন মন্ত্রণালয় রুলস তৈরি করার ব্যাপারে ১৩৩ অনুচ্ছেদের বরাত দিয়ে যে রেফারেন্স দিচ্ছেন সেটা সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য। এতে করে আমার মনে হয় এই রুলসের গোড়াতেই গলদ রয়েছে। তিনি বলেন, অধস্তন আদালত একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সেই জায়গায় তাদেরকে যদি সরকারি কর্মচারী বিধি বিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেটি হবে দুর্ভাগ্যজনক এবং মাসদার হোসেন মামলার রায়ে পরিপন্থী।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও জরুরি অবস্থার তত্ত্বাধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেছেন, এই গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। অধস্তন আদালতের বিচারকদের সুপ্রিম কোর্টের অধীনেই থাকতে হবে। আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত না হলে বিচার বিভাগ পৃথককরণের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে না।
সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেছেন, শৃঙ্খলাবিধির প্রকাশিত গেজেটের মাধ্যমে মাসদার হোসেন মামলার মূল স্পিরিটকে খর্ব করা হয়েছে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি সংক্রান্ত এই গেজেটের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কফিনের ওপর শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়েছে। আমরা এই গেজেট বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, গেজেটে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। এই গেজেটের মাধ্যমে বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। উভয় বিভাগে একটি সেতুবন্ধ তৈরি হবে।
অরপদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সজিবালয়ে এক ব্রিফিংয় বলেছেন, বিচারকদের শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালা সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি। বরং বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশনাও অনুসরণ করা হয়েছে। আর এখনো নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না হওয়ায় সাংবিধানিক কোনো শূন্যতা হয়নি বলেও জানান তিনি।
আনিসুল বলেন, মন্ত্রী বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের আচরণবিধির সঙ্গে বিচারকদের আচরণবিধির বড় ধরনের পার্থক্য গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাধীনভাবে বিচারকাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে এই আচরণবিধি কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে আনিসুল বলেন, বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বিএনপির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো জানান, নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির।
১৯৮৯ সালে সরকার বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কিছু পদের বেতন স্কেল বৃদ্ধি করে। এতে অন্য ক্যাডারদের সঙ্গে অসঙ্গতি দেখা দেয়। তৎকালীন সরকার এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য ১৯৯৪ সালের ৮ জানুয়ারি জজ আদালতের বেতন স্কেল বাড়িয়ে দেয়। প্রশাসন ক্যাডারের আপত্তির মুখে সরকার ওই বেতন স্কেল স্থগিত করে।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মাসদার হোসেনসহ ৪৪১ জন বিচারক ১৯৯৫ সালে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ১৯৯৭ সালে হাইকোর্ট পাঁচ দফা সুপারিশসহ ওই মামলার রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে আপিল বিভাগ ১৯৯৯ সালে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার ঐতিহাসিক রায়টি দেন।
মাসদার হোসেন মামলার রায় ঘোষণার আট বছর পর বিগত জরুরি অবস্থার সরকারের আমলে ২০০৭ সালে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয়। ওই সময় যে চারটি বিধিমালা গেজেট আকারে জারি করা হয়েছিল, এর মধ্যে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা বিধান এবং চাকরির অন্যান্য শর্ত) বিধিমালা, ২০০৭ একটি। যেখানে বলা হয়েছে, পৃথক বিধি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধান করা হবে ১৯৮৫ সালের গভর্নমেন্ট সার্ভিস রুলস অনুযায়ী।
প্রসঙ্গত বহুল আলোচিত নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালার গেজেট গত সোমবার প্রকাশ হয়। গেজেট প্রকাশের পর বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আগে যে অবস্থা ছিল এখনো সে অবস্থায় রয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির হাতেই থাকছে। গেজেট প্রকাশে সরকার গত দুই বছরে দফায় দফায় সময় নিয়েছে সপ্রিম কোর্ট থেকে। সর্বশেষ গত রোববার সরকারকে তিনদিনের সময় দেন আপিল বিভাগ।
পদত্যাগ করা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালায় সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের আইন মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতির হাতে নিয়ন্ত্রণ রেখে গেজেট প্রকাশ করতে চেয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের অভিপ্রায় অনুযায়ী বিধিমালার খসড়া না করায় সর্বোচ্চ আদালত আইন মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিব গত বছর ৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের তলবে হাজির হয়েছিলেন। তখন বঙ্গভবন থেকে বলা হয়েছিল নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালার গেজেটের প্রয়োজন নেই। এই নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় তখন। সংশ্লিদের মতে এই বিরোধও বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগের অন্যতম কারণ। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় তারা ভাগ বসাতে চায়।’ এই বিরোধের জের থেকে সরকার বিচারপতি এস কে সিনহার ওপর নাখোশ হয়েছিলেন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আপিল বিভাগে অবৈধ ঘোষণার রায় বহালের পর এস কে সিনহা গত ১১ নবেম্বর প্রধান বিচারপতি পদ ছাড়লেও তার বিদায়ের নেপথ্যের এই বিধিমালার বিষয়টিও রয়েছে। গেজেট প্রকাশের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্যেও এস কে সিনহার ওপর ক্ষোভ প্রকাশে বিষয়টি আরো প্রকাশ এলো।
ষোড়শ সংশোধনীর অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ আপিল বিভাগের তিন বিচারপতি বলেছিলেন, নিম্ন আদালতের বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধান নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী।
তবে ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে মামলায় ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচার্য বিষয় না হওয়ায় ওই অভিমতের সঙ্গে একমত হননি অন্য চার বিচারপতি।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ১৯৭২ সালের আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, অধস্তন আদালতের বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধান নিয়ন্ত্রণ করবেন সুপ্রিম কোর্ট। চতুর্থ সংশোধনীতে ‘সুুপ্রিম কোর্ট’-এর জায়গায় ‘প্রেসিডেন্ট’ শব্দ সন্নিবেশন করা হয়েছে, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অধস্তন আদালতকেও স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের জায়গায় প্রেসিডেন্ট শব্দ সন্নিবেশনের মাধ্যমে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা পুরোটাই খর্ব করা হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ