শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ডেলিভারি নিচ্ছে না কৃষক ॥ লোকসানের মুখে হিমাগার কর্তৃপক্ষ

শেখ মো: সামসুদ্দোহা মাদারীপুর থেকে: মাত্র ৫ সপ্তাহের ব্যবধানে জেলায় আলুর বাজারে মারাত্মক ধ্বস নামেছে। নবেম্বর মাসের প্রথম দিকে প্রতি বস্তা আলুর দাম ৬‘শ থেকে ৭‘শ টাকা কমে যাওয়ায় এ বিপর্যয় দেখা দেয়। নির্ধারিত সময় পার হলেও উপর্যুপুরী ক্ষতির ভয়ে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা কোল্ড স্টোর থেকে সব আলু ডেলিভারি না নেওয়ায় মাদারীপুর কোল্ড স্টোরে প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের ১৫ সহস্রাধিক বস্তা আলু পড়ে রয়েছে। ফলে বড় ধরণের লোকসানের মুখে পড়েছে হিমাগার কর্তৃপক্ষ। ২/৪ দিনের মধ্যে এ সব আলু স্টোর থেকে খালাস না হলে নদীতে ফেলে দিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর মার্চ মাসে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ৬৫ হাজার বস্তা বিভিন্ন জাতের আলু সংরক্ষণ করে মাদারীপুর কোল্ড স্টোরেজে। তখন প্রতি বস্তা আলুর খরচ পড়ে সাড়ে ৯‘শ থেকে ১ হাজার টাকা। সংরক্ষিত সম্পূর্ণ আলু ৩০ নবেম্বরের মধ্যে কোল্ড স্টোর থেকে ডেলিভারি নেওয়ার কথা। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার  পর্যন্ত মাদারীপুর কোল্ড স্টোরে প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের ১৫ সহস্রাধিক বস্তা বিভিন্ন জাতের আলু পড়ে রয়েছে। আলুর দাম আশঙ্খাজনক ভাবে কমে যাওয়ায় কৃষক ও মজুতদাররা এ সব আলু ডেলিভারি নিচ্ছে না। বাজারে নতুন আলু উঠায় পুরনো আলুর দাম চাহিদা কমে যাওয়ায় স্টোরজাত আলুর বাজারে ধ্বস নেমেছে। বর্তমান বাজারে প্রতি বস্তা আলুর দাম ২০০/-টাকা থেকে সাড়ে ৩০০/- টাকা। বস্তা প্রতি ৬‘শ থেকে ৭‘শ টাকা লোকসানের পাশাপাশি কোল্ড স্টোর ভাড়া পরিশোধ করার ভয়ে কেউ আলু ডেলিভারি নিতে আসছে না। অনেকে আলু মজুত করে বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এদিকে আলু ডেলিভারি না হওয়ায় মালিক কর্তৃপক্ষ কোল্ড স্টোর বন্ধ করতে পারছেন না। একদিকে ভাড়ার প্রায় ৪৫ লাখ টাকা অনাদায়ী, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ বিল ও শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়ায় হিমাগার মালিক বড় ধরণের লোকসানের মুখে পড়েছেন। কোল্ড স্টোরে পড়ে থাকা দেড় কোটি টাকা মূল্যের আলু এখন হিমাগার মালিকের গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে।
আগামী বছর মার্চ মাসে নতুন আলু কোল্ড স্টোরে উঠবে; এ অবস্থায় স্টোরে পড়ে থাকা ১৫ হাজার বস্তা আলু নিয়ে মহাসংকটে পড়েছেন হিমাগার কর্তৃপক্ষ। সংরক্ষণের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে মালিক কর্তৃপক্ষ এ সব আলু নিলামে বিক্রির ঘোষণা দিলেও ক্রেতার অভাব বা কেউ তা ক্রয় করতে আসছে না। এ কারণে আগামী মৌসুমে নতুন আলু সংরক্ষণ ও পুরাতন আলু বোঝা কাঁধে নিয়ে দুশ্চিন্তায় হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। দ্বিমুখী সমস্যায় কোল্ড স্টোর মালিককে আগামী মৌসুমেও লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় স্টোরজাত আলু ডেলিভারি না হলে নদীতে ফেলে দিতে হবে।
হিমাগার কর্তৃপক্ষ একাধিকবার একাধিক কৃষকের বাড়িতে গিয়ে আলু ডেলিভারি নেওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু তারা লোকসানের ভয়ে তা ডেলিভারি নিতে রাজী নয়। অনেক কৃষক কোল্ড স্টোর কর্মচারীদের দেখে না দেখার ভান করে অন্যদিকে সরে গেছে। কেউ কেউ সংরক্ষিত আলু গরু দিয়ে খাওয়ানোর কথাও বলেছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, মাদারীপুর-শরীয়তপুর জেলার একমাত্র হিমাগার মাদারীপুর কোল্ড স্টোরেজ। এই দুই জেলার ও দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষিপণ্য আলু সংরক্ষণ করা হয় এই হিমাগারে। মৌসুমে আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করে দেশের প্রভাবশালী একাধিক সিন্ডিকেট। যে কারণে কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। তাই উৎপাদন খরচ পুষিয়ে কিছুটা লাভের আশায় কৃষক ও ক্ষুদ্র মজুতদাররা আলু সংরক্ষণ করে থাকে। কিন্তু সেখানেও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে উভয় পক্ষকে। বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং না থাকায় একদিকে কৃষক যেমন মার খাচ্ছে; তেমনি লোকসানের মুখে পড়ছেন হিমাগার মালিক কর্তৃপক্ষ।
কালকিনি দর্শনার আদর্শ কৃষক দুলাল রুদ্র বলেন, ‘আমার বেশ দিছু আলু মাদারীপুর কোল্ড স্টোরে এখনো আছে।
জানতাম না আলুর বাজারে এভাবে ধ্বস নামবে। এবার একেবারে পথে বসে গেছি। স্টোরের আলু এনে এখন কি করবো। আনলে তো আর বিক্রি করা যাবে না, আর কত লোকসান দেবো?’
এ ব্যাপারে মাদারীপুর কোল্ড স্টোরেজ লি: ম্যানেজার আবদুল করিম বলেন, ‘আমার ২৩ বছর চাকরি জীবনে এবারের মত আলুর বাজারের ধ্বস কোন দিন দেখিনি। কৃষক ও মজুতদারদের পাশাপাশি আমরাও বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়েছি। আমাদের কোল্ড স্টোরে প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের ১৫ সহস্রাধিক বস্তা বিভিন্ন জাতের আলু পড়ে রয়েছে। আলু ডেলিভারি না হওয়ায় কোল্ড স্টোর চালু রাখতে হচ্ছে। একদিকে ভাড়া আদায় হচ্ছে না, অন্যদিকে মাস গেলেই মাথার উপরে ৪৫ লাখ টাকার বিদ্যুৎ বিলের বোঝা।’
মাদারীপুর কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের মালিক ফরহাদ ফেরদৌস বর্ষণ বলেন, ‘একদিকে ভাড়ার ভয়ে কেউ কোল্ড স্টোর থেকে পুরাতন আলু খালাস করে নিচ্ছে না, অন্যদিকে নতুন আলুর সরবরাহ পর্যাপ্ত। দুশ্চিন্তার বোঝা দিন দিন ভারী হচ্ছে। আলু খালাস না হলে কোথায় পাবো ভাড়ার টাক্ াআর কিভাবেই বা পরিশোধ করবো ব্যাংকের ঋণ? মাস গেলেই গুণতে হয় বড় অংকের বিদ্যুৎ বিল। কর্মচারীর বেতন ভাতাসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই।”

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ