বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বিচারপতি এস কে সিনহার পর্যবেক্ষণ বাতিল চায় সরকার

# যারা বিদেশী আইনজীবী চায় তারা রাষ্ট্রদ্রোহী -এটর্নি জেনারেল
স্টাফ রিপোর্টার : উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ঘোষণা আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছে সরকার। গতকাল সকালে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনটি দায়ের করা হয়। আবেদনে সরকারপক্ষে মোট ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের চার মাসেরও বেশি সময় পর ওই রায়ের রিভিউ আবেদন করল সরকারপক্ষ।
রিভিউ আবেদন দায়ের করার পর এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, আমরা রিভিউ পিটিশন দায়ের করেছি। এখন শুনানির অপেক্ষায় থাকবো। এই রিভিউ পিটিশনে মোট ৯৪টি গ্রাউন্ড (যুক্তি) দেখিয়েছি। এর মধ্যে কিছু গ্রাউন্ড রায়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে এবং বেশ কয়েকটি গ্রাউন্ড জাতীয় সংসদ আমাদের সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদে ফিরে যেতে চাই কিন্তু এটাকে আদালত অবৈধ করেছেন সেসব বিষয়ে। এটা আদালত অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন না। তিনি বলেন, এছাড়াও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হবে কি হবে না তা নির্ভর করবে সংবিধানের ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদের অধীনে যখন আইন প্রণয়ন করা হবে। সেই আইনে কী বিধিবিধান থাকবে, তদন্ত কাজ কে করবেন, তদন্ত কাজের পর সুপারিশ কী হবে এ সংক্রান্ত আইন হওয়ার পরই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্বের বিষয়টি আসবে। কাজেই যে আইনই এখনও প্রণয়ন হয়নি সেখানে আগে থেকে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
কি কি গ্রাউন্ডে আবেদন করা হয়েছে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত ৩ জুলাই আমাদের যে আপিল খারিজ হয় তা পুনর্বিবেচনা করা এবং আপিলের রায় বাতিল চাওয়া হয়েছে।
রিভিউর শুনানিতে বিদেশি আইনজীবী চেয়ে রিটের বাদী পক্ষের করা আবেদন প্রসঙ্গে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আমাদের ৫০ হাজার আইনজীবী রয়েছেন, তারা কি এই রিভিউ শুনানির অযোগ্য। যারা বিদেশি আইনজীবী চেয়ে আবেদন করেছে তাদের দেশের প্রতি, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা থাকলে এই আবেদন করতে পারতেন না। তারা দেশদ্রোহী। রাষ্ট্রের প্রতি, বিচারব্যবস্থার প্রতি এই আস্থাহীনতা খুবই নিন্দনীয়।
বাদীপক্ষের উদ্দেশে তিনি বলেন, এর আগে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, সংশোধনী বিষয়ে শুনানি হয়েছে। তখন তো বিদেশি আইনজীবীর দরকার পড়েনি। কোনো দেশের সাংবিধানিক বিষয়ে বিদেশি আইনজীবী শুনানি করেছেন এ রকম নজির পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
গত ১৮ ডিসেম্বর রিটের বাদী পক্ষ এই রিভিউর শুনানিতে বিদেশী আইনজীবী চেয়ে বার কাউন্সিলেল ভাইস চেয়ারম্যান বরাবরে আবেদন করে। ওই আবেদন হাতে পাওয়ার দশদিনের মধ্যেই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে বার কাউন্সিলকে অনুরোধ করা হয় এতে। বিদেশী আইনজীবী হিসেবে তিন ভারতীয় আইনজীবী এডভোকেট আগারওয়াল আমবুজ, এডভোকেট আগারওয়াল অনামিকা গুপ্তা ও অধিমোলাম ভেঙ্কটারমনের নাম রয়েছে আবেদনে।
সংসদ কর্তৃক বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা পুনর্বহালের গ্রাউন্ড আছে কিনা-জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংসদের ক্ষমতার বিষয় নেই। তবে জিয়াউর রহমানের আমলে যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের নামে মার্শাল ল’ ফরমান দিয়ে সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছিল সেটাকে বাতিল করে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে অনুচ্ছেদে আমরা ফিরে যেতে চেয়েছি।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করে যে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছে তা আপনারা রিভিউ আবেদনের মাধ্যমে পুনর্বহাল চেয়েছেন কিনা-জানতে চাইলে এটর্নি জেনারেল বলেন, এখানে অনেকের ধারণা সংসদই তাদের অপসারণ করবে। বিষয়টা তা না। যেকোনো বিচারপতি তিনি যদি অসামর্থ্য হন বা তার বিরুদ্ধে যদি অসদাচরণের কোনও অভিযোগ ওঠে সেই ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে কিভাবে তদন্ত হবে ঠিক করা হবে সংবিধানের ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী। সেই তদন্ত হওয়ার পর তদন্ত কমিটি যদি মনে করে যে, তিনি দোষী সেই ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি রিকমেন্ডেশন করবে তার অপসাণের জন্য। সেই সুপারিশটি পার্লামেন্টে যাবে এবং দুই তৃতীয়াংশ ভোটে সমর্থিত হলেই তখন সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে চূড়ান্ত আদেশের জন্য। কাজেই তদন্ত কমিটি কোনও বিচারপতিকে যদি দোষী সাব্যস্ত না করেন তাহলে সেটা পার্লামেন্টে যাবেই না। মুখ্য বিষয় হলো একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ উত্থাপিত হবে তখন সেটার তদন্ত করার দায়িত্ব কার কাছে থাকবে এবং তদন্তের পদ্ধতিটা কী হবে, তদন্ত কারা কারা করবেন সেটিই হবে মূল বিষয়। এখানে যে পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত করা না হয় সে পর্যন্ত তাকে করার কিছুই নেই।
রিভিউ আবেদনটি দ্রুতি শুনানির জন্য সরকারপক্ষ কী উদ্যোগ নেবে-জানতে চাইলে এটর্নি জেনারেল বলেন, অবস্থা বুঝে আমরা ব্যবস্থা নেবো।
সাবেক প্রধান বিচারপতি যে পর্যবেবেক্ষণ দিয়েছেন সেগুলো কি আপনারা আপনাদের রিভিউ আবেদনে বাতিল চেয়েছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে এটর্নি জেনারেল বলেন, অবশ্যই, তার (সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) পর্যবেক্ষণগুলো সুনির্দিষ্ট করে আমরা গ্রাউন্ড নিয়েছি।
আপিল বিভাগের রায়ে বিচারকদের জন্য যে ৩৯টি আচরণবিধি (কোড অব কন্ডাক্ট) দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোড অব কন্ডাক্ট সম্পর্কে আমরা বলেছি (রিভিউতে), কোড অব কন্ডাক্ট করার কথা হলো যারা নাকি তদন্ত করবেন এবং ৯৬ (৩) অধীনে তারা কোড অব কন্ডাক্ট করবেন। কোড অব কন্ডাক্ট তো রায় দিয়ে করার কথা না। কোড অব কন্ডাক্ট অনুমোদন করার কথা রাষ্ট্রপতির। এখানে (রায়ে) তারা যে কোড অব কন্ডাক্ট করেছেন, আমরা বলেছি এটা কোনও ইস্যুই ছিল না তাদের। এটা অনর্থক। নিজেরা নিজেরা করে নিয়েছেন। আমরা বাতিল চেয়েছি।
আপিল বিভাগে এখন পাঁচজন বিচারপতি আছেন। ফলে রিভিউ শুনানির ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা-প্রশ্নের জবাবে এটর্নি জেনারেল বলেন, আমি এই উপমহাদেশের যতগুলো মামলা দেখেছি, বিশেষ করে ভারতে যে সাংবিধানিক মামলাগুলো হয়েছে, যে মামলাগুলো পাঁচজন বিচারপতি বা সাতজন বিচারপতি করেছেন সেগুলোর যদি উল্টানোর প্রয়োজন হয় বা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার সমান সংখ্যক বা বেশি সংখ্যক বিচারপতিই করেছেন। তবে আমাদের আপিল বিভাগের রুলসে আছে যতখানি সম্ভব করা যায়।
আপিলে সর্বস্মতিক্রমে রায়টি হয়েছিল, সেক্ষেত্রে রায়ের রিভিউ নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশাবাদী বলেই তো গত দুই মাস পরিশ্রম করে আমরা রিভিউ পিটিশনটা তৈরি করেছি। সবচেয়ে বড় গ্রাউন্ডটা হলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে ছিল, কোনও বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উত্থাপিত হলে প্রধান বিচারপতি এবং তার নিচে দুজন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে নিয়ে কাউন্সিল গঠিত হবে। তারা এই জিনিসগুলোর শুনানি করবেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকেও সুযোগ দেওয়া হবে আত্মপক্ষ সমর্থনের। আমাদের সংবিধানে ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে আছে, এ বিষয়ে সরকার আইন প্রণয়ন করবে। অর্থাৎ সংসদের দুই তৃতীয়াংশের রেজুলেশন না হলে কোনও বিচারপতিকে অপসারণ করা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭৫ সালের আগ পর্যন্ত ৯৬(২), (৩) ধারা বহাল ছিল। কিন্তু অবৈধ সামরিক সরকার আসার পর কোনও প্রতিষ্ঠান বা দল এমনকি সুপ্রিম কোর্টও এই ৯৬(২), (৩) তে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে গেছে, এমন কথা তো কেউ বলেননি? কাজেই আজকে যখন আমরা মার্শাল ল’ দ্বারা প্রণীত একটি বিধানকে অপসারণ করে সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করতে চাই। কিন্তু আদালত কেন এটাকে অবৈধ ঘোষণা করবেন?
গত ৩ জুলাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায় দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের করা আপিলও খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। গত ১ আগস্ট এ মামলার ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবী ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নবেম্বর হাইকোর্টে এই রিট আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানির পর আদালত রুল জারি করে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চান। ওই রুলের ওপর ২০১৫ সালের ২১ মে শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্ব বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামাল সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। রায়ে আরও বলা হয়, কনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের এডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে।
আদালত রায়ে আরও বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিন্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে সাংসদ সদস্যদের সব সময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা আছে।
রায়ে আরও বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবে। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ