শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের রূপকার : হযরত মুহাম্মাদ (সা:)

খাদিজা আক্তার দুলি : ২১ শতকের এ সভ্যতা অর্জনের পাল্লার মাপকাঠিতে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, শিক্ষাক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর সাফল্যের নানামুখী জয়জয়কার নিয়ে স্বদর্পে এগিয়ে চলছে। যুক্তিগত সত্যতার কথার স্বীকৃতির মানদন্ড পেলেও তা একেবারে আংশিক এবং পশ্চিমাদের অনুকরণীয়। সামগ্রিক কোন পুনর্গঠন অথবা ব্যাপক মাত্রার পরিবর্তনের কোন চিত্র সামনে নিয়ে আসা এখানে অনেক কঠিন। বরং সভ্য ও সুশীল বলে দাবীদার এ সভ্যতার নানামুখী অর্জন কতটা বর্বর, অমানবিক ও পৈশাচিক হতে পারে তা আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে প্রজ্জ্বলিত।
সমাজ চিত্রের নানামুখী অবস্থা পর্যবেক্ষণে সামনে আসে মানবতা লঙ্ঘনের অস্বাভাবিক অবস্থা। আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, লেবানন, এশিয়া, রাশিয়া, কাশ্মির,  ইরাক ও মিয়ানমার সহ সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্রের উপর যুলুম-নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ এখন নিত্যকার ব্যাপারমাত্র।
শতকরা ৯০জন মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম কিছু হচ্ছে না। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে এদেশে মুসলমানদের শাসন  প্রতিষ্ঠিত হলেও কুরআন-সুন্নাহর আদর্শের ভিত্তিতে এখানে কখনো সত্যিকারের ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং বরাবরই পৌত্তলিক সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে ইসলামের একটা সংঘাত চলেই আসছে।
এদেশে গুম, অপহরণ, খুন, ধর্ষণ ও সংখ্যালঘু নির্যাতন, সীমান্তে হত্যা অহরহ ঘটেই চলছে। এটি মৌলিক অধিকারের চরম লঙ্ঘন। বিশ্ব বিবেক রীতিমত সমাজ ব্যবস্থার এই ত্রুটিগুলো লক্ষ্য করছে কিন্তু শান্তির পথ কোথাও খুঁজে পাচ্ছেনা।
অথচ ১৪ শত বছর পূর্বে এমনই এক জাহেলিয়াত পূর্ণ সমাজ ব্যবস্থায় আর্বিভূত হন হযরত মুহাম্মদ (সা:)। তখনকার সমাজ অন্যায়, অত্যাচার,  কুসংস্কার ও বর্বরতায় আচ্ছন্ন ছিল। সামাজিক অসাম্য, অনাচার, ব্যভিচার,  বর্বরতা, উৎপীড়ন, রক্তপাত ইত্যাদি জঘন্য অপরাধে আরব জাতি ডুবে ছিল। রাসূল (সা:) সমাজের এই অন্ধকার আবর্জনাকে উত্তাল সমুদ্রে নিক্ষেপ করে, পাপ পঙ্কিলতা মুক্ত একটা সমাজ গড়ে তুলেছিলেন।
মুর্তিপুজা, দেবতা পুজা, পাদ্রী -পুরোহিত পুজা ও সব কুসংস্কার নিয়ে যখন আরববাসী চরম অধঃপতনে নিমজ্জ্বিত, তখন তৌহিদের মহান বাণী নিয়ে এক ইনসাফপূর্ণ সমাজব্যবস্থা রূপায়ন করলেন রাসুল মুহাম্মাদ (সা:)।
আজও যদি এই  অশান্তির দাবানলে নিমজ্জ্বিত পৃথিবীতে সকল মত ও পথ পরিহার করে একমাত্র রাসুল সাঃ এর দেখানো আদর্শ অনুসরণ, অনুকরণ করা হয় তাহলে সফল একটি সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা সম্ভব।
আল কুরআনে মহান রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
“রাসূলদের কিতাব এবং মীযান দিয়ে পাঠানো হয়েছে। যাতে করে মানব সমাজে ন্যায়, সুবিচার, সুষ্ঠু ব্যবস্থা ও ইনসাফের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।” (আল-হাদীদ: ২৫)
আল্লাহ রব্বুল আলামীন কর্তৃক প্রেরিত সব নবী রাসূলদের প্রেরণের উদ্দেশ্যই ছিল সমাজের বুকে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা ও আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করা। মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা:) কেও একই উদ্দেশ্য দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। সাথে সাথে তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এই জীবন ব্যবস্থাকে বিজয়ী করার জন্য।
কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী- “তিনি সেই সত্তা, যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত এবং সত্য দ্বীন সহ পাঠিয়েছেন। যেন সে এই বিধানকে  সকল বিধি ব্যবস্থার  উপর বিজয়ী করে দেন ”। (আল-ফাতহ: ২৮)
এ আয়াতের মধ্যে আমরা মুহাম্মদ (সা:) কে প্রেরণের উদ্দেশ্যের মধ্যে ইসলামী  সমাজ গড়ার জন্য   বিপ্লবের পদধ্বনি শুনতে পাই। সমাজ থেকে কুফর, শিরক, ফিসক, ফিতনা, ফাসাদ এগুলোকে উৎখাত করে সে জায়গায় ইসলামী জীবনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করাই হল ইসলামী সমাজ বিপ্লব।
ইসলামী সমাজ  বিনির্মাণের কাক্সিক্ষত রূপরেখা : একজন বিজয়ী সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাসূল (সা:) চিরদিনের জন্য এই পৃথিবীর মানচিত্রে ইসলামের শিকড়কে অনেক মজবুত ভাবেই গেড়ে  গেছেন। তিনি আল্লাহর হেদায়াত অনুযায়ী নিজেকে গড়েছেন, সমাজ নির্মান করেছেন, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, পরিচালনা করেছেন। এজন্যই তিনি ইসলামী সমাজ বিপ্লবের একজন সফল মডেল।
মূলত এই বিপ্লব সাধন হয়েছেন তিনটি পর্যায়কে কেন্দ্র করে  -
১. চিন্তার বা মানসিক বিপ্লব
২. নৈতিক ও চারিত্রিক
৩. সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লব।
রাসূল (সা:) কোন জোর জবরদস্তি করে কিংবা সমাজপতিদের সাথে আঁতাত করে অথবা কোন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কোন কৃত্রিম পন্থা অনুসরণ করে ক্ষমতায় আরোহণ করেননি, বরং তিনি মানুষের মন জয় করে সফলতার মঞ্জিলে পদার্পণ করেছিলেন।
তিনি মূলত প্রথমে জনগণের মধ্যে চিন্তা ও চরিত্রের বিপ্লব সাধন করেন।
অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই সমাজের মানুষের সামনে সহজ-সরলভাবে মুহাম্মদ (সা:) সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য তুলে ধরলেন। তাদেরকে চোখ খুলে দেখতে এবং সত্যের যে আহবান তিনি করেছেন সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে বললেন।
অত্যন্ত নিখুঁত ও মর্মস্পর্শী পদ্ধতিতে তিনি আল্লাহর একত্ববাদ, চিরন্তন জীবন ব্যবস্থা এবং সেই ব্যবস্থার পথ প্রদর্শক হিসেবে নিজেকে পেশ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর দাওয়াতের বলিষ্ঠতা, দৃঢ়তা এবং যুক্তিপূর্ণ প্রশ্নের সমাধান বিপরীত সব ব্যবস্থাগুলোর উপর প্রবল বাতাসের ঝড় তুলে শিকড় সহ উপড়ে ফেলে দিয়েছিলো।
সাধারণ মানুষের সামনে আল্লাহর দাসত্বের স্বীকৃতি এবং সামগ্রিক জীবনে এই দাসত্বের স্বরূপ কেমন হবে, কেন আল্লাহকে মনিব হিসেবে মেনে নিতে হবে তা সবিস্তারে তুলে ধরেছিলেন তিনি। এক্ষেত্রে বিরোধীদের পক্ষ থেকে যে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ গুলো আসছে তার জবাব দেয়া হয়েছে অত্যন্ত শান্তশিষ্ট পদ্ধতিতে, কোমলতা ও নম্রতা দিয়ে সবার অন্তরে বুদ্ধিদীপ্ত চেতনাকে জাগ্রত করা হয়েছে। যার ফলে ইসলামের বড় বড় শত্রুও বন্ধুতে পরিণত হয়েছে।
আর যখনই তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ রাসূলের (সা:) আন্দোলনের মতো এই অপূর্ব নিয়ামতের মধ্যে শামিল হয়েছে এবং নিজেদের অতীত কর্মকান্ড নিয়ে চিন্তিত হয়ে গেছে, তখনই তাদের সামনে শ্রেষ্ঠ পথ-প্রদর্শক হিসেবে মুহাম্মদ (সা:) আল কুরআনের অমীয় বাণী তুলে ধরে প্রতিটি হৃদয়কে আশ্বস্ত করে বলেছেন : “হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তোমরা তোমাদের প্রভূর দিকে ফিরে এসো এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করো, যে সময় তোমাদের ওপর আযাব এসে যাবে এবং তোমরা কোন সাহায্য পাবে না সে সময় আসার আগেই।” (সূরা যুমার)
ঠিক এভাবেই যারা দাওয়াত গ্রহণ না করে বিরোধিতা করেছিল, তাদেরকেও কুরআনের বাণীর মাধ্যমে বিভিন্নভাবে দাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছিল : “বলো : হে আহলে কিতাব! এসো তোমাদের ও আমাদের মধ্যে যে কথাটা অবিসংবাদিত, সেই কথাটা আমরা মেনে নেই। সেই কথাটা হলো এই যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবো না এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেরাই পরস্পরকে প্রভূর আসনে বসাবো না। (আল ইমরান : ৬৪)
রাসূলের (সা:) দাওয়াতের এই চিত্রের মাধ্যমে যে বিষয়টা সামনে আসে তা হলো- যুক্তিপূর্ণ তর্কের উপস্থাপন, মন গলানো আবেগ, সুসংবাদ প্রদর্শন, সতর্কবাণীর স্বরূপ উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রতিটি বিবেকের বদ্ধ হৃদয়ের কপাট খুলে গিয়েছিল, প্রতিটি মানুষের মধ্যে উপলব্ধিবোধ ও আত্মজিজ্ঞাসার একটা অন্তর তৈরি হয়ে গিয়েছিল  সংক্রমণাত্মক সমাজ পরিবর্তনের জন্য যা ওষুধের মতো কাজ করেছিল।
চারিত্রিক বিপ্লব : রাসূল (সা:) মূলত প্রতিটি মানুষের অন্তর গুলোকে ধরতে চেয়েছিলেন। এজন্যই তিনি স্বাভাবিক কর্মপন্থার অনুসরণ পছন্দ করলেন। তাই চিন্তার জগৎ যাদের পরিবর্তন হচ্ছিল তারা স্বেচ্ছায় ঐ চিন্তার আদলে নিজেদেরকে সাজিয়ে ফেলেছিলেন। এতদিনের পুরোনো রসম-রেওয়াজকে দূরে নিক্ষেপ করে দিলেন। এখন তারা সত্য কথা বলে, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, যিনা-ব্যভিচার থেকে দূরে থাকে। আগে যখন তারা দশটা মানুষ হত্যা করাকে পুণ্য মনে করতো, এখন তারা যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলেও কাউকে একটা কটুকথা বলতে ভয় পায়, না জানি এটার জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি কেমন হবে - এ চিন্তায় তারা তটস্থ থাকে।
সমাজ বিপ্লব : এভাবেই রাসূল (সা:) সমাজে দুটি ধারা তৈরি করে ফেলেন। একটি হলো প্রচলিত ধারা, যার গোড়া শিরকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটি হলো শান্তিকামী বিপ্লবী ধারা।
ইতোমধ্যেই যাদের চিন্তাজগতে বিপ্লবের সৃষ্টি হয়েছে, নৈতিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে এবং চারিত্রিক ধারার বিপ্লব অর্জিত হয়েছে। রাসূল (সা:) যেহেতু প্রতিটা মানুষকে শাশ্বত এক মুক্তির দিকে আহবান জানিয়েছিলেন। তাই ইতিপূর্বেই যারা এ সত্যের আহ্বান মেনে নিয়েছিল, তাদের চারিত্রিক সৌন্দর্যের মাধ্যমে প্রতিনিয়তই নতুন এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হতে থাকে আরো অসংখ্য সত্য প্রাণ। অবশেষে এমন একটা অবস্থা আসে যখন কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ছাড়া বাকি সবাই এ নতুন আন্দোলনের বিপ্লবী কর্মী অথবা সমর্থকে পরিণত হলো।
এভাবে রাসূলে কারীম (সা:) চিন্তা ও চারিত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে জাহিলিয়াতের পুরো সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করেন। আরো একটু গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সমাজ সংস্কারক হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর সামগ্রিক যে রূপ আমাদের সামনে চলে আসে-
মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে তিনি বর্বর একটি জাতিকে সমাজের কল্যাণকামী বন্ধুতে রূপান্তরিত করার জন্য সমাজ থেকে শ্রেণী ও বংশগত বৈষম্য তুলে ফেলেছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন সকল মানুষ সমান। মানুষের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে বেশি আল্লাহকে ভয় করে। সাথে সাথে তিনি নারী জাতিকে সম্মানের সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। যার মাধ্যমে জীবন্ত কন্যা সন্তান কবর দেওয়ার প্রচলিত রীতি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রাক ইসলামী যুগে আরববাসীদের নৈতিক মান উন্নত করার জন্যও মহানবী (স:) মদ্যপান, জুয়াখেলা, রাহাজানি, নারী ধর্ষণ, নারীর বহুস্বামী গ্রহণ, পুরুষের সংখ্যাতীত স্ত্রী গ্রহণ ইত্যাদি কার্যকলাপকে কুরআনের অনুশাসন অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম ঘোষণা করেছেন। এভাবেই তিনি সমগ্র আরবের সমাজ ধারায় নিয়ে এসেছিলেন এক পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব।
বিপ্লবের প্রাণশক্তি :  মুহাম্মদ (স:) সব সময়ের জন্য কোমলতার দীপ্তি দিয়ে নিজেকে পরিমাপ করে করে চালাতেন।
হৃদয় নিংড়ানো প্রাণঢালা ভালবাসা আর অমায়িক চারিত্রিক মাধুর্যতা দিয়ে তিনি সবার হৃদয় জয় করেছিলেন। নিজের চাওয়াকে তিনি এভাবে উপস্থাপন করতেন যে, “তোমরা পতঙ্গের মতো আগুনের গুহার দিকে এগিয়ে যাচ্ছো। আর আমি তোমাদেরকে ধরে ধরে তা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
একজন মহান সংস্কারের এমন আহ্বান সত্যি অনেক চিন্তার দাবী রাখে। কতটা ব্যাকুল হৃদয়ের হলে, কতটা কল্যাণকামী অন্তর হলে এমন মহানুভবতার আহ্বান। একজন সমাজ পূনর্গঠক এর কন্ঠ হতে উচ্চারিত হতে পারে। অথচ যাদের প্রতিই তিনি এত মহানুভব ছিলেন দাওয়াত গ্ৰহণের পূর্বে তার ছিল অত্যন্ত জঘণ্য মনের মানুষ। নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র, কখনও যুদ্ধের আহ্বান, রাতের বেলায় সামরিক প্রহরা বসানো মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে সংঘাত বাঁধানো এক কথায় দুর্বিষহ একটা অবস্থার মধ্যে রাখত এবং  সবসময় জরুরী অবস্থা বিরাজ করতো। কিন্তু এক্ষেত্রে একজন সোনালী সমাজ নির্মাতার দূরদৃষ্টি যদি আমরা উপলব্ধি করি তাহলে আমরা দেখব যে -
* এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো স্বেচ্ছাচার মূলক বিধানও চালু করেননি
* কোন কঠোর আইনও প্রনয়ণ করেননি
বরং তিনি নিজের দাওয়াতে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার ও নিজের চরিত্রের পবিত্রতার উপরই পুরোপুরি নির্ভর করেছেন। তিনি কাউকে মারাত্মকভাবে আঘাতও করেননি, আবার কাউকে তুচ্ছ -তাচ্ছিল্যও করেননি। আর না কাউকে ভয়-ভীতি দেখিয়েছেন। এ কারণেই শত্রুদের মনও তিনি অনায়াসে জয় করে ফেলেছেন, যার উল্লেখযোগ্য উদাহরন আমরা দেখতে পাই- একজন পরিপূর্ণ বিজেতা হিসেবে যখন তিনি মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন তখন বিশ বছর ধরে যারা তার বিরুদ্ধে  লড়াই করেছে তারা যখন মুহাম্মদ (স:)-এর সামনে অসহায় ভাবে দাড়িয়েছিল তখন চাইলে তিনি প্রতিটি আঘাতের জবাব দিতে পারতেন, লাশের ধ্বংসস্তুপ তৈরি করে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি বললেন : “তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আর কোন অভিযোগ নেই। তোমরা যেতে পারো, তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন”।
মূলত যে বিপ্লব প্রতিশোধের হয় তা কখনোই মানুষের মনোজগত আকৃষ্ট করতে পারে না। তাঁর ধ্বংস অনিবার্য। মনুষ্যত্বের সর্বব্যাপী এক সমুন্নত মর্যাদা তিনি প্রদান করে একটা নির্ভেজাল শিক্ষামূলক বিপ্লব তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সোনালী সমাজ বিনির্মাণে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি : রাসূল (সা:) যে সোনালী সমাজ তৈরি করেছিলেন তার পেছনে ছিল একঝাঁক উন্নত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। যারা অস্ত্রের আঘাতে দ্বিখ-িত হতে প্রস্তুত ছিল কিন্তু জাহেলিয়াতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য নিজেকে বিসর্জন দিতে দূরে ছিলেননা। যাদের সামনে কোনো নির্দেশ বা আল্লাহর বিধান চলে আসলেই সাথে সাথে তারা মাথা নত করে তা মেনে নিতো।  যুদ্ধলব্ধ সম্পদ তাদের হাতে এলে তা কাউকে জানতে না দিয়ে রাতের আঁধারে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গোপনে নিজ সেনাপতির কাছে পৌঁছে দিত।
রাজনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারণ : রাসূল (সা:) আলোকিত সমাজ নির্মাণের জন্য যে ব্যাপক কাজ উপরোক্ত প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে সম্পন্ন করেন তার সাথে আরও কিছু বড় বড় সহায়ক পদক্ষেপ ও গ্রহণ করেন। এগুলোর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল মদিনায় রাজনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারণ। এই প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর করা হয় চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে। অর্থাৎ তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহ এড়িয়ে চলে যতদূর সম্ভব শান্তি ও নিরাপত্তাময় পরিবেশ পছন্দ করতেন। যেখানে চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে যুদ্ধ-বিগ্রহ এড়িয়ে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার বাঁধাহীন পরিবেশ নিশ্চিত করা যেত সেখানে তিনি এটাই গ্রহণ করতেন। এ লক্ষ্যেই বাইয়াতে আকাবা ও হুদাইবিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। রাসূল (সা:) রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও তার প্রভাব সম্প্রসারণের জন্য মিত্রতার সম্পর্ককেই এত বেশি কাজে লাগিয়েছেন যে সেখানে সামরিক ব্যবস্থার অনুপাত ছিল নিতান্তই নগণ্য।
এই ছিল রাসূল (সা:) এর ব্যক্তি  ও সমাজ সংস্কারের বাস্তব রূপ। এই সমাজ কাউকে শুধু বাহির থেকে নয় বরং ভেতর থেকেও পরিবর্তন করে দিয়েছে। যারা একটা সংক্ষিপ্ত আকীদা-বিশ্বাসকে না দেখেই অন্তরে ধারণ করেছিল এবং নিজেদের সংগ্রামী জীবনে তাকে পরিবর্তিত করে ফেলেছিল যার ফলে একটা নতুন সমাজ তৈরি হয়ে গিয়েছিল যা জাহেলিয়াতের প্রতিটি আহবান থেকে নিজেকে শুধু পৃথক করেই রাখেনি বরং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তা উৎপাটিত করেই ক্ষান্ত হয়েছে।
 ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা, ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস, ঐক্যের অভাব, অপপ্রচার, ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, অনৈসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থা, চরম অমানবিকতা, আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্র- যা কিছুই থাক না কেন শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত এই দেশে রাসূলের আদর্শের অনুরূপ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে রাসুলের জীবন থেকেই আদর্শ বাস্তবায়নের পদ্ধতিকে আমাদের অনুসরন করতে হবে।
সবচেয়ে সুবিধাজনক বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের আপামর জনগণ রাসূল প্রেমিক আবার ইসলামকে জানার ও বোঝার আগ্রহ ও তাদের অনেক বেশি।
এই হাতিয়ার কে ধারণ করে বলিষ্ঠ অঙ্গীকার নিয়ে যদি সামনে অগ্রসর হওয়া যায় তাহলেই সম্ভব বিশ্বের এ প্রান্তে আলোকিত এক সমাজ তৈরী করার, যার স্বপ্ন এঁকেছিলেন স্বয়ং রাসূল (সা:)। তাই আসুন পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলোকে দূরে ঠেলে রাসূলের আদর্শকে ধারণ করে সেই সোনালী যুগের সমাজ গড়তে দৃঢ় প্রত্যয়ী হই।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ