শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

দিনে ১১টি ধর্ষণের মামলা ॥ ধীরে ধীরে কমছে খুন বাড়ছে শিশু নির্যাতন

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছেই। গত কয়েক বছর ধরেই এ ধারা অব্যাহত। নারী-শিশু কেউ বাদ পড়ছে না ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে। দেশের একাধিকস্থানে ধর্ষণের বিভৎসতার খবর নাড়া দিয়ে বেকায়দায় ফেলেছে সরকারসহ আইনশৃংখলাবাহিনীকে। দেশের আনাচে-কানাচে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনাগুলো থেকেছে দিনের পর দিন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। একটি ঘটনার রেশ শেষ না হতেই ঘটেছে অপরটি। যার কারণে বিগত বছরগুলোতে ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা চলছে সমানতালে। পুলিশের পরিসংখ্যানেও উঠে এলো ঘটনার ব্যাপকতা। প্রতি দিন ধর্ষণের ১১টি মামলা হচ্ছে দেশে। পুলিশ সদর দফতরের হিসাবে, সদ্য সমাপ্ত ২০১৭ সালে  দেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছে তিন হাজার ৯৯৫টি। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ১১টি করে।
পুলিশের হিসাবে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খুনসহ অন্যান্য বেশ কিছু অপরাধ তুলনামূলক কম হলেও ধর্ষণ এবং মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বাড়ছে শিশু নির্যাতনের ঘটনাও।
২০১৩ সালে দেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছিল তিন হাজার ৬৫০টি। পরের বছর মামলা সংখ্যা আরও ৪৫টি বেড়ে হয় তিন হাজার ৬৯৫টি। ২০১৫ সালে ধর্ষণের মামলা আরও বেড়ে হয় তিন হাজার ৯৩০টি। ২০১৬ সালে এটা কিছুটা কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৭২৮টি। পরের বছর আবার বেড়ে যায়।
নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনায় উন্নত বিশ্বেই যেখানে মামলা হয় না, সেখানে বাংলাদেশে মামলার সংখ্যা আরও কম। এখানেও বেশিরভাগ ঘটনায় লোকলজ্জা বা জটিলতার আশঙ্কায় মামলা করতে চান না ভুক্তভোগী বা অভিভাবকরা। করলে মামলার সংখ্যা আরও বেশি হতো।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী দিলরুবা সরমিন বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনায় ১১টি মামলা হলেও ঘটনা নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি। কারণ, মানুষ মামলা করতে চায় না সামাজিক দিক চিন্তা করে। কারণ জানাজানি হলে বিয়েতে সমস্যা হবে অনেকের ক্ষেত্রেই।’ ‘আবার থানা পুলিশ-কোর্ট কাচারিতেও হয়রানির শিকার হয় মানুষ। নোংরা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাদের।’
এই আইনজীবী বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লেগে যায় বলে আবার অনেকেই মামলা করতে উৎসাহী হয় না। এমন উদাহরণও আছে যে একটি ধর্ষণ মামলার বিচার গত ১৬ বছরেও হয়নি। তাই মামলার দিকে যেতে চায় না অনেকেই।’ ‘আবার অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা না নিয়ে আপস-মীমাংসার চেষ্টা করে। ফলে পুলিশ নিজেও মামলা না নিয়ে সংখ্যা কম দেখাতে চেষ্টা করে।’
ধর্ষণ কমাতে হলে এই সংক্রান্ত মামলাগুলার দ্রুত নিষ্পত্তি ছাড়া বিকল্প নেই বলে মনে করেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘ধর্ষণ মামলার দ্রুত বিচার করতে হবে, ছয় মাসের মধ্যে বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
শিশু নির্যাতন বাড়ছে : গত কয়েক বছর ধরেই শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত নানা ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়েছে দেশে। শিশুকে বেঁধে নির্যাতন করে হত্যা, পায়ুপধে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা, গৃহশ্রমিককে বেদম পিটুনি, ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার মতো ঘটনা শিরোনাম হয়ে এসেছে গণমাধ্যমে।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ধর্ষণের মতোই বেড়ে যাচ্ছে শিশু নির্যাতনের ঘটনাও। দিনকে দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। ২০১৩ সালে শিশু নির্যাতনের ঘটনায় যেখানে এক হাজার ৫১০টি মামলা হয়েছিল, সেখানে পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৭৮টিতে। ২০১৫ সালে মামলা সেটি আরও বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৭২৭টি। পরের বছর মামলা কিছুটা কমে এক হাজার ৭১২টি হলেও সদ্য সমাপ্ত বছরে আবার বেড়ে এক হাজার ৮৫৪টিতে দাঁড়ায়।
শিশুদের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা এবং শিক্ষার হার বাড়ায় এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘শিশুদের প্রতি অমানবিক আচরণ অনেক সময় আমাদেরকেও ভাবিয়ে তোলে। মানুষ কখনও কখনও এত নৃশংসতা দেখায় যা সহ্য করা যায় না।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘নিজের শিশুকে আদর করে অন্যের শিশুকে তার সামনেই নির্যাতনের মতো ঘটনাও ঘটে।’
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী দিলরুবা সরমিন বলেন, যেসব ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে হয়ত বিচার হয়। তবে শিশু নির্যাতনের বেশিরভাগ মামলারই কোনা প্রতিকার হয় না। আর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে এই নির্যাতনগুলো থামছে না।
বিশেষ করে গৃহশ্রমিকদের নির্যাতন, এমনকি হত্যার মামলায় বিচার না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন এই আইনজীবী। বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতনের শিকার শিশুরা হয় নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের পরিবারও মামলা বা বিচার চালিয়ে নিতে আগ্রহী থাকে না। আর যাদের টাকা পয়সা আছে, তারা ভাবে সব কিছু পার পেয়ে যাবে।
এই আইনজীবী বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন যে, পুলিশ অফিসারের বউ নির্যাতন, করে, আইনজীবীর বউ নির্যাতন করে, ব্যবসায়ীর বউ নির্যাতন করে। আবার ঘরে বাইরে পুরুষরাও বেপরোয়া শিশু নির্যাতন করছে। এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই। যারা শিশুদের নির্যাতন করে, তাদেরকেও মনে রাখতে হবে তার ঘরেও শিশু আছে।’
নারী নির্যাতন ‘কমছে’ : ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের মামলা বেড়ে চললেও নারী বিষয়ক মামলা আগের বছরগুলোর তুলনায় ক্রমেই কমছে। পুলিশ বলছে, এসব ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা বাড়ছে। এরই ফলেই মামলা কম হচ্ছে। ২০১৩ সালে দেশে নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছিল ১৪ হাজার ৩৬৯টি। ২০১৫ সালে এটি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৮৬৯টি। এর পর থেকে প্রতি বছরই এই সংখ্যাটা কমতে থাকে। ২০১৫ সালে দেশে নারী নির্যাতনের মামলা হয় ১৫ হাজার ৫০৩টি। ২০১৬ সালে এই ক্ষেত্রে আরও উন্নতি হয়। ওই বছর মামলা হয় ১২ হাজার ৯৬৯টি। ২০১৭ সালে আগের বছরের তুলনায় মামলা কমে প্রায় পৌনে দুই হাজার। সদ্য বিদায়ী বছরে নারী নির্যাতন মামলা হয় ১১ হাজার ২০৩টি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক সহেলী ফেরদৌস বলেন, ‘সচেতনার কারণেই নারী নির্যাতনের ঘটনা কমেছে।’ ‘আমাদের নারী পুলিশ সেন্টারের মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত করে মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। আবার নারীদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার, অধিকার নিয়ে সচেতনতা, পুরুষদের মনোভাব পরিবর্তনও এ ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে।’
তবে পুলিশের এই পরিসংখ্যানে নারী নির্যাতন বিষয়ে পরিস্থিতির উন্নতির সিদ্ধান্ত নিতে চান না নারী অধিকার কর্মী আইনজীবী সালমা আলী। তিনি বলেন, ‘এই কমা মানে কমা নয়। ২০১৭ সালেও আমরা দেখেছি বাসের মধ্যে নারীকে ধর্ষণ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে, প্রমাণ মুছে ফেলার জন্য। এছাড়া বিচার ব্যবস্থার ধীরগতিসহ নানা ধরনের সমস্যার কারণেই নারী নির্যাতন কমছে না। এ বিষয়ে কারণে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।’
এসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমছে : সবচেয়ে উন্নতি হয়েছে এসিড নিক্ষেপের বিষয়টিতে। বছর দশেক আগে দেশে এই সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। তবে কঠোর আইন, এসিড বিক্রির ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং প্রথা চালু, সর্বোপরি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন নারী অধিকার কর্মীরা।
পুলিশের হিসাবে ২০১৩ সালে দেশে এসিড নিক্ষেপের মামলা হয়েছিল ৭২টি। পরের বছর এটা কমে হয় ৪৯টি। ২০১৫ সালে কিছুটা বেড়ে এই সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৫৩তে। তবে এর পরের দুই বছরে মামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে। ২০১৬ সালে এসিড নিক্ষেপের মামলা হয় ৩৩টি এবং সদ্য বিদায়ী বছরে হয় ২১টি।
ধীরে ধীরে কমছে খুন : দেশে কমেছে খুনের পরিমাণ। সঙ্গে ডাকাতি, দস্যুতা ও অপহরণের মতো ঘটনাও আগের চেয়ে কমেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যানে এই তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। সম্প্রতি প্রকাশিত পুলিশ সদরদপ্তরের একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে এই তথ্য।
গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রথম তিন বছরের তুলনায় বিগত দুই বছরে খুনের পরিমাণ কমেছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালে চার বছরের তুলনায় খুনের সংখ্যা কম।
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরির্দক (অপরাধ) রওশন আরা বেগম বলেন, ‘পুলিশের তৎপরতা বাড়ার কারণেই দেশে অপরাধ প্রবণতা কমেছে। যেখানেই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে পুলিশ সাথে সাথেই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের কাছে সোপর্দ করছেন। এর কারণেই দেশের অপরাধের চিত্র তুলনামূলক কম। আর খুন বাড়া-কমাটা হচ্ছে সামাজিক ব্যাপার। কখনো মানুষ উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে খুন করে থাকে।’
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউর রহমান বলেন, ‘খুনের সঠিক পরিসখ্যাংন আমাদের কাছে নেই। তবে পুলিশ যেহেতু দাবি করছে অপরাধ কমেছে সেটা পুলিশি তৎপরতার কারণেই কমেছে। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে সেই সঙ্গে অপরাধের ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। খুন, ডাকাতি, চুরির মতো ঘটনা কমলেও বাড়ছে নারী শিশু নির্যাতন, জঙ্গিবাদ, মাদকের মতো ভয়াবহ অপরাধ।
পুলিশ সদরদপ্তরের পরিসংখ্যান : ২০১৩ সালে ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬১৩টি, ২০১৪ সালে ৬৫১টি, ২০১৫ সালে ৪৯১টি, ২০১৬ সালে ৪০৮টি এবং ২০১৭ সালে ৩৩৬টি। একই বছর দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে এক হাজার ২১টি, ২০১৪ সালে এক হাজার ১৫৫টি, ২০১৫ সালে ৯৩৩টি, ২০১৬ সালে ৭২২টি এবং ২০১৭ সালে ৬৫৭টি।
২০১৩ সালে খুনের ঘটনা ঘটেছে চার হাজার ৩৯৩টি, ২০১৪ সালে চার হাজার ৫১৪টি, ২০১৫ সালে চার হাজার ৩৬টি, ২০১৬ সালে তিন হাজার ৫৯১টি এবং ২০১৭ সালে খুনের ঘটনা কমে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫৪৯টিতে।
দাঙ্গার ঘটনাও তুলনামূলক কমেছে। ২০১৩ সালে সারাদেশে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল ১৭২টি। আর ২০১৪ সালে কমে দাঁড়ায় ৮৯টিতে। তবে ২০১৫ সালে দাঙ্গার ঘটনা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩টিতে। ২০১৬ সালে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে ৫৩টি এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৩টি।
অপহরণের ঘটনাও তুলনামূলক কমেছে। ২০১৩ সালে অপহরণের ঘটনা ঘটেছিল ৮৭৯টি, ২০১৪ সালে ৯২০টি, ২০১৫ সালে ৮০২টি, ২০১৬ সালে ৬৩৯টি এবং ২০১৭ সালে ৫০৯টি।
২০১৩ সালে পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে এক হাজার ২৫৭টি, ২০১৪ সালে ৭০২টি, ২০১৫ সালে ৬৩৪টি, ২০১৬ সালে ৫২১টি এবং ২০১৭ সালে ৫৪৩টি। ২০১৩ সালে সিঁধেল চুরি হয়েছিল দুই হাজার ৭৬২টি, ২০১৪ সালে দুই হাজার ৮০৯টি, ২০১৫ সালে দুই হাজার ৪৯৭টি, ২০১৬ সালে দুই হাজার ২১৩টি এবং ২০১৭ সালে দুই হাজার ১৬৩টি। ২০১৩ সালে চুরি হয়েছিল সাত হাজার ৮৮২টি, ২০১৪ সালে সাত হাজার ৬৬০টি, ২০১৫ সালে ছয় হাজার ৮১৯টি, ২০১৬ সালে ছয় হাজার ১১০টি এবং ২০১৭ সালে পাঁচ হাজার ৮৩৩টি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ