শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ভোটাধিকার ফিরে পাবার প্রত্যাশা

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ শুরু হলো। খুব দ্রুত সময়েই যেন বছরটি শেষ হলো। গেল বছরে বাংলাদেশে বড় ধরনের অঘটন না ঘটলেও পৃথিবীতে অনেক ঘটনা ঘটেছে। এতো ঘটনা ঘটতে থাকে যে, মানুষের পক্ষে সময়ের হিসাব-নিকাশ করে জীবন সাজানো কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে আন্দোলন সংগ্রাম না থাকলেও বিরোধী মত দমন ছিল অব্যাহত। সভা-সমাবেশে ছিল অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। এতসব কিছুর পরও নতুন বছর নতুন প্রত্যাশায় জেগে ওঠে। জীবন নতুন সময়ের বৃত্তে আবর্তিত হয়। ২০১৮ সময়বৃত্তে শুভ কিছু অপেক্ষা করছে এই স্বপ্নে মানুষ বড় বেশি আন্দোলিত হতে চায়। কিন্তু ভালো কিছু নির্মাণ করতে মানুষকেই নিরন্তর চেষ্টা করতে হয়। মানুষের কর্মপ্রচেষ্টায় এগিয়ে চলে পৃথিবী। সেই মানুষই আমাদের আদর্শ। ভালো মানুষ, আদর্শ মানুষ ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাবে এই প্রত্যাশা নিয়ে নতুন বছরের পথ চলা শুরু হলো। কিন্তু বাস্তবতা যেন আরো বেশি নিষ্ঠুর। বিরোধী সমর্থক ও সরকারের সমালোচকদের পাশাপাশি সর্বত্র হয়রানি ও নাজেহাল হওয়া একটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা মানুষকে হরহামেশা বিপন্ন করে তুলেছে। নতুন বছর বিপন্নতা ও বিষন্নতা মুক্ত হবে এই প্রত্যাশা আমাদের। তবে সেটি কি হবে? যেহেতু ২০১৮ সালেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তাই এবছরটাতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যে স্বাভাবিক থাকবেনা সেটি শুরুতেই আঁচ করা যাচ্ছে।
বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ভোটারবিহীন ৫ জানুয়ারির গণতন্ত্র হত্যা দিবসের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার অভিযান চলে। আবেদন করে সমাবেশের অনুমতি পায়নি বিএনপি। প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিলেও সেটিও করতে দেয়নি সরকার। বছরের শুরুতে সরকারের এমন আচরণে নতুন বছরটাতে যে রাজনৈতিক উত্তাপ অনেক বেড়ে যাবে তা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলা ছিল আলাচনার বিষয়। এর সাথে সরকারি দলের সমর্থকদেরই জড়িত থাকার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বছরজুড়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের অপকর্ম ও দুনীতি ছিল আলোচনার শিরোনামে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা দেশের ভাবমূর্তি একেবারে শেষ করে দিয়েছে। বছরের শেষের ঘুষ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর একটি বক্তব্যে সারাদেশে তোলপাড় দেখা দেয়। বিচার বিভাগ নিয়ে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল ২০১৭ সালে। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপে প্রধানবিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গেল বছরে বাংলাদেশে মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গাদের প্রবেশ ছিল আলোচিত ঘটনা। তবে সরকার প্রথম দিকে নেতিবাচক ভূমিকায় থাকলেও বিএনপিসহ বহিবিশ্বের চাপে তাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে কুটনৈতিকভাবে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এখন নাকাওয়াস্তে একটি লোকদেকানো চুক্তি করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলা হচ্ছে।
এসব ঘটনা বছর জুড়েই ঘটেছে। তারপরও নতুন বছরের সূচনা মুহূর্তে আমাদের প্রত্যাশা ২০১৮ সাল থেকে সহিংসতা, গণতন্ত্রহীনতা, মানবাধিকার লংঘন, বিরোধী মত দমনবন্ধ্য সহ সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা দেখতে চাই দেশের মানুষ নিরাপদে যার যার ধর্ম পালন করছে। সভা সমাবেশ করছে। দেখতে চাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ায় সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষা পাচ্ছে। অপরাধীদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। নতুন বছরে এসব আশা আর আকাংখায় দুলে উঠুক আমাদের জীবন। ২০১৮ সালে আমরা সরকারি দলের লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট, হামলা, হত্যা, গুম, সহিংসতামুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই। এজন্য দরকার সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। রাজনৈতিক বৃত্তের মধ্যে থেকে সন্ত্রাস করার যে প্রবণতা সেটি প্রতিরোধের জনমত গঠন করতে হবে। 
পুরাতন বছরকে পেছনে ফেলে, চলছে নতুন বছরের হিসাব-নিকাশ। নতুন বছরটা হোক মঙ্গলময়, এই প্রার্থনাই সর্বস্তরে। রাজনীতির সু-বাতাস, অর্থনীতির নতুন কুঁড়ি, আর সমাজে সুখের আলোজ্বলুক এই আমাদের প্রত্যাশা। তবে এমনটি আশা করলেই হবে না। কারণ সরকারের মনোভাবের উপরই অনেক কিছু নির্ভর করছি। বছরের শুরুতেই দেখা দিয়েছিল রাজনৈতিক উত্তেজনার আশঙ্কা। একদিকে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অন্যদিকে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ছাত্রদল মিছিল করতে গিয়ে গ্রেফতার আর হয়রানির শিকার হচ্ছে। তাদের সমাবমেশের অনুমতি দিয়ে করতে দেয়া হয়নি। যদিও শেষ বিকেলে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি সভার অনুমতি পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগ তাদের প্রতিষ্ঠাবাষির্ক পালন করেছে জাঁকজমকপূর্ণভাবে। রাস্তা অবরোধ করে র‌্যালী হলেও তাতে কোনো সমস্যা হয়নি। ৫ জানুয়ারি নিয়ে ছিল আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের দুই মেরুতে অবস্থান। সরকারি দলে একে গণতন্ত্র বাঁচানোর দিন হিসেবে পালন করলেও বিএনপি’র কর্মসূটি পালন করতে দেয়া হয়নি। 
সংশ্লিরা মনে করছেন, আঠারোর রাজনীতির মাঠ গরম করবে নির্বাচনগুলো। বিশেষ করে বছরের শেষের দিকে হতে পারে জাতীয় নির্বাচন। এর আগে রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গত নির্বাচন বর্জন করা বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ দল নির্বাচনে অংশ নেবে বলে ঘোষণা দিলেও তারা শর্ত জুড়ে দিয়েছে। তারা বলছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে কোনো নির্বাচন হবেনা। এমনকি তারাও সেই নির্বাচনে অংশ নেবে না। এছাড়া টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় থাকার চেষ্টাচালাবে আওয়ামী লীগ। তাই এবার তারা মরণকামড় দিতে চাইবে। তাদের টার্গেট থাকবে যেকোনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা। সেটি যেভাবেই হোক। এই যদি বিপরীতমুখী অবস্থা থাকে তাহলে চলতি বছরে হরতাল অবরোধসহ সহিংস ঘটনা ঘটতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো মাঠ দখল করতে সারা বছরই ব্যস্ত থাকবেন।  রাজনৈতিক নেতাদের এই অধিক রাজনৈতিক তৎপরতা, রাজনৈতিক বাতাসকে করে তুলবে আরো উত্তপ্ত। সব মিলিয়ে বলা যায়, আঠারো রাজনীতির, রাজনীতির আঠারো!
আবার অনেকেই বলছেন, নতুন বছরে জাতীয় রাজনীতিতে নতুন হাওয়া বইছে। বিএনপি’র জন্য এটিকে বসন্তের বাতাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা এ সময়টাকে তাদের জন্য ‘দুঃসহ’ বলে মনে করছেন। আওয়ামী লীগের সুখের দিনগুলো যেন একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চার বছর পার হলো। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা প্রায়ই টিটকিরি দিয়ে বলতেন, ‘ট্রেন মিস করে ফেলেছে বিএনপি। এখন কান্নাকাটি করলে চলবে না। ট্রেন ঘুরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সেই নির্বাচনী ট্রেন আবার ঘুরে এসেছে। এবার আর বিএনপিকে ফেলে রেখে একা ট্রেনে উঠা সম্ভব নয়। বিএনপিসহ বিরোধী জোট যে রকমের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং পরিকল্পিতভাবে এগুচ্ছে তাতে ট্রেনের প্রায় পুরো জায়গা তারাই দখল করে নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের উপেক্ষা করা তো সম্ভব হচ্ছেই না, উল্টো পুরো জায়গা দখল হওয়ার উপক্রম- বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগ নেতাদের। যদিও মামলার সাজাসহ নানা কায়দায় বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার একটা পরিকল্পনা সরকারের মধ্যে এখনও আছে, কিন্তু সেটি আদৌ বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতাটা ছিল ভিন্ন। বিএনপির সাংগঠনিক ভিত এবং জনসমর্থন অবশ্য তখনও ছিল। কিন্তু, রাজনীতির নানামুখী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য মোকাবেলা করার মতো তাদের সুষ্ঠু কোনও পরিকল্পনা ছিল না। অগোছালো কায়দায় কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি তখন। সেই সুযোগটিই নিয়েছে সরকার। নানা ইস্যুর ‘টোপ’ দিয়ে বিরোধীদলের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে দিয়েছিল সরকার। মারপিট দিয়ে নির্বাচনের আগেই নানা ইস্যুতেই অনেকটা কাবু করে ফেলেছিল বিএনপি-জামায়াতকে। বিদেশি সমর্থনও প্রকৃত অর্থে কেউই বিএনপির পক্ষে ছিল না।
পশ্চিমারা ওই সময় ডুয়েল রোল প্লে করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। বিএনপি তখন সেটি বুঝতে পারেনি। অন্যদিকে চীন-ভারত এই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের কোনোটিই বিএনপির পাশে ছিল না। ভারত সরাসরি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বহাল রাখার ব্যাপারে কাজ করেছিল। চীনও ব্যবসায়িক স্বার্থসহ নানা কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল। কিন্তু, এখনকার বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরিবেশ এখন বিএনপিমুখী। দেশের মধ্যেও ভেতরে ভেতরে, অনেকে বাইরে প্রকাশ্যেই বিএনপি’র দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। তাছাড়া জনসমর্থনও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে বিএনপি’র। সাংগঠনিক দুর্বলতাও দ্রুত কাটিয়ে উঠছে।
ই-মেইল: [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ