মৈত্রী ট্রেনে বিএসএফ-এর অসভ্যতা
ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতা থেকে মৈত্রী ট্রেনে ঢাকা আসার সময় একজন বাংলাদেশি নারী শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন। এই অসভ্য কান্ডটি করেছে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর এক অস্ত্রধারী সৈনিক। দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া খবরে জানানো হয়েছে, গত সোমবার বাংলাদেশের এই নারী তার স্বামী ও সন্তানসহ কলকাতার চিৎপুর স্টেশন থেকে ঢাকাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠেছিলেন। ট্রেন রওয়ানা দেয়ার কিছু সময় পর তিনি ট্রেনের টয়লেটে যান। আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা বিএসএফ-এর সৈনিক সেখানেই বাংলাদেশি নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে এবং মুখ চেপে ধরে সে ওই নারীর শ্লীলতাহানি করে। ভীত হয়ে পড়লেও নারী চিৎকার করতে থাকেন। তার চিৎকারে ট্রেনের অন্য যাত্রীরা এগিয়ে যান এবং বিএসএফ সৈনিকের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে বিপন্ন নারীকে উদ্ধার করেন। ধস্তাধস্তির সময় নারীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক আঘাত লাগে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ট্রেনের সকল যাত্রীর মধ্যে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়লেও ভারত সরকার এবং ট্রেন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বিএসএফ-এর ওই বদমাশ সৈনিক বরং নিরাপদে সরে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ভারত সীমান্তের গেদে স্টেশনে যাত্রা বিরতির সময় ওই নারীর স্বামী সেখানে দায়িত্বে নিয়োজিত বিএসএফ কর্মকর্তাদের কাছে নালিশ জানিয়েও কোনো ফল পাননি। বিষয়টি জানাজানি হয় বাংলাদেশের ভেতরে দর্শনা আন্তর্জাতিক রেলস্টেশনে পৌঁছানোর পর। অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় স্ত্রীর সম্ভ্রমের কথা বিবেচনা করে ওই নারীর স্বামী নীরব থাকতে চাইলেও অন্য যাত্রীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তখন দর্শনার ইমিগ্রেশন ওসির কাছে তিনি ঘটনার বিবরণসহ রিপোর্ট করেন। কিন্তু ইমিগ্রেশনের কর্তাব্যক্তিরাও সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হননি। রেল স্টেশনের সুপারিনটেন্ডেন্ট বরং বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অবশ্য সাংবাদিকদের চাপের মুখে অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বিষয়টি সম্পর্কে প্রথমে মৌখিকভাবে এবং পরে লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। বিএসএফ-এর ওই বদমাশ সৈনিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা এবং তারা সেজন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো দাবি জানিয়েছেন কিনা এসব বিষয়ে তিনি অবশ্য কিছু জানাতে পারেননি। বলার অপেক্ষা রাখে না, কলকাতায় মৈত্রী নামের এক্সপ্রেস ট্রেনে বাংলাদেশি নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা শুধু নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য নয়, সকল বিচারে অত্যন্ত আপত্তিজনকও। আমরা এর বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি বিএসএফ-এর অভিযুক্ত সৈনিকের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও জোর দাবি জানাই। এই ব্যবস্থা নেয়ার প্রধান দায়িত্ব ভারতের হলেও বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে দায়িত্ব এড়াতে পারে না। আমাদের আপত্তির কারণ শুধু শ্লীলতাহানির একটি ঘটনার জন্য নয়। বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশিদের হত্যা ও নির্যাতন করার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় দু’-একদিন পরপর নিয়মিতভাবেই বিএসএফ-এর সৈনিকরা নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা করে চলেছে। প্রসঙ্গক্রমে কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানীর কথা স্মরণ করতেই হবে। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ফেলানীকে পয়েন্ট ব্ল্যাংক দূরত্ব থেকে গুলি করে হত্যা করার পর কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিল বিএসএফ। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববাসী প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও এবং দীর্ঘ সাত বছর পেরিয়ে গেলেও আজও পর্যন্ত খুনি অমিয় ঘোষকে কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। ভারত বরং নানা অজুহাতে বিচারের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। অন্যদিকে কোনো হত্যারই বিচার না হওয়ার সুযোগ নিয়ে বিএসএফ-এর খুনি সৈনিকরা নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় একই বিএসএফ-এর একজন বদমাশ সৈনিক এবার বাংলাদেশি একজন নারীর শ্লীলতাহানি করেছে। সেটাও আবার এমন এক মৈত্রী ট্রেনে করেছে, যে সার্ভিসটি দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব আরো গভীর করার ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়ে চালু করা হয়েছিল। আমরা মনে করি, ভারত ও বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থেই বিএসএফ-এর ওই বদমাশ সৈনিকের বিরুদ্ধে অবিলম্বে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার, যাতে আর কারো পক্ষে এ ধরনের অপরাধের চিন্তা পর্যন্ত করা সম্ভব না হয়। অমন ব্যবস্থা না নেয়া হলে বিশেষ করে বাংলাদেশের নারী যাত্রীদের মধ্যে মৈত্রী ট্রেন সম্পর্কে ভীতি ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়বে এবং তার ফলে মৈত্রী ট্রেন সার্ভিস চালু করার প্রধান উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমরা তাই বিএসএফ-এর অভিযুক্ত সৈনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এবং দু’ দেশের সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবে উন্নত করার আহ্বান জানাই।