শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

জনগণ ও বিরোধী জোটের প্রতিক্রিয়া দেখার কৌশল

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল: গতকাল শুক্রবার থেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেছে। অন্যদিকে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলছে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রায় দেয়ার আয়োজন। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায় ঘোষণা করবে ঢাকার পঞ্চম জজ আদালত। একদিকে ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী প্রচারণা উৎসব অন্যদিকে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ একটি পরীক্ষা করতে চায়। তাদের টার্গেট হচ্ছে বিএনপিকে ছাড়াই আবারো একটি নির্বাচনের আয়োজন করা অথবা ক্ষমতাসীনদেও অধীনেই বিএনপিকে নির্বাচনমূখী করা, বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ভীতির সঞ্চার করা। একইসাথে বিরোধী জোটকে একটি ম্যাসেজ দেয়া, সেটি হচ্ছে, নির্বাচন হয়ে যাবে। কে আসলো, না আসালো তাতে কিছু যায় আসেনা। সর্বোপরি এর মাধ্যমে তারা বিরোধীদলের শক্তি পরীক্ষা করতে চায়। সরকার যেভাবে একতরফা নির্বাচন করতে চাচ্ছে তা প্রতিহত করার ক্ষমতা বিরোধী জোটের আছে কিনা সেটি যাচাই করা। নির্বাচনী প্রচারণার নামে আওয়ামী লীগ তাদের মাঠও যাচাই করে নিবে।
সূত্র মতে, গতকাল থেকে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ তাদের সাংগঠনিক সফর শুরু করেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে গতিশীল ও নির্বাচনমুখী করার প্রত্যয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এই সাংগঠনিক সফরে অংশ নেবেন। এই সফরকে সফল করতে দলের উপদেষ্টা পরিষদ ও সভাপতিম-লীর সদস্যদের নেতৃত্বে ১৫টি টিম গঠন করা হয়েছে। সফরকালে কেন্দ্রীয় নেতারা মহানগর, জেলা, উপজেলা ও থানা পর্যায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশ, জনসভা, কর্মিসভা ও বর্ধিতসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দেবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে দেশব্যাপী এই সাংগঠনিক সফর সফল করার লক্ষ্যে সহযোগিতা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সফরের প্রথম দিনেই ক্ষমতাসীন দলের নেতারা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বক্তব্যের মূল অংশই থাকছে খালেদা জিয়ার মামলা রায় নিয়ে। খালেদা জিয়ার পুরো পরিবারকেই ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ পরিবার বলে আখ্যা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, দুর্নীতির মামলার রায়ের প্রহর গুণছে খালেদা জিয়া। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব এই দুর্নীতিগ্রস্ত খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে পরিহার করে, বিশ্বের স্বীকৃত সৎ ও কর্মঠ নেত্রী মানবতার বাতিঘর শেখ হাসিনার উপর আস্থা রাখা। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক জেলা সফরের প্রথম দিনে শুক্রবার বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক কর্মীসভায় তিনি এসব কথা বলেন। জেলার সার্কিট হাউজের সামনের খোকন পার্কে এ কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। খালিদ বলেন, এদেশে দুর্নীতির গোড়াপত্তন করেন জিয়াউর রহমান। দুর্নীতির উপর ভর করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিএনপির জন্ম। জিয়া মারা যাওয়ার পর খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় টাকা নিলেও তার দুই ছেলেকে মানুষ করতে পারেননি।
মামলার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন করতেই সরকার আদালতের মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায় দেওয়াচ্ছে। সরকার যে আবারো একটি একতরফা নির্বাচনের ষড়যন্ত্র করছে এটিই তার প্রমাণ। তিনি বলেন, নজিরবিহীন তাড়াহুড়ার মধ্যে দ্রুততার সাথে এই মামলা শেষ করার চেষ্টা চলেছে। দেশনেত্রীর আইনজীবীরা পরিষ্কার করে বলেছেন যে, জাস্টিস হারিড ইজ জাস্টিস বারিড। কারণ তারা (ক্ষমতাসীন) কর্ণপাত করছেন না। তারা ডিটারমিনড যে, তারা আগামী নির্বাচন করতে চান বিএনপিকে বাদ দিয়ে এবং সেজন্যই তাড়াহুড়া করে বিচার কাজ শেষ করা।
সূত্র মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে এক তরফা নির্বাচন করেছিল। যে নির্বাচনে তারা নিজেরাই সন্তুষ্ট ছিলনা। দলটি পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে সেটি ছিল নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। শীঘ্রই সবাইকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের কথা রাখেনি। তারা জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখে। অভিযোগ উঠেছে, এবারো তারা ২০১৪ সালের ন্যায় একতরফা নির্বাচনের চেষ্টা করছে। কারণ তারা যদি সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করার টার্গেট থাকতো তাহলে এককভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করতো। বিরোধী জোটের সাথে আলোপ আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের উদ্যোগ নিতো। এছাড়া তড়িঘড়ি করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় রায় দেয়ার কথা বলতো না। কারণ এরকম মামলা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিুরদ্ধেও করা হয়েছিল। তার মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হলে বিএনপি চেয়ারপার্সনসহ বিরোধী নেতাদেও বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি। বরং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মামলা দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু দেশের প্রধান বিরোধী জোটকে মামলা হামলায় ব্যস্ত রেখে নিজেরা এককভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো কোনভাবেই রাজনৈতিক সূলভ আচরণ হতে পারেনা। নিজেরা মাঠে না নেমে সবাইকে নিয়ে প্রচারণা শুরু করতো। অনেকেই বলছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা শুধুই লোক দেখানো। এর মাধ্যমে তারা বিরোধী জোটকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে। তারা দেখতে চাইছে, এই অবস্থায় বিএনপিসহ বিরোধী দল গুলো নির্বাচনে আসে কিনা। এছাড়া মানুষের মধ্যে এর প্রভাব কি হতে পারে। জনগণ যদি ২০১৪ সালের ন্যায় চুপ থাকে তাহলে তাদের আবারো একতরফা নির্বাচনে কোনো বাধা নেই। কে কি বলল তাতে আওয়ামী লীগের কিছু আসে যায়না।
সূত্র মতে, ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছিল বিএনপি তথা বিরোধী জোটের আন্দোলনের কোনো ক্ষমতা নেই। গতকাল শুক্রবারও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির আন্দোলন করার মুরদ নেই। তাদের প্রতিপক্ষ তারা নিজেরাই। তাই নিজেদের ঘরই সামলাতে হবে। তারা বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছেনা। বিএনপি প্রতিবাদে কোনো কর্মসূচিও দেয়না। প্রতিনিয়ত মামলা দিচ্ছে। গ্রেফতার-নির্যাতন তো নিয়মিত ঘটনা।
পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, সরকারের এমন আচরণ ঠিক নয়। বিরোধী দল আন্দোলন করতে পারেনা এটি সঠিক নয়। কারণ বিরোধী জোট আন্দোলন করলে ক্ষমতাসীনরা এটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে। গাড়িতে আগুন দিয়ে, হামলা চালিয়ে, ভাংচুর করে সেটিকে বিরোধী জোটের উপর চাপিয়ে দেয়া একটা সফল কৌশল। বিভিন্ন মিডিয়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের সাথে ক্ষমতাসীন দলের জড়িত থাকার খবর ও ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। এসবের কোনো তদন্ত কোনো বিচারও হয়নি। হরতালে সরকারি দলের মালিকানাধীন গাড়িই চালানো হয়। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ভাংচুর করা হয়। নরসিংদী লাইনের গাড়ি পোড়ানো হয়েছে আজিমপুরে। এভাবে হিংসাত্মক কাজ করে সরকার মামলা দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের ঘায়েল করেছে। সরকারি দল বিরোধী নেতাকর্মীদেও বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। এবারো তারা সেটিই চাচ্ছে। আন্দোলনে মাঠে নামলেই মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীতে বিরোধীদের সাথে এমন আচরণ করা হয়নি। ২০০৮ সালের আগেও এমনটি ছিলনা। তত্ত্বাবধায়কসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছে। কিন্তু ২০০৮ সালে আঁতাতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিরোধী দলকে দমনে নিজেরাই হিংস্মাত্বক কাজ করছে। এবারো তারা সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একটি রায় দিয়ে তারা মাঠ উত্তপ্ত করতে চায়। এর মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইনশৃঙাখলা বাহিনীকে দিয়ে নেতাকর্মীদের হয়রানি করতে চায়।
জানতে চাইলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, আগামীতে সঠিকভাবে ভোট হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে না, আর যদি যায় তাহলে আমি হাতে চুড়ি পরবো। এখন তো বিএনপি পালিয়ে আছে কিন্তু আওয়ামী লীগ পালিয়েও বাঁচবে না। তিনি বলেন, বিরোধীদলকে নানাভাবে ব্যস্ত রেখে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছে তা কোনদিনই পূরণ হবেনা। ২০১৪ সালের ন্যায় একতরফা নির্বাচন এবার কেউই মেনে নিবেনা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ