বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ (সা:)

-সাদিকা সুলতানা
(পূর্ব প্রকাশের পর)
“নিশ্চয়ই রাসুল (সা:) এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।” (সুরা আহযাব-২১)          
উক্ত আয়াত রাসুল (সা:) এর সার্বিক জীবন নিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সাক্ষ্য। আর রাষ্ট্র ব্যবস্থা তার জীবনেরই একটি অধ্যায়।                           
আদর্শ রাষ্টের শুরুর ইতিহাস বা আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস :
 পৃথিবীতে কোন মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য “রাষ্ট্রশক্তি”-র প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। মহান আল্লাহ রাসূল (সা:) কে পৃথিবীর অন্য সকল মতাদর্শের উপর দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য প্রেরণ করেছেন। কুরআনের ঘোষণা -
“তিনি আল্লাহ! তাঁর রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন, যেন তাকে অন্যান্য সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করতে পারেন।” (সূরা সফ-৯)
কোন আদর্শ কে বিজয়ী বা প্রতিষ্ঠিত করার অর্থ এই যে, তার প্রতি যাবতীয় কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করা এবং তার বিপরীত আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা।            
 আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা হলো, “হে নবী বলে দাও যে, হে আহলি কিতাব! তোমরা কোন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নও, যতক্ষণ না তাওরাত ও ইঞ্জিল কে প্রতিষ্ঠিত করবে।”     
 আল্লাহ ঘোষিত নির্দেশনার আলোকে মুহাম্মদ (সা:) তার জন্মভূমি মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে আল্লাহর হুকুমে প্রাচীন ইয়াসরিব নগরে হিজরত করেন এবং ইয়াসরিব কে মদিনা নামে নামকরণ করে সেখানে আদর্শ রাষ্ট্রের সূচনা করেন।                                      
আদর্শ রাষ্ট্রের কার্যাবলী :
সূরা হজ্বের ৪১ নং আয়াতের আলোকে, ইসলামী রাষ্ট্রের কার্যাবলী হলো:
১. নামাজ প্রতিষ্ঠা করা
২. যাকাত আদায় করা
৩. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ প্রদান।
সূরা বনী ইসরাইলের ২৭-৩৭নং এর আলোকে :          
১. শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করা।
২. পিতা মাতার প্রতি উত্তম আচরণ করা।
৩. নিকটাত্মীয়, মিসকিন ও সহায়- সম্বলহীন পথিকের অধিকার প্রদান।
৪. অপচয় -অপব্যয় না করা।
৫. নিকটাত্মীয়,মিসকিন ও সম্বলহীন পথিকের বিনয় সুচক জবাব দেয়া।
৬. খরচের বেলায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা।
৭. দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা না করা।
৮. যেনার নিকটবর্তী না হওয়া।
৯. ইয়াতিমের সম্পত্তি আত্মসাৎ না করা।
১০. ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা।
১১. সঠিক পন্থায় ওজন করা।
১২. যে বিষয়ে মানুষের জ্ঞান নেই তার পেছনে না ছোটা।
১৩. জমিনে অহংকারী ভাবে না চলা।  
আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মুহম্মদ (সা):
হযরত মুহম্মদ (সা:) আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে যেভাবে ভুমিকা পালন করেন-       
(১) শিক্ষা ব্যবস্থায় আদর্শ :
পবিত্র কুরআনের প্রথম বাণী “ইকরা” অর্থাৎ “পড়ো”। তাই রাসূল (সা:) তাঁর জনগণকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সর্বদা তৎপর ছিলেন।
তিনি সার্বক্ষণিক শিক্ষক ছিলেন। এমনকি মসজিদে নববীকে তিনি একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছিলেন। বদরের যুদ্ধে শিক্ষিত মুশরিকদের অশিক্ষিত মুসলিমকে শিক্ষা দিয়ে মুক্ত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন।        
(২) জনতার স্বতঃস্ফুর্ত অগ্রযাত্রা :
মুহাম্মদ (সা:) তাঁর বিপ্লবী আদর্শবাদী আন্দোলনকে দুটি পর্বে ভাগ করেছিলেন। প্রথম পর্বে তিনি নিজে জনগণের দ্বারে দ্বারে ইসলামী আদর্শের প্রতি আহবান করেছিলেন।
আর দ্বিতীয় পর্বে জনতা স্ব-উদ্যোগে ও স্বতঃস্ফুর্তভাবে সামনে এগিয়ে এসেছিল এবং ইসলামের দরজায় করাঘাত করে বলেছিল, আমরা ভেতরে আসতে চাই। কিন্ত এই পর্বে আসার পূর্বে রাসূল (সা:) ও সাহাবীগণ অনেক কষ্ট ভোগ ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন।            
(৩) নৈতিকতা সম্পন্ন লোক তৈরি বা মুসলমানদের নৈতিক শক্তি বলে বলীয়ান : 
নৈতিক শক্তিই কোন আন্দোলনকে প্রভাবশালী ও কার্যকরী করতে এবং বিজয়ী করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই রাসূল (সা:) নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ তৈরীর আসল কাজ থেকে কখনো উদাসীন হননি।
সেজন্য সে সমাজের মানুষ মদ্যপান, জুয়ার আড্ডা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ফেতনা-ফাসাদ, হত্যা-লুটতরাজ ও প্রতিশোধ গ্রহণের কাজে ব্যবহৃত হতো। সে সমাজে রাসূল (সা:) এমন একদল সৎ, শুদ্ধ ও সুসভ্য মানুষের আবির্ভাব ঘটালেন, যারা সকলের দৃষ্টিতে ভিন্নতর ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিল।
ফলে যে ব্যক্তি কিছুদিন আগে রাসূল (সা:) এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করেছে, সে সহসাই ইসলামের কাছে মাথানত করে দিয়েছিল।                                    
(৪) সাংবিধানিক চুক্তি :
রাসূল (সা:) নিজের ইস্পাতে আদর্শিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলোর পক্ষে সব শ্রেণীর ও সম্প্রদায়ের লোকদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে  “সাংবিধানিক চুক্তি ” লিপিবদ্ধ করেন। সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছিল যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো-  
● শুরু হয়েছিল- “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” দিয়ে। শিরোনাম ছিলো-
“এ দলীল রাসূল (সা:) কর্তৃক জারীকৃত”।
সূচনাতেই এভাবে ইসলামের মৌলিক মতাদর্শের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সংবিধানে। এটা ছিলো ৫৩ টি ধারা সম্বলিত।                                  
(৫) বিপ্লবী শিক্ষা প্রদান :
 হযরত মুহাম্মদ (সা:) চরম নাজুক ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ইসলামী আদর্শের দাওয়াত প্রচারের কাজ স্বচালিত রাখার জন্য কিছু সাহাবীকে বিপ্লবী শিক্ষা প্রদান করতেন। যারা শিক্ষা গ্রহণ করত তাদের উদ্দেশ্য ছিলো আল্লাহর বাণী ও বিধানকে সমুন্নত করা এবং মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করা।                                               
(৬) জনগনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি :     
কোন মতাদর্শ যদি অস্ত্রের বলে ক্ষমতাও দখল করে, কিন্তু মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে না পারে, তাহলে নিছক নৈতিক সংশোধন ও পুনর্গঠনের উপদেশ গ্রহণে মানুষ তৈরি হতে পারে না, বরং তারা সে কাজকে আপদ মনে করে অব্যাহতি লাভ করতে চায়। এ জন্য রাসূল (সা:) যে আন্দোলন করেছিলেন তা একদিকে মানুষের হৃদয়কে ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত ও আত্মাকে নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ  করত এবং অপর দিকে পেটের খাদ্য সরবরাহের সর্বোত্তম ব্যবস্থাও ছিলো।                                       
(৭) বিভিন্ন গোত্রের সাথে চুক্তি :  
রাসূল (সা:) ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্হাপনের চেষ্টার পাশাপাশি আশপাশের গোত্রগুলোকেও সংঘবদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। দু'তিনবার তিনি এসব গোত্রের কাছে সাহাবীদের সমন্বয়ে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিলেন। এমনকি হিজরতের দ্বাদশ মাসে রাসূল (সা:) নিজেই ওয়াদ্দান গমন করেছিলেন।
 (৮) অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীল :
একবার এক ইহুদি মসজিদে নববীতে পেশাব করা শুরু করলে সাহাবীরা তাকে মারতে উদ্যত হলে রাসূল (সা:) বাধা দিলেন। লোকটি কাজ সেরে ফেলার পর রাসূল (সা:) তাকে বললেন- “তোমার দ্বীনের পবিত্র স্থানে কেউ এমন করলে কি করবে??” তখন লোকটি এতে লজ্জিত হলো। রাসূল (সা:) তাকে ক্ষমা করলেন।                                   
(৯) বেকারকে বা ভিক্ষুককে কর্মী হতে উদ্বুদ্ধকরণ: 
রাসূল (সা:) হীন ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ করেছেন। একদা এক ব্যক্তিকে তার শেষ সম্বল দিয়ে কুঠার কিনে দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করান এবং কর্মসংস্থানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে অনুসরণীয় আদর্শ সৃষ্টি করেন।।     
দার্শনিক মাইকেল হার্ট যথার্থই বলেছেন--
“আমি বিশ্বাস করি অশান্তির বিশ্বে শান্তি আনতে হলে সমগ্র বিশ্বের একক ক্ষমতা আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক রাসূল (সা:) এর হাতে অর্পণ করলেই তা শুধু সম্ভব”।        
সত্যিই তাই-ই!!
১৪শ বছর পূর্বে আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সা:) বিশ্বের রাষ্ট্র প্রধানদের জন্য যে আদর্শ স্হাপন করে গিয়েছেন আজকের বিশ্ব তীব্রভাবে তাঁর অভাব অনুভব করছে। আজ পৃথিবীর দেশে দেশে রাষ্ট্র প্রধানদের শাসন-শোষণে মজলুম মানুষ একজন আদর্শ রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য আর্তনাদ করছে। 
তাই পৃথিবীর এই মজলুম মানুষদের জুলুম নির্যাতন থেকে উদ্ধার করতে আমরা এই কামনা করতে পারি যে, নির্যাতিত মানুষকে উদ্ধার করতে এমন কোন মহান ব্যক্তিত্ব কেউ এগিয়ে আসুক যিনি আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক মুহাম্মদ (সা:) কে অনুসরণের মাধ্যমে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন। (সমাপ্ত)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ