বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আদালতে দেয়া খালেদা জিয়ার লিখিত বক্তব্য ॥ আপনি নির্ভয়ে সুবিচার করবেন

স্টাফ রিপোর্টার: আদালতে বিচারের উদ্দেশ্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টসহ অন্যসব মামলায় আমাকে যেভাবে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে তা সমগ্র দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে। আপনি জানেন যে, আমাদের বিচার-ব্যবস্থা নিয়ে দেশে-বিদেশে সবখানে আলোচনা চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশের ফৌজদারী বিচার-ব্যবস্থা নিয়ে সম্প্রতি বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। আমি আশা করি, আপনি এসব অনাস্থার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করবেন। প্রমাণ করবেন, বাংলাদেশের বিচার-ব্যবস্থা ন্যায়ের মানদন্ডে পরিচালিত হয় এবং এখানে ন্যায়-বিচারক আছেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে : "Not only must Justice be done, it must also be seen to be done." আমি আবারও পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমি সজ্ঞানে, জ্ঞানত, জ্ঞাতসারে কোনো অন্যায় করিনি এবং আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আপনি নির্ভয়ে আমার এ বক্তব্যকে গ্রহণ করে সুবিচার করবেন, সঠিক রায় দেবেন এবং আমাকে নির্দোষ ঘোষণা করবেন- এ আমার প্রত্যাশা। আদালতে যুক্তিতর্ক চলাকালে বিচারপতির উদ্দেশ্যে এভাবেই নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন সাবেক তিনবারের এ প্রধানমন্ত্রী। নীচে আদালতে দেয়া খালেদা জিয়ার লিখিত বক্তব্য তুলে ধরা হলো।
মাননীয় আদালত, আসসালামু আলাইকুম।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা স্মরণ করে আমার কথা শুরু করছি। এদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছিল আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য।
শহীদ জিয়াউর রহমান সেই সব লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
সেই সকল লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানুষ অকাতরে জীবন দিয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে।
স্বাধীনতার সেই সব লক্ষ্য আজ পদদলিত।
সারা জাতি আজ লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত।
সমগ্র বাংলাদেশকেই আজ এক বিশাল কারাগার বানানো হয়েছে।
সবখানেই চলছে অস্থিরতা ও গভীর অনিরাপত্তাবোধ।
মিথ্যা ও সাজানো মামলায় বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী এই মুহূর্তে কারাগারে বন্দী।
বিএনপি’র প্রায় ৭৫ হাজার নেতা-কর্মী বিভিন্ন মেয়াদে কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন।
আমাদের দলের ৪ লাখের বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ২৫ হাজারের মতো মামলা দায়ের করা হয়েছে।
নির্যাতন, হয়রানি ও গ্রেফতারের ভয়ে বহু নেতা-কর্মী বাড়ি-ঘরে থাকতে পারেন না। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
গুম, খুন, অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বিরোধী দলের অসংখ্য নেতা-কর্মী। তাদের ঘরে ঘরে আজ কান্নার রোল।
এখন সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বড় বেশি বলা হয়। কিন্তু কোথায় আজ সাংবিধানিক শাসন?
আমাদের সংবিধান নাগরিকদেরকে যে-সব অধিকার দিয়েছে, কোথায় আজ সে-সব অধিকার?
কোথায় আজ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার?
মাননীয় আদালত,
শহীদ জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নিয়ে বর্তমান মামলায় আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আমি শুনেছি।
আমি জেনেছি মামলার সাক্ষীদের দেয়া বক্তব্য। সবকিছু নিয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আমি আমার জবাব ও প্রাসঙ্গিক বক্তব্য মাননীয় আদালতে তুলে ধরতে চাই। রাষ্ট্রক্ষমতার অবৈধ দখলদাররা চায়নি আমি রাজনীতিতে থাকি। আমি রাজনীতি না করলে তারা আমাকে অনেক বেশি সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছিলো। রাজনীতি করলে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে বলে আমাকে ভয়-ভীতিও দেখানো হয়েছিলো। সবকিছু উপেক্ষা করে আমি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখি।
কারণ, দেশে তখন গণতন্ত্র ছিলো না। জনগণের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়া হয়েছিলো। জনগণের অধিকার ছিলো না।
গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু থেকেই আমাকে রাজপথে নামতে হয়েছিলো।
আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম শহীদ জিয়াউর রহমানের আদর্শের পতাকা হাতে নিয়ে। আমার সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার লক্ষ্য নিয়ে।
আমি সব সময় চেয়েছি, বাংলাদেশ যেন গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হয়। মানুষের যেন অধিকার থাকে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে।
আমি চেয়েছি, আমাদের অর্থনীতি যেন শক্তিশালী হয়। বিশ্বসভায় বাংলাদেশ মর্যাদার আসন পায়। সেই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্যই আমার রাজনীতি।
আমি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দেশ ও জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে একাকার করে ফেলেছি।
আমার নিজের কোনো পৃথক আশা-আকাক্সক্ষা নেই। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাই আমার আশা-আকাক্সক্ষায় পরিণত হয়েছে।
আমার জীবন পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে এদেশের মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যয়ের সঙ্গে। তাদের সুখ-দুঃখ ও উত্থান-পতনের সঙ্গে। দেশের মানুষের জীবনের চড়াই-উৎরাই ও সমস্যা-সংকটের সঙ্গে। তাদের বিজয়, বিপর্যয় এবং সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির সঙ্গে। দেশজাতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গেই একাকার হয়ে গেছে আমার বর্তমান ও ভবিষ্যত।
সম্ভবত সে কারণেই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং এ দেশের মানুষ যখনই দুর্যোগ ও দুর্বিপাকের মুখে পড়েছে, তখন আমিও দুর্যোগের মুখে পড়েছি।
দেশজাতি যখন সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে, অধিকার হারিয়েছে, বিপন্ন হয়েছে তখন আমিও নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছি। আমার পরিবারও পড়েছে নানামুখী সমস্যা-সংকটে।
একইভাবে দেশজাতি যখন বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে, জনগণ যখন বিজয়ী হয়েছে, তাদের হারানো অধিকার ফিরে পেয়েছে তখন আমার নাগরিক অধিকারগুলোও সমুন্নত থেকেছে।
জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদা যখন সমুন্নত হয়েছে, আইনের শাসন-সুবিচার-গণতন্ত্র ফিরে এসেছে, তখন ব্যক্তিগতভাবে আমিও সংকট, বিপদ, আক্রমণ, নির্যাতন ও বিপর্যয় থেকে মুক্ত হতে পেরেছি।
বারবারই প্রমাণ হয়েছে যে, বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে আমার নিজের ও আমার পরিবারের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে।
মাননীয় আদালত,
আপনি নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করা হচ্ছে। জারি করা হচ্ছে গ্রেফতারী পরোয়ানা।
প্রায় চার দশকের স্মৃতিবিজড়িত বসতবাড়ি থেকে আমাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
আমাকে আমার গুলশানের বাসা ও রাজনৈতিক কার্যালয়ে বালির ট্রাক দিয়ে কয়েক দফায় দীর্ঘদিন অবরোধ করে রাখা হয়েছে।
আমি আমার অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় সে সময় বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।
সেই অবরুদ্ধ অবস্থাতেই আমি মৃত্যু-সংবাদ পাই বিদেশে চিকিৎসাধীন আমার একটি সন্তানের।
আর সেদিনই আমার এবং আমার সঙ্গে অবরুদ্ধদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বানোয়াট একটি মামলা দায়ের করা হয়।
অভিযোগ করা হয়, রাস্তায় গাড়ি পোড়ানো এবং বিস্ফোরক দিয়ে মানুষ হত্যার। অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায়ই নাকি আমরা এসব করেছি।
এগুলো কি কোনো সভ্য ও মানবিক আচরণ?
মাননীয় আদালত,
আপনি দেখেছেন, শাসক মহলের নির্দেশে আমার স্বাধীন চলাচল বিভিন্নভাবে ব্যাহত করা হয়েছে।
প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে আমার ওপর বারবার হামলার ঘটনা সারা বিশ্ব দেখেছে। আমার ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয়েছে। আমার গাড়ির ওপর গুলি চালানো হয়েছে।
আমার গাড়ি বহরে সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মী ও নিরাপত্তা রক্ষীরা তাতে আহত হয়েছে। সন্ত্রাসীরা কেউ আটক হয়নি। কোনো ঘটনার বিচার হয়নি আজ পর্যন্ত।
আমার নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়েছে বারবার।
আমার বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে অসত্য ও কুৎসিত অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
এর কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং এদেশের জনগণের বর্তমান সার্বিক দুর্দশার সঙ্গে আমার এসব হেনস্থা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলেই আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস। তাই, মাননীয় আদালত, আমি যত সামান্য মানুষই হই না কেন, আমার প্রতি বর্তমান শাসক মহলের আচরণের কারণ, পটভূমি ও প্রেক্ষাপটের ব্যাপ্তি কিন্তু সামান্য নয়। দেশজাতির দুর্দশা থেকে এটিকে আলাদা করে দেখা যাবে না।
কাজেই আলোচ্য মামলাটি দায়ের এবং এর সকল কার্যক্রম ও পরিণতি কেবল ফৌজদারী বিধিবিধান, আইন-কানুন ও বিচার-ব্যবস্থার মধ্যেই সীমিত নয়। পুরো বিষয়গুলো ব্যাখ্যা না করলে কেবল আইনগত খুঁটিনাটি দিক তুলে ধরে এই মামলাটির সঠিক চিত্র বিশদ ও নিখুঁতভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই মাননীয় আদালত, আমি আপনাকে অনুরোধ করবো আমার কথাগুলো একটু শুনবেন। আমাকে সময় দেবেন, যাতে আমি আমার সব কথা পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরতে পারি।
যাতে আমি পুরো প্রেক্ষাপট ও পটভূমি তুলে ধরতে পারি। দেশের যে পরিস্থিতি, জাতির যে অবস্থা এবং ইতিহাসের যে ধারাক্রম আজকে এ ধরনের মামলা সৃষ্টি করেছে সে কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে। না হলে আমার বক্তব্য ও জবাব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যে কথাগুলো না বললে সব কিছু স্পষ্ট ও পরিষ্কার হবে না, সেই কথাগুলো তো আমাকে এই সুযোগে বলতেই হবে।
মাননীয় আদালত,
দেশে এখন সত্যিকার অর্থে নির্বাচিত কোনো সংসদ ও সরকার নেই। সবকিছু একতরফা ও একদলীয় ভিত্তিতে চলছে।
যে গণতন্ত্রের জন্য মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে সেই গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত।
যে তথাকথিত সংসদ গঠন করা হয়েছে, সেই সংসদের বেশিরভাগ সদস্য নির্বাচিত হয়নি। বাকী সদস্যদেরকেও ভোটাররা নির্বাচিত করেননি। প্রহসনের মাধ্যমে তাদেরকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। শতকরা ৫ জন ভোটারও ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়নি।
প্রহসনের সংসদ এবং সেই সংসদের মাধ্যমে গঠিত সরকার কখনো বৈধ হতে পারে না।
সংসদে কোনো কার্যকর বিরোধীদল পর্যন্ত নেই। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনগুলোতে বিভিন্ন রকম কারসাজি সত্বেও বিরোধী দলের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন।
সেই শোচনীয় পরাজয় দেখে ভীত হয়ে ক্ষমতাসীনেরা আর কোনো ঝুঁকি নেয়ার সাহস পায়নি। এরপর থেকে তারা পৌরসভা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলো পর্যন্ত দখল ও যুদ্ধে পরিণত করেছে। বিরোধী দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তারা মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ ও অপসারণ করছে।
জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সর্বসম্মতিক্রমে আমরা যে ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একতরফাভাবে বাতিল করা হয়েছে। সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে এক গভীর সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে।
আমরা সেই সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করতে চাই। আমরা দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাই। জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাই। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাই। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বদলে শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
এটাই কি আমার অপরাধ? সেই কারণেই কি এতো হেনস্তা, এতো মামলা-মোকদ্দমা আমার বিরুদ্ধে?
মাননীয় আদালত,
আপনি জানেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও চাঁদাবাজিসহ নানান রকম মামলা বিভিন্ন সময়ে হয়েছে।
কিন্তু তার পরম সৌভাগ্য, কখনো তাকে আমার মতো আদালতে এমন করে হাজিরা দিতে হয়নি।
আমি আইন-আদালত ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন নাগরিক।
তাই এই বয়সে এতো ব্যস্ততা ও নানান সমস্যার মধ্যেও যতদূর সম্ভব আদালতে সশরীরে হাজির থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আমার নিযুক্ত আইনজীবীরা আইনানুগ পন্থায় মামলাসমূহ মোকাবিলা করে যাচ্ছেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমি কখনো অনিবার্য কারণে আদালতে উপস্থিত হতে না পারলে আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করার মতো ঘটনা ঘটছে।
আমার পরিচয় দেশবাসী জানে। মাননীয় আদালতেরও অজানা নয়। আমি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পত্নী। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান ঘোষক। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অন্যতম সফল অধিনায়ক।
তিনি বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বাংলাদেশের প্রাক্তণ সেনাপ্রধান।
দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুন:প্রবর্তক এবং জননির্বাচিত ও নন্দিত সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাভাষী সৈনিকদের প্রতিরোধ যুদ্ধে উদ্ধুদ্ধ করার সুযোগ আমাকে ইতিহাস দিয়েছে। এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি সে কর্তব্য পালন করেছি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দু’টি শিশু সন্তানসহ গ্রেফতার হয়ে এই রাজধানীতে আরো অনেকের সঙ্গে চরম অনিশ্চিত ও দুঃসহ বন্দীজীবন আমাকে কাটাতে হয়েছে।
আমাদের বন্দী শিবিরের ওপর বোমা বর্ষণের সময়ে আল্লাহর অসীম রহমতে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরেছি।
কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নয়, এরপর আরো অনেকবারই চরম বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি ও মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও আজো বেঁচে আছি।
প্রায় পৌণে নয় বছর স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজপথে জনগণের কাতারে থেকে গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে আমি নিরাপোস ভূমিকা রেখেছি।
আমি এর জন্য মানুষের অপরিসীম সমর্থন ও দোয়া পেয়েছি।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আসনে জনগণ আমাকে নির্বাচিত করেছে।
বাংলাদেশের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে আমি তিন-তিনবার তাদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছি।
আমি আমার জনগণের সেবা করার চেষ্টা করেছি তাদের অর্পিত দায়িত্ব সাধ্য, সামর্থ ও যোগ্যতা অনুযায়ী পালন করে।
দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়ার এবং মানুষকে দুর্দশামুক্ত করে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করেছি।
উন্নয়নে, উৎপাদনে, শিক্ষায়, নারীশিক্ষায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এবং সন্ত্রাস মুক্তির অভিযানে অবদান রেখে মানুষের জন্য স্বস্তি ও সম্ভাবনার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেছি।
জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার এবং বিচার বিভাগ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি।
দেশকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার নিরলস প্রয়াসে কখনো বিরতি দেইনি।
আমি বিরোধীদলীয় নেত্রীর দায়িত্বও পালন করেছি।
মাননীয় আদালত,
আত্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমি এসব কথা বলছি না। আমার এই অবস্থান, ভূমিকা ও অবদানের বিনিময়ে বাড়তি কোনো সুবিধা বা মর্যাদা দাবি করার কোনো অভিপ্রায়ও আমার নেই। আমি নিজেকে আইন ও বিচারের উর্ধ্বে মনে করিনা। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই যে, একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হয়েও আরেকজন নেত্রী যে-সব সুবিধা ভোগ করেছেন, আমি কখনো আদালতের কাছে তেমন সুবিধা দাবি করিনি । আমি দেশের একজন সাধারণ সিনিয়র সিটিজেনের প্রাপ্য অধিকারটুকু পেলেই খুশি। আইনসম্মতভাবে ন্যায়বিচার ছাড়া মাননীয় আদালতের কাছে আমার চাইবার আর কিছু নেই। আজ আমার প্রতি যে ধরণের আচরণ করা হচ্ছে তা আমার অবস্থান ও ভূমিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা এবং এর মাধ্যমে আমার প্রতি কোনো বৈষম্য করা হচ্ছে কিনা-সেটাও আদালতের বিবেচনার বিষয় বলে আমি মনে করি।
মাননীয় আদালত,
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, শেখ হাসিনার হাতে কোনো এক জাদুর কাঠি আছে।
সেই জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় তার বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতি, অনিয়ম ও চাঁদাবাজিসহ সকল মামলা তিনি সরকারে আসার পর একে একে উঠে গেলো অথবা খারিজ হয়ে গেলো।
আমাদের আর কারো হাতে তেমন কোনো যাদুর কাঠি নেই। কাজেই একই সময়ে আমাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো একের পর এক সচল হয়েছে ও গতিবেগ পেয়েছে। হয়েছে নতুন নতুন আরো মামলা।
আজকের আলোচ্য মামলাটি তেমনই একটি নতুন মামলা। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং বিরোধী দলকে হেনস্তা করার লক্ষ্যে সম্পূর্ণ অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগে এ মামলাটি দায়ের করা হয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে। দেশে কতো গুরুত্বপূর্ণ মামলা বছরের পর বছর ধরে চলছে। কতো মামলা ঝুলে আছে। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে মামলাগুলো পেয়েছে রকেটের গতি। যেন কেউ পেছন থেকে তাড়া করছে, শিগগির শেষ করো। তড়িঘড়ি করে একটা রায় দিয়ে দাও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। কেন, কোন্ উদ্দেশ্যে এবং কিসের জন্য এতো তাড়াহুড়া? এই তাড়াহুড়ায় কি ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে? নাকি ন্যায়বিচারের কবর রচিত হবে?
আমাদের হাতে যাদুর কাঠি থাকলেও আমরা বলতাম না, মামলা প্রত্যাহার করেন। আমরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করতাম। এখনো আদালতের কাছে কেবল ন্যায়বিচারই প্রত্যাশা করছি। আশা করি সকল প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের প্রতি আইন অনুযায়ী ন্যায়বিচার করা হবে। ন্যায়বিচারের কথা জোর দিয়ে এতো বারবার আমি বলছি, এর কারণ আছে।
কারণ, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে কি-না সে ব্যাপারে দেশবাসীর ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। আমরাও শঙ্কিত। আপনি জানেন, এই মামলাসহ আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভিন্ন মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ চলার সময় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য এবং শাসক দলের কোনো কোনো নেতা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে বক্তব্য দিয়েছেন। আমাকে অভিযুক্ত করে বিরূপ প্রচারণা চালিয়েছেন। যেন তারা মামলার রায় কি হবে তা আগাম জানেন। অথবা তারা তাদের বক্তব্যে মাননীয় আদলতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। তদন্ত ও বিচারাধীন বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের এহেন অপপ্রচার শুধু ন্যয়বিচারকেই প্রভাবিত করেনা, বরং তা আদালত অবমাননার শামিল। এখানেই শেষ নয়, মামলার রায়ে আমার সাজা হবে এবং আমাকে কাশিমপুর কারাগারে রাখা হবে বলে ইতিমধ্যে কোনো কোনো মন্ত্রী প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন। কোনো কোনো মন্ত্রী এবং শাসক দলের কোনো কোনো নেতা প্রায় নিয়মিত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন, আমাকে রাজনীতির অঙ্গন থেকে বিদায় করে দেওয়া হবে।
মাননীয় আদালত,
রাজনৈতিক অসৎউদ্দেশ্যে আমাকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সরাতে এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে ক্ষমতাসীনরা একটি নীলনকশা প্রণয়ন করেছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সে বিষয়ে ইতিমধ্যেই রিপোর্ট, মতামত ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে। সরকারের উচ্চ মহলের কার্যকলাপ, তৎপরতা এবং বক্তব্য-বিবৃতি থেকে তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। আর এসব কারণেই দেশবাসীর মনে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে যে, আমার বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে ন্যায়বিচার হবে না। শাসক মহলের ইচ্ছা অনুযায়ী আমাদের বিরুদ্ধে কোনো একটা রায় দেয়া হবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, আপনি সাহস ও সততার সঙ্গে সরকারের প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে আইন অনুযায়ী ন্যায়বিচার করবেন।
মাননীয় আদালত,
আপনি জানেন, দুনিয়ার ন্যায়বিচার আসমান থেকে নাজিল হওয়া কোনো অলৌকিক বস্তু নয়। এটা বেহেশত থেকে টুপ করে ঝরে পড়া কোনো মেওয়া নয়। আল্লাহ্ আহ্কামুল হাকেমিন অর্থাৎ সকল বিচারকের বিচারক। তিনি পরম ন্যায়বিচারকারী। তিনি সর্বোচ্চ বিচারক। তিনি দুনিয়াতেও ন্যায়বিচার চান। অবিচার ও অন্যায় বিচারের জন্য তিনি কঠিন সাজাও নির্ধারণ করে রেখেছেন। আবার সুবিচারকের জন্য পুরস্কারের বন্দোবস্ত রেখেছেন তিনি। বিশ্বাসী মানুষ হিসাবে আমরা তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসও করি। বিচারকের আসনকে জিল্লুল্লাহ্ বা আল্লাহ্র ছায়া হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের অভিপ্রায় হচ্ছে, ঐ আসনে যিনি বসবেন, তিনি সুবিচার করবেন। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন।
 আল্লাহ্র সেই অভিপ্রায়কে অনেক বিচারকই অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা দেখান। আল্লাহ্ নিজেই ব্যক্তি বিচারককে সেই স্বাধীনতা দিয়েছেন। এরজন্য তিনি পুরস্কার ও সাজার ব্যবস্থা রেখেছেন। সে জন্য একজন বিচারককে জ্ঞান, বোধবুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও বিবেক দিয়েছেন তিনি। একজন বিচারক কোনো মোকদ্দমার বিচারকালে সেই বিবেকবোধ দ্বারা পরিচালিত হবেন, নাকি লোভ, ভীতি, আনুকূল্য ও বিদ্বেষ পোষণ কিংবা দুনিয়ার অন্য কেনো শক্তির প্রভাবে, ইচ্ছায় বা ইশারায় পরিচালিত হবেন, সেটা তার স্বাধীনতা। আমি যে কথাটি বুঝাতে চাচ্ছি, সেটা হলো, দুনিয়ার ন্যায়বিচার মূলত বিচারব্যবস্থা থেকে উৎসারিত। এবং এক্ষেত্রে ব্যক্তি বিচারকের সততা ও বিবেকবোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তবে, একথাও সত্য যে, বিচার-ব্যবস্থা ও ব্যক্তি বিচারক বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। দেশে কোন্ ধরণের পরিস্থিতি বিরাজ করছে, কেমন শাসন ব্যবস্থা চলছে, বিচার ব্যবস্থায় কোন্ ধরনের লোকজন দায়িত্ব পালন করছে তার ওপর নির্ভর করে বিচারব্যবস্থা স্বাধীন কিনা। আমাদের বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন দাবি করা হলেও সাম্প্রতিক বিভিন্ন উদাহরণ সেই দাবিকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই স্বাধীনতার দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা বর্তমান মামলাতেও অনেকখানি বোধগম্য হবে। প্রমাণিত হবে, বিচারকগণ স্বাধীনভাবে, বিবেকশাসিত হয়ে এবং আইনসম্মতভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম কিনা।
মাননীয় আদালত,
আমাদের এই দেশে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিচারের নামে অবিচারের বিভিন্ন নমুনা আমরা দেখেছি। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একজন প্রভাবশালী নির্মাতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান। তাকেও দুর্নীতির মামলার বিচারে কারাদন্ড দেয়া হয়েছিল। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও অলি আহাদের মতো জাতীয় নেতৃবৃন্দকেও কারাদ- ভোগ করতে হয়েছে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে কবিতা রচনার দায়ে রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করে কারাদ- দেয়া হয়েছিল। এই উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী, মওলানা শওকত আলী-মোহাম্মদ আলী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস ও জওহর লাল নেহেরুর মতো নেতাদেরকেও কোনো না কোনো আদালতের রায়েই কারাদ- ভোগ করতে হয়েছে। নেলসন ম্যা-েলা, মার্টিন লুথার কিং, বার্ট্রান্ড রাসেল এবং বেনিগনো আকিনোর মতো মানুষদেরকেও কোনো না কোনো বিচারেই সাজা দেওয়া হয়েছে। তথাকথিত সেইসব রায়ের পিছনেও কোনো না কোনো যুক্তি, অজুহাত ও আইন দেখানো হয়েছিলো। হযরত ইমাম আবু হানিফা ও সক্রেটিসের মতো মহামানবদেরকেও তো বিচারের নামেই সাজা দেয়া হয়েছিল। সেই সব বিচারকে কি বিশ্ববাসী ন্যায়বিচার বলে মেনে নিয়েছে?
ইতিহাসের ধোপে সে সব রায় কি টিকেছে? যাদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করে সাজা দেয়া হয়েছিল, বিশ্বমানবতা ও ইতিহাস তাদেরকেই দিয়েছে অপরিমেয় মহিমা। আর যে বিচারকেরা আইনের কথা বলে, কোনো না কোনো যুক্তি দেখিয়ে বিচারের নামে অবিচার করেছিলেন, তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। ইতিহাস রায় দিচ্ছে, নিরপরাধকে অপরাধী সাব্যস্ত করে যারা রায় দিয়েছিলেন তারাই প্রকৃত অপরাধী। তাদের জন্য পারলৌকিক সাজা তো নির্ধারিত আছেই। এই পৃথিবীতেও তাদের নাম ও স্মৃতি যুগ যুগ ধরে অগণিত মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কার কুড়াচ্ছে। এ জগত যতদিন থাকবে, মানুষ যতদিন থাকবে, ইতিহাস যতদিন পাঠ করা হবে এবং যতদিন মানুষের স্মৃতি থাকবে, ততদিনই তাদের প্রতি চলতে থাকবে এই ঘৃণা ও ধিক্কার।
মাননীয় আদালত,
আপনি জানেন, ইতিহাসের এই সব শিক্ষা থেকে কেউ কেউ শিক্ষা নেন। আবার কেউ কেউ কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনা। যারা শিক্ষা নেন, মানুষ ও ইতিহাস তাদেরকে সম্মানিত করে। আর যারা কোনো শিক্ষা নেয় না, তাদের ঠাঁই হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে, আর মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কারে। সময়ের পরিক্রমায় আজকের সময়ও এক সময় ইতিহাস হবে। আলোচ্য এ মামলাটিও নিশ্চয়ই ইতিহাসের এক মূল্যবান উপকরণ হবে। কাজেই এই পটভূমিতে আপনি ইতিহাসের শিক্ষা থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করবেন কি-না, সেই সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। এর জন্য আপনাকে নির্ভর করতে হবে সুবিবেচনা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, সাহস ও সততার ওপর। অনাগত দিন বলে দেবে, আইন ও বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়ে আপনি সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছিলেন কি-না।
মাননীয় আদালত,
আমরা ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছি। এই অঞ্চল প্রায় ২৫ বছর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে এখনকার বাংলাদেশ ভূখ-ের জনগণের ভোটের ফলাফলেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান হাসিলকে সম্ভব করেছিল। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পন্থায় পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র থাকবে বলেই সকলের আশা ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি হিসাবে গণতন্ত্রকেই বেছে নেয়া হবে, এটাই ছিল জনগণের প্রত্যাশা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই প্রত্যাশাকে ভূলুণ্ঠিত করা হলো। গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে জোর-জবরদস্তি, জুলুম-নির্যাতন, ভয়-ভীতি, হামলা-মামলার শাসন কায়েম করা হলো। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, উন্নয়ন, অধিকার সবকিছু আক্রান্ত হলো। এভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রকে পায়ের নীচে দাবিয়ে রাখতে গিয়ে শাসকগোষ্ঠী প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিকেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করলেন। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে মানুষের রায় ও গণতন্ত্রকে আবারো হত্যা, নির্যাতন, সন্ত্রাস ও অস্ত্রের ভাষায় মোকাবিলার অপচেষ্টা শুরু হলো।
এসব অপচেষ্টার ফলাফল কী হয়েছে ইতিহাস তার সাক্ষী। অধিকার, স্বাধীকার ও গণতন্ত্র অর্জনের প্রত্যয় শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে উন্নীত হয়েছে। সেই যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে।
অনেক ত্যাগ ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সেই বাংলাদেশেও কি আমরা পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছি? যদি নিতাম, তাহলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় এদেশে গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় স্বৈরশাসন বা বাকশালী শাসনের প্রবর্তন করা হতো না। সব দল নিষিদ্ধ করা হতো না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার হরণ করা হতো না। চারটি মাত্র সরকারি প্রচারপত্র রেখে সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হতো না। কিন্তু সে সবই হয়েছে এবং এর ফলাফল ও পরিণতি ভালো হয়নি।
এসব থেকে শিক্ষা নিয়েই আমরা গণতন্ত্রকে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছি। মানুষের অধিকার এবং বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। সে কারণেই আমরা কখনো স্বৈরশাসনকে মেনে নিইনি। মানুষের অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য বারবার আমরা মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রাম করেছি। মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে আমাদের বিশ্বাস ও বোধের অন্তর্গত করেছি। এই বিষয়গুলোকে সমুন্নত রাখতে আমরা সর্বশেষ শক্তি দিয়ে লড়াই করে যাবো।
মাননীয় আদালত,
আপনিও নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, মতবৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয়ই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের সৌন্দর্য্য। ভিন্নমত দলন ও দমন নয়, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা নয়, বরং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহ-অবস্থানকে উৎসাহিত না করলে গণতন্ত্র টেকানো যায় না। আমরা সে কথা জানি, বুঝি এবং মানি। আপনি জানেন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যে ভিন্নমত ও দাবি আদায়ের পন্থা এ দেশে বারবার কতোটা সহিংস হয়ে উঠেছে। আমি বেশি পেছনে ফিরে যাবো না। সাম্প্রতিক অতীত থেকেই আমি কিছু উদাহরণ দেব। আজ যারা ক্ষমতায় আছে, সেই আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং তাদের এক সময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সহযোগী জামায়াতে ইসলামী মিলে দেশে কী ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তা আপনি জানেন।
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের বিধানের দাবিতে তারা আন্দোলনের নামে দেশে কী সহিংস হানাহানি ও নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তা সকলেই জানে। দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধে তারা জনজীবনকে অচল করেছে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ সমূদ্রবন্দরকে দীর্ঘদিন বন্ধ করে রেখেছে। রেলস্টেশন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষকে বহনকারী যানবাহনে বোমা মেরেছে এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে চলন্ত বাসের বহু নিরাপরাধ যাত্রীকে তারা জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছে।
বিভিন্নভাবে আরো বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের মাথা তারা ইট দিয়ে থেঁৎলে দিয়েছে। অফিসগামী বয়স্ক মানুষকে রাস্তায় ধরে প্রকাশ্যে দিগম্বর করেছে। মেয়েদেরকে অপমাণিত ও লাঞ্ছিত করেছে।
সচিবালয়ের ভেতরে হাঙ্গামা করেছে এবং বিভিন্ন জায়গায় নোংরা ছড়িয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা অবরোধ করে টানা অবস্থান নিয়ে জনচলাচল বন্ধ করে রেখেছে। সিভিল প্রশাসনে বিদ্রোহ ও বিশৃক্সক্ষলা উস্কে দিয়েছে। সর্বোপরি, গণতন্ত্র ধ্বংস করে সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষমতা দখলের জন্য প্রকাশ্যে উস্কানি দিয়েছে।
আমি বিস্তারিত বিবরণ দিতে চাই না।
২০০১ সালে জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আমরা আবারো সরকারে আসি। তারপর আবারো শুরু হলো রাজপথে আন্দোলনের নামে সহিংস হানাহানি। যা আমাদের পুরো মেয়াদ জুড়ে অব্যাহত ছিল। সেই সহিংসতা থেকে পুলিশ, বিচার বিভাগ, সুপ্রিমকোর্ট, প্রধান বিচারপতির এজলাস পর্যন্ত কোনো কিছুই রেহাই পায়নি। সেই ধারাবাহিক সন্ত্রাসের পরিসমাপ্তি ঘটে প্রকাশ্য রাজপথে পৈশাচিক কায়দায় লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে অনেক মানুষকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। এসব কর্মকাণ্ডের পরিণামও শুভ হয়নি। হানাহানির অজুহাতে জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে স্থগিত করে দিয়ে তখনকার সেনাপ্রধান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে নেয়।
তার অনুগত একটি গোষ্ঠীকে নিয়ে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা জরুরি সরকার গঠন করে। তাদেরকে সামনে রেখে সেনাপ্রধান সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। নির্বাচন পিছিয়ে সেই অবৈধ শাসনকে দুই বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত করা হয়। আপনি জানেন, আমি এই অবৈধ প্রক্রিয়াকে সমর্থন করিনি। বরং এখন যারা জনগণের ভোট ছাড়াই অবৈধভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তারাই সেদিন বিপুল উৎসাহ ও উল্লাস নিয়ে সেদিনের অবৈধদের সমর্থন করেছিলেন। বলেছিলেন, ওটা তাদেরই আন্দোলনের ফসল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই ঐ অবৈধ শাসকদের আসল চেহারা ও উদ্দেশ্য সকলের সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি এবং শেখ হাসিনা, এই দু’জনকেই জোর করে ‘মাইনাস’ করার উদ্দেশ্যে তারা সব ধরণের তৎপরতা শুরু করে। আমাকে গৃহবন্দী করা হয়। বিদেশ সফররত শেখ হাসিনার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। তিনি দেশে ফিরে এলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণেই তিনি চরম অশোভন আচরণের শিকার হন। আমি কিন্তু তখন চুপ করে থাকতে পারতাম। কিন্তু অন্যায়কে আমি মেনে নেইনি। গৃহবন্দী অবস্থা থেকেই আমি শেখ হাসিনার প্রতি সেই অন্যায় আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। আমি আমার বিবৃতিতে তার মুক্তি দাবি করেছিলাম। এই প্রসঙ্গে সে সময়কার কিছু কথা বলতে হয়। মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের জরুরি সরকার কোনো বৈধ সরকার ছিলো না। সেই সরকার সংবিধান অনুযায়ী গঠিত হয়নি। জোর করে অস্ত্রের মুখে তারা ক্ষমতা নিয়েছিলো। প্রায় দুই বছর জরুরি অবস্থা জারি করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় ছিলো। আমি কখনো কোনোভাবে তাদেরকে সমর্থন করতে পারিনি। তারা আমার সমর্থন চেয়েছিলো। আমাকে সপরিবারে নিরাপদে দেশত্যাগ করার জন্য তারা বলেছিলো। আমি তাদের কথা মানিনি। আমার নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভাবিনি। আমি তাদেরকে স্পষ্টভাষায় বলেছি, বাংলাদেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। জীবনে-মরণে আমি বাংলাদেশেই থাকতে চাই।
শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সেই অবৈধ সরকারকেই সমর্থন করেছিলো। তারা তাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও সানন্দে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের পরামর্শে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছিলেন। যাবার সময় বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে বলে গিয়েছিলেন যে, সেই অবৈধ সরকার তাদেরই আন্দোলনের ফসল। তিনি তাদের সকল কাজের বৈধতা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। এমনকি, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও আমার বড় ছেলে তারেক রহমানের দিকে ইঙ্গিত করে তাকে গ্রেফতার করার জন্যও সেই অবৈধ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মাননীয় আদালত,
আপনি জানেন, ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের অবৈধ সরকার মিথ্যা মামলায় আমাকে এবং আমার দুই ছেলেকে গ্রেফতার করেছিলো। বন্দী অবস্থায় পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিলো। আমার বড় ছেলে তারেক রহমান সেই নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে এখনও বিদেশে চিকিৎসাধীন। তার উপর বর্বরোচিত দৈহিক নির্যাতনের সকল সনদপত্র সংরক্ষিত আছে। আমার ছোট ছেলেটি আর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়নি। বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই সে অকালে আমাদেরকে ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছে। সন্তানের অকাল মৃত্যুর সেই দুঃসহ ব্যথা বুকে চেপে আমি এখনও দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের অবৈধ সরকারের জুলুম-নির্যাতন ও স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপের কথা নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাননি।
ব্যবসায়ীসহ যাকে-তাকে মিথ্যা অজুহাতে ধরে নিয়ে সে সময় তারা টাকা আদায় করতো। রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকায় জমি-বাড়ি দখলের কাজেও তারা বিভিন্ন পক্ষে প্রভাব খাটিয়েছে। আইন-আদালত ও বিচার ব্যবস্থাকে তারা তাদের নির্দেশে চালিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এবং সাংবাদিকদের উপর তারা নির্যাতন করেছে।
এতো অপকর্ম করেও মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনরা বিদেশে আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছে। আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও দায়ের করা হয়নি। তাদের অন্যতম দোসর মাসুদউদ্দিন চৌধুরীকে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রদূত হিসাবে বহাল রেখে লালন-পালন করা হয়েছে।
এ সবের কারণ, আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় এসেছিলো। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা নিশ্চিত করা হয়েছিলো। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করলেও মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের পক্ষে যখন আর ক্ষমতায় থাকার কোনো উপায় ছিলো না, তখন তারা নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। কেননা আমাদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে দেশের ভিতরে ও বাইরের পরিস্থিতি অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলো। তারা আমার সঙ্গেও সমঝোতার চেষ্টা করেছে। নানা রকম প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে গেছে। আমি তাদের কোনো প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি, অবৈধ শাসকদের সঙ্গে কোনো রকম সমঝোতা আমি করবো না। জরুরি অবস্থা তুলে দিয়ে তাদেরকে নির্বাচন দিয়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করেই ক্ষমতায় গিয়েছিলো। তারপরেও আমরা সাংবিধানিক শাসন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ঐ কারসাজির নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছিলাম। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমাদের সহযোগিতার আহ্বানের বিনিময়ে তারা আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করেছে তা সকলেরই জানা।
 মাননীয় আদালত,
প্রতিহিংসার বিপরীতে সংযম, সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা আমি বরাবর করে এসেছি। কিছুদিন আগেও আমি একটি সংবাদ-সম্মেলন করে অতীতের সকল তিক্ততা ভুলে ক্ষমার কথা তুলে ধরি। আমি পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করি যে, আমার এবং শহীদ জিয়াউর রহমানসহ আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ক্রমাগত অশোভন উক্তি এবং প্রতিহিংসামূলক বৈরী আচরণ সত্বেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। আমি তার প্রতি কোনো প্রতিহিংসাপ্রবণ আচরণ করবো না।
আমি আহ্বান জানিয়েছিলাম, আসুন, রাজনীতিতে একটি সুন্দর, শোভন ও সহিষ্ণু সংস্কৃতি গড়ে তুলি। যা গণতন্ত্রের জন্য খুবই প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে আমাদের কাছ থেকে ভালো কিছু শিখতে পারে। পারষ্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতার পরিবেশ গড়তে আমাদের মরহুম জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সম্মানিত করার ব্যাপারে ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্যও আমি বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব দিয়েছি।
এছাড়াও, বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজার ব্যাপারেও আমাদের প্রস্তাব সব সময় ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু তার জবাব আমাদেরকে কোন্ ভাষায় দেয়া হচ্ছে, তার প্রমাণ সকলেই পাচ্ছেন এবং আপনিও জানেন। আমাদের বিরুদ্ধে আলোচ্য মামলাটিও সেই হীন চক্রান্তেই একটি প্রমাণ।
মাননীয় আদালত,
কেন এই জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা? এটি সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। মানবসেবা ও কল্যাণমূলক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলÑবিএনপি’র একটি সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগের ফল এটি। এই প্রতিষ্ঠানে সরকারি কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থা থেকে কোনো ধরণের কোনো আর্থিক সহায়তা কখনো নেয়া হয়নি। রাষ্ট্রীয় বা সরকারি কোনো তহবিল থেকে এই ট্রাস্টে একটি পয়সাও কখনো নেয়া বা বরাদ্দ করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে অথবা প্রধানমন্ত্রী পদের কোনোরূপ প্রভাব খাটিয়ে এই ট্রাস্টের জন্য কোনো অর্থ সংগ্রহ করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কোনো স্বাক্ষীর অথবা ডকুমেন্টারি সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এমন কিছু প্রমানও হয়নি যে, প্রধানমন্ত্রী পদের কোনো অপব্যবহার করা হয়েছে। তাহলে কেন এ মামলা? এ মামলার কারণ, এই ট্রাস্ট গঠনের সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ বিএনপি’র। এর সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা বিএনপি’র চেয়ারপার্সন হিসেবে।
বিএনপি এবং আমাকে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা তাদের প্রতিপক্ষ মনে করে। তাদের বিভিন্ন কথা ও আচরণে প্রমাণিত যে, তারা বিএনপি এবং আমাকে যে-কোনো পন্থায় হেয়, হয়রানি ও হেনস্তা করতে বদ্ধপরিকর। তারা ক্ষমতাসীন হবার পর সম্পূর্ণ হীন সেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই তাই এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। সর্বোপরি, এ ট্রাস্ট করা হয়েছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে। তার স্মৃতি ও আদর্শকে অম্লান ও জীবন্ত রাখার উদ্দেশ্যে। প্রতিহিংসার এটি একটি বড় কারণ। জিয়াউর রহমান আজ আর আমাদের মাঝে নেই। জনগণের নির্বাচিত ও নন্দিত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় দেশদ্রোহী কুচক্রীমহলের কুটিল ষড়যন্ত্রে তিনি শহীদ হয়েছেন। কিন্তু দেশে-বিদেশে তার বিপুল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা আজও একটুও ম্লান হয়নি। তার আদর্শ, সততা, দেশপ্রেম, সাহস, অবদান ও কর্তব্যনিষ্ঠা আজও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে প্রেরণার উৎস। এখনো তার পথ-নির্দেশনা দেশকে আলোর পথ দেখায়। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা তাই মৃত্যুর পরেও শহীদ জিয়াউর রহমানকে সহ্য করতে পারে না। তারা মনে করে, জীবিত জিয়াউর রহমানের চাইতেও শহীদ জিয়াউর রহমান আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠিত দল এবং প্রবর্তিত আদর্শ ও কর্মসূচি মোকাবিলা করা তাদের জন্য এখনো খুবই কঠিন। একারণেই তারা শহীদ জিয়ার নাম ও স্মৃতিকে মুছে দিতে একের পর এক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। একজন মৃত মানুষের বিরুদ্ধে ক্রমাগত চলছে কুৎসা রটনা ও অসত্য প্রচার। সেই প্রতিহিংসা থেকেই শহীদ জিয়ার নামাঙ্কিত ট্রাস্ট্রের বিরুদ্ধে এই মামলা। কিন্তু, মাননীয় আদালত, মামলা-মোকদ্দমা, আদালতের রায়, সরকারি নির্দেশনা ও ফরমান এবং রাজনৈতিক প্রচার-অপপ্রচার দিয়েই ইতিহাসের মোড় ফেরানো যায় না। ইতিহাসের সত্যকে মুছে দেয়া যায় না। আজ ও আগামীকালের লাখো কোটি মানুষের মন থেকে শহীদ জিয়ার স্মৃতি ও আদর্শকে এভাবে মুছে ফেলা সম্ভব হবে না। চোখে ঠুলি পরলেই প্রখর ও উজ্জ্বল সূর্য মুছে যাবে না। পর্বতের অস্তিত্ব মিথ্যা হয়ে যাবে না। শহীদ জিয়াউর রহমানকে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা খুবই অন্যায় ও ভুলভাবে বিরোধিতা করে। তিনি নিজে কোনো হিংসাপরায়ন মানুষ ছিলেন না। সাহসী ও দেশপ্রেমিক জিয়াউর রহমানের কাছে দেশ ও জনগণ ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। দেশের ডাকে তিনি জীবনকে তুচ্ছ করেছেন। স্ত্রী-পুত্র-পরিজন কারো নিরাপত্তার কথাও ভাবেননি। ১৯৭১ সালে তিনি তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কঠোর শৃক্সক্ষলা ভেঙ্গে বিদ্রোহ করে দেশের প্রয়োজনে নিজের নামে স্বকণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। প্রতিরোধ যুদ্ধকে স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধে উন্নীত করেছেন। তার মধ্যে কোনো হীনম্মন্যতা ছিল না। তাই অনেকের অনুরোধে তিনি স্বাধীনতার সেই ঘোষণাকে সংশোধন করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতার নাম তাতে যুক্ত করতেও কুণ্ঠিত হননি।
তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে রণাঙ্গণের যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। স্বাধীনতার পর সুশৃক্সক্ষল একজন সেনানায়ক হিসাবে কর্তব্য পালন করেছেন।
তিনি নিজে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেননি। বরং উচ্চাভিলাষী কতিপয় সেনা কর্মকর্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেনাপ্রধানের পদ থেকে তাঁকে অপসারণ ও বন্দী করছিলো।
সৈনিক-জনতা তাঁকে মুক্ত করে দেশ পরিচালনার ভার তার ওপর অর্পণ করে।
তখন ছিল এক সীমাহীন শূন্যতা। দেশে সংবিধান স্থগিত ছিল। জারী ছিল সামরিক শাসন। সংসদ ছিল না। বৈধ কোনো সরকার ছিল না। অস্তিত্ব ছিল না কোনো রাজনৈতিক দলের। শহীদ জিয়াউর রহমানই সামরিক শাসন থেকে সাংবিধানিক শাসন ফিরিয়ে আনেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটান। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের ধারা ফিরিয়ে আনেন। রাজনৈতিক দল পুনর্গঠন করে রাজনীতি চালু করেন। নির্বাচিত সংসদ গঠন করেন। বিচার বিভাগ, মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। তিনি গণভোটে জনগণের সম্মতি বা ম্যান্ডেট নিয়েই এসকল ইতিবাচক ও শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। শেখ হাসিনাকে ভারতে প্রবাসী জীবনের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের সুযোগও জিয়াউর রহমান করে দিয়েছিলেন। তিনিই শেখ হাসিনাকে তাদের পারিবারিক বাড়ি ও বিপুল পরিমাণ সম্পদ ফেরত দিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবেও জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ও অবদান জনগণের হৃদয়ে ও আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
জাতীয় ঐক্য ও উদ্দীপনা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশ গঠন এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে তিনি স্মরণীয় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি চারণের বেশে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সারা দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন। জিয়াউর রহমান সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের মধ্যে কর্মউদ্দীপনা সঞ্চার করেছেন। তাদের সঙ্গে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খননে অংশ নিয়েছেন এই কর্মী রাষ্ট্রনায়ক। সার্ক গঠনের উদ্যোগ নিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল অবদান রেখে গেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অঙ্গনে তার গতিশীল ভূমিকা আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে। এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে তিনি বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে গেছেন।
তার ভূমিকা ও অবদানের কারণেই তিনি বাংলাদেশের মানুষের বিপুল ভালোবাসা পেয়েছেন। তিনি আততায়ীর হাতে শহীদ হওয়ার পর তার জানাযায় লাখ লাখ মানুষ শামিল হয়েছিলেন। সারা দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত এতো বড় জানাযা আর কারো হয়নি। শহীদ জিয়াউর রহমান আমাদের পার্টি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলÑবিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। এটা আমাদের জন্য এক পরম গৌরবের বিষয়। তার স্মৃতি ও আদর্শকে অম্লান রাখা আমাদের দলের কর্তব্য। সেই লক্ষ্য নিয়েই বিএনপি জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে শহীদ জিয়াউর রহমানের নামাঙ্কিত এই ট্রাস্ট গঠনের সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ গ্রহণ করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, জিয়াউর রহমানকে সহ্য করতে না পেরে এবং আমাদের দল ও আমাকে হেয় করার উদ্দেশ্যে এ মামলা সৃষ্টি করা হয়। এ মামলায় আমার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী পদের ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনো অভিযোগ সম্পর্কিত কোনো সাক্ষ্য কেউই দেননি।
আমি এ ট্রাস্ট্রের জন্য সরকারি বা রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে একটি পয়সাও বরাদ্দ দেইনি কিংবা নেইনি। কোনো তহবিল তছরূপ বা আত্মসাতেরও কোনো অভিযোগ নেই। অথচ আমার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ মারফৎ স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়নি যে, আমি কোনোভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছি। কি-ভাবে এবং কোন্ পন্থায়, কোন্ কোন্ পদক্ষেপের মাধ্যমে আমি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছি তা-তো স্পষ্ট ও পরিষ্কার করে বলতে হবে। শুধু ঢালাও অভিযোগ আনলেই হবে না। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সন্দেহাতীতভাবে আদালতে সেগুলো প্রমাণ করতে হবে। সেটা তারা করতে পারেনি। মামলাটি মূলত: ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও ইঙ্গিতে সৃষ্ট। তাই আইন, বিধিবিধান, দুদকের এখতিয়ার, আওতা এবং কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার পরিধিকে যথাযথভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সে কারণেই আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই যে, আমার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য ও ভিত্তিহীন। বরং দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা এ মামলাটিই মূলত: করা হয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার করে।
মাননীয় আদালত,
আমি বিষ্মিত হয়েছি আমার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে মামলা দায়ের করায়। ক্ষমতা সম্পর্কে আমার নিজের একটা ধারণা আছে। আমি সে ধারণার কথা বহুবার আমার পাবলিক স্টেটমেন্ট সমূহে ব্যক্ত করেছি। আমার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েও সেই ধারণার প্রতিফলন ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রীয় সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা নন। প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, দেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। জনগণের অনুমোদন ও সমর্থনে প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালন করতে হয়। রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনাকে আমি কখনো ক্ষমতা বলে মনে করিনা, বিশ্বাসও করিনা। আমি মনে করি এটা দায়িত্ব। যে দায়িত্ব জনগণ ভোটের মাধ্যমে অর্পণ করে থাকে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বকে ক্ষমতা বলে মনে করলে আমি ক্ষমতার ব্যবহার ও অপব্যবহার করেছি কি-না সে প্রশ্ন উঠতে পারতো। আমি রাষ্ট্রীয় ও সরকারি দায়িত্বকে ক্ষমতা মনে করি না। কাজেই আমার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ সম্পূর্ণ অবান্তর। আমি শুধু এ মামলার সঙ্গে জড়িত বিষয়ে নয়, কখনো কোনো বিষয়েই ক্ষমতার অপব্যবহার করিনি। কাজেই এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং ভিত্তিহীন কোনো অভিযোগ প্রমাণেরও প্রশ্ন ওঠেনা। সে কারণেই এই আদালতে কোনো প্রমাণ বা সাক্ষ্যে আমার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ পরিষ্কার, স্পষ্ট, দৃশ্যমান ও বোধগম্য করে তোলা সম্ভব হয়নি। মামলায় অন্তর্ভূক্ত তথাকথিত ঘটনার সময় আমি জনগণের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করছিলাম, একথা সত্য।
সেই সঙ্গে একথাও সত্য যে, সেটাই কেবল আমার একমাত্র পরিচয় ছিল না। আমি একই সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপার্সন ছিলাম। আমি আমার সন্তানদের মা ছিলাম। অনেকের আত্মীয় ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আমার আরো পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়, অবস্থান ও সম্পর্ক ছিল। সেই সব অবস্থান, সম্পর্ক ও পরিচয়ের কারণে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমাকে অন্যান্য দায়িত্ব ও কর্তব্যও পালন করতে হয়েছে। এর সবকিছুকে মিলিয়ে ফেলার কিংবা একত্রিত করে উপস্থাপনের সুযোগ নেই। সেটা করলে তা নৈতিক, ন্যায়সঙ্গত ও সঠিক হবে না। শহীদ জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের কোনো কাজ আমি প্রধানমন্ত্রী পদের প্রভাব খাটিয়ে করিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লিখিত বা মৌখিক কোনো নির্দেশ কাউকে দেইনি।
প্রধানমন্ত্রীর অধীনস্থ কোনো রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কোনো অন্যায়, অনৈতিক, বেআইনি বা আইন বহির্ভূত আদেশ দেইনি। এ মামলায় তেমন কোনো সুস্পষ্ট অভিযোগ নেই এবং সাক্ষ্য প্রমাণে তেমন কিছু প্রমাণিতও হয়নি। তাহলে কেন এ মামলা? কোন্ সাক্ষ্য-প্রমাণকে আমি খ-ন করবো?
মাননীয় আদালত,
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পাস হয়। দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে আমিই স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করি। এই স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান হন একজন প্রথিতযশা অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞ বিচারপতি সুলতান হোসেন খান। আইন পরিবর্তন করে দুদক-এর স্বাধীনতা পরবর্তীকালে খর্ব করা হয়। আমি বিষ্মিত হয়েছি, দুদক আমার বিরুদ্ধেই এই মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করেছে। এর আগে মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের ইঙ্গিতেও দুদক আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও সে সময় অনেকগুলো মামলা দায়ের করা হয়েছিলো। দুদকের আইনজীবী হিসেবে কেউ কেউ এখন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা নিয়ে ভীষণ তৎপর।
মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সময়ও তো তারা এই রকম অতিউৎসাহীই ছিলেন। মামলাগুলো প্রমাণের জন্য তারা কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তার বিরুদ্ধের সেই মামলাগুলো আজ কোথায় মাননীয় আদালত?
বর্তমান মামলাটির সাক্ষ্য-প্রমাণ আমার পক্ষে নিয়োজিত বিজ্ঞ আইনজীবীরা মাননীয় আদালতে উপস্থাপন করবেন।
উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণের আলোকে আমি শুধু বলতে চাই যে, রাষ্ট্রপক্ষে যে সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়েছে সেখানে কেউ আমার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালনকালীন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনো অভিযোগ মৌখিক বা দালিলিকভাবে উপস্থাপন করেননি। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পাবলিক সার্ভেন্ট বিবেচনা করে পাবলিক সার্ভেন্ট হিসাবে আমাকে এ মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। একজন প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড পরিচালনার পাশাপাশি তার সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন কার্যক্রম এবং রাজনৈতিক দল পরিচালনার অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ও সর্বজনবিদিত। রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পরিচালিত হয় আইন, রুলস অব বিজনেস ও সংবিধান অনুযায়ী। একজন প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসাবে জনসাধারণের ভোটে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পার্লামেন্টে নেতা নির্বাচিত হন এবং সংসদীয় দলের নেতা হিসাবে পরবর্তীতে সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। রাষ্ট্রপতি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সরকার গঠনের আহ্বান জানান।
সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের সমর্থন থাকা পর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রীকে কেউ অপসারণ করতে পারে না। কাজেই জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর পদকে প্রজাতন্ত্রের কাজে নিযুক্ত এবং বরখাস্তযোগ্য অন্যান্য পাবলিক সার্ভেন্টের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। আমি মামলায় বর্ণিত তথাকথিত ঘটনার সময় বাংলাদেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলাম। প্রচলিত অর্থে কারো দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারি ছিলাম না।
 জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নেতা হিসাবে আমাকে সরকার গঠনের আহ্বান জানানো এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া ছাড়া সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির আর কোনো বিকল্প ছিলো না। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থা বহাল থাকা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে আমাকে অপসারণের কোনো এখতিয়ারও রাষ্ট্রপতির ছিলো না। কাজেই আমাকে পাবলিক সার্ভেন্ট বিবেচনা করে অত্র মামলায় অভিযুক্ত করার কোনো আইনগত সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর পদকে নির্বাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের সংবিধানের চতুর্থ ভাগে এর বিবরণ দেয়া হয়েছে। পাবলিক সার্ভেন্টদেরকে কর্মবিভাগের আওতাভুক্ত করে আমাদের সংবিধানের ৯ম ভাগে এর বিবরণ দেয়া হয়েছে। পাবলিক সার্ভেন্টদের নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, বরখাস্ত ও শাস্তি বিধানের জন্য সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান ও আইন রয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী যদি পাবলিক সার্ভেন্ট না হন তাহলে মামলায় উল্লেখিত ঘটনার সময় আমি প্রধানমন্ত্রী ছিলাম শুধু এ কারণে এধরণের মামলা হতে পারে না। 
আমি সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছি। কোনো সাক্ষী তার সাক্ষ্যে এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আমার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও পদ অপব্যবহারে বিষয়ে কোনো সাক্ষ্য প্রদান করেননি। রুলস অব বিজনেস, এ্যালোকেশন অব বিজনেস এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী স্ব-স্ব পদে আসীন কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই মামলায় আমার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য প্রদান করেননি। সুদীর্ঘ তিন বছর অনুসন্ধান ও তদন্ত চালিয়েও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আমার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ আদালতে হাজির করা হয়নি। কোনো সাক্ষী তেমন কোনো সাক্ষ্য প্রদানও করেননি। সাক্ষ্য-প্রমাণে এমন কোনো বর্ণনা নাই যে, আমি প্রধানমন্ত্রীর পদের প্রভাব খাটিয়ে কোনো ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দলীয় বা ট্রাস্টের ফান্ডের জন্য কোনরূপ অর্থ সংগ্রহ ও গ্রহন করেছি। আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার অভিযোগ থেকে প্রথম জানতে পারি যে, আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ২০০৫ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে ১৯ জানুয়ারি তারিখ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছি। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায় যে, আমার বিরুদ্ধে এই মামলায় ক্ষমতা অপব্যবহারের সেই অভিযোগের ব্যাপারে দুদক ২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর থেকে অনুসন্ধান আরম্ভ করে। দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করেও আমার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ তারা সংগ্রহ করতে পারেনি। তারপরও সম্পূর্ণ প্রতিহিংসাবশতঃ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও আমাকে অন্যায়ভাবে হেয় ও হেনস্তা করতে বিগত ২০১১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে এই মামলাটি দায়ের হয়।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট যথাযথভাবে দেশের প্রচলিত ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা এবং নিবন্ধন করা হয়েছে। এখানে আইনের কোনো ব্যতয় ঘটানো হয়নি। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দলিলে আমার পরিচয় দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয় বরং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপার্সন হিসাবে পরিষ্কার উল্লেখ আছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের একটি স্থায়ী রূপ প্রদানের লক্ষ্যে ঢাকা শহরের একটি বাণিজ্যিক এলাকায় ৪২ কাঠা জমি বিক্রেতাকে যথার্থ ও উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করে খরিদ করা হয়েছে। বিক্রেতাকে সম্পূর্ণ টাকা বিক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় খরচসহ ডকুমেন্ট ভিত্তিক ব্যাংক পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে এবং প্রাপ্তিস্বীকারপত্র আছে। এখানে কোনো অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর পরিচয়ে অথবা প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় তহবিল হতে কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি। দলীয় তহবিল থেকে ব্যাংক এ্যাকউন্টে গচ্ছিত টাকা দলীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট একাউন্টে জমা হয়েছে। এ সংক্রান্ত যাবতীয় পদক্ষেপ ও ব্যয় বিভিন্ন পর্যায়ের দলীয় নেতা-কর্মীরা দলীয়ভাবে সম্পন্ন করেছেন।
মাননীয় আদালত,
আপনি জানেন আলোচ্য ট্রাস্টটি বিএনপির একটি উদ্যোগ। সারা দুনিয়ায় রাজনৈতিক দলের তহবিল নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে দান-অনুদান ও চাঁদা গ্রহণের মাধ্যমেই সংগ্রহ করা হয়। এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বৈধ ও আইনসম্মত। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও একইভাবে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। আপনি কিছুদিন আগে আমাদের দেশে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন দেখেছেন। টানা কয়েকদিন ধরে আলোকসজ্জা হয়েছে নগরীতে। আর সকল ক্ষেত্রে যে জৌলুস করা হয়েছে তাতে ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি টাকা। বিপুলভাবে ব্যয় করা সে অর্থের উৎস নিয়ে কোনো মামলা হয়নি। হলে নিশ্চয়ই তারা বলবেন, চাঁদা ও দান-অনুদান থেকেই ওই বিপুল অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দান-অনুদান ও চাঁদা গ্রহণ করেছে। এভাবে তহবিল সংগ্রহ করা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। কেবল আমাদের ক্ষেত্রে কেন প্রশ্ন উঠবে?
এ দেশে রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয় ও জমা-খরচের অডিট এক সময়ে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক ছিল না। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের জন্য তহবিল সংগ্রহের সময়েও দলের আয়-ব্যয় ও জমা-খরচের অডিটের বাধ্যবাধকতা ছিল না।
তা সত্ত্বেও আমরা যতদূর সম্ভব স্বচ্ছতার সঙ্গে সবকিছুর হিসাব সংরক্ষণ করেছি এবং সে হিসাবে কোনো গরমিল নেই।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট একাউন্টে জমাকৃত সমুদয় টাকা দলের তহবিলে গচ্ছিত টাকা এবং দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থক ও শহীদ জিয়ার অনুরাগীদের প্রদত্ত দান ও অনুদানের টাকা। সারা দুনিয়ায় দান-অনুদানের অর্থে ট্রাস্ট পরিচালনা একটি সার্বজনীন স্বীকৃত রীতি।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের একাউন্টে জমাকৃত টাকার কোনো অংশ প্রধানমন্ত্রীর পরিচয়ে অথবা প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদার অপব্যবহার করে সংগ্রহ করা হয়নি। তেমন অভিযোগ কেউ উত্থাপন করেননি কিংবা সাক্ষ্যও দেননি। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টে জমাকৃত টাকার বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো পর্যায়ে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি।
আমার বিরুদ্ধে মামলাটি প্রতিহিংসামূলক অপরাজনীতির প্রতিফলন মাত্র।
মাননীয় আদালত,
এ মামলায় আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়, কাউকে ভীতি প্রদর্শন বা লোভ দেখিয়ে অনৈতিক কিছু করানোর কোনো অভিযোগ কিংবা তথ্য-প্রমাণ নেই। জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই ট্রাস্ট থেকে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো সুবিধা নেয়ার প্রশ্ন নেই। কাজেই ট্রাস্টের জন্য সংগ্রহ করা তহবিলকেও আমার ব্যক্তিগত স্বার্থে সংগৃহিত হিসাবে ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ নেই। ভয়ভীতি দেখিয়ে বা সুবিধা দেয়ার লোভ দেখিয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দান-অনুদান গ্রহনের কোনো অভিযোগ এ মামলায় নেই। দান-অনুদান প্রদানকারী দুই-একজনকে বরং ভয়ভীতি দেখিয়ে মিথ্যা বক্তব্য আদায় করা হয়েছে। কিন্তু কাগজপত্রে প্রমাণ হয়েছে, তারা অসত্য বলেছে। কাজেই তাদের ভীতিতাড়িত অসত্য বক্তব্য আইনের চোখে গ্রহণযোগ্য নয়। দুর্নীতি নিরোধ আইন মোতাবেক আমি কোনো ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট অর্থাৎ অপরাধমূলক অসদাচরণ, অনিয়ম বা দুর্নীতি করিনি। আদালতে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণে তা প্রমাণিতও হয়নি। তবুও মিথ্যা অভিযোগে মামলা দায়েরের কারণে আমাকে নানাভাবে হয়রানি ও হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে।
মাননীয় আদালত,
এই মামলায় আমাকে ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ জাতীয় মামলায় একজন পাবলিক সার্ভেন্ট হিসাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির অভিযোগ একটি আবশ্যিক পূর্ব শর্ত। মামলাটিতে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক প্রাপ্তির জন্য অভিযোগ হিসাবে একমাত্র পি.ডব্লিউ-১ সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। এই পি.ডব্লিউ-১ হারুন অর রশীদ ৮/৮/২০১১ইং তারিখে এজহার দায়ের করেন এবং তিনি মামলাটি তদন্ত করে ১৬/১/২০১২ইং তারিখে চার্জশীট দাখিল করেন। এই হারুন অর রশীদ একজন অতি উৎসাহী সাক্ষী। তিনি তার সাক্ষ্যে বলেছেন যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর আমার বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই সাক্ষী একথাও স্বীকার করেছেন যে, তিনি এই বর্তমান মামলাটি ছাড়াও আমার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় এজাহার দায়ের ও চার্জশীট প্রদান করেছেন।
তিনি তার সাক্ষ্যে স্বীকার করেছেন যে, আমাদের সরকারের আমলে ২/১০/২০০৫ইং তারিখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে দুদকের চাকুরিতে আত্মীকরণ করার জন্য সুপারিশ করেননি। সেকারণে তিনি একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হিসাবে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগে রীট মামলা দায়ের করেছিলেন। তিনি পরবর্তীতে রীট মামলাটি Not pressed করেন এবং Rule discharge হয় ১৩/৯/২০০৭ইং তারিখে। দুদকের চাকুরিতে তাকে ২৫/০২/২০০৮ইং তারিখে আত্মীকরণ করা হয় এবং ৪/৫/২০০৮ ইং তারিখে এ সংক্রান্ত গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ করা হয়। পরবর্তী মাসে ১৫/৬/২০০৮ ইং তারিখে তাকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় অনুসন্ধানকারী হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়।
মাননীয় আদালত,এই মামলায় পি.ডব্লিউ-১ হারুন অর রশীদ আমাদের প্রতি ক্ষুব্ধ একজন ব্যক্তি হিসাবে নানারূপ কল্প-কাহিনী সৃষ্টির মাধ্যমে আমাকে চার্জশীটভুক্ত করেছেন। সংবিধানের বিধিবদ্ধ বিধান অনুযায়ী একজন রাজনৈতিক দলের নেত্রী হিসাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করার পর আমি এমপি হিসাবে শপথ গ্রহণ করি। পরবর্তীতে পার্লামেন্টের নির্বাচিত সদস্যদের নেতা হিসাবে নির্বাচিত হলে আমাকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়।
আমি প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আমার কর্মপরিধি প্রজাতন্ত্রের শাসনতন্ত্র, রুলস অব বিজনেস এবং প্রধানমন্ত্রীর অর্গানোগ্রাম কাঠামো দ্বারা পরিচালিত হয় কিন্তু রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড এবং প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক স্বত্তা ও দলীয় কর্মকান্ড পৃথকভাবে চলে। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও সামাজিক অবস্থাজনিত কার্যকলাপ সংবিধান ও আইন দ্বারা স্বীকৃত।
মাননীয় আদালত,
একজন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আমি প্রধানমন্ত্রী পদের ক্ষমতার কোনো অপব্যবহার করি নাই। ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠিত হয়নি। এই ট্রাস্টটি আইন দ্বারা নিবন্ধিত একটি পৃথক প্রাইভেট সত্তা। বর্তমান মামলাটিতে পি.ডব্লিউ-১ হারুন অর রশীদ স্বীকার করেছেন যে, “এই মামলার আসামী বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি টাকা অপব্যবহারের কোনো অভিযোগ এজাহারে উল্লেখ করিনি। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ডিড-এ ট্রাস্টি হিসাবে বেগম খালেদা জিয়ার নাম রয়েছে এবং তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন হিসাবে উক্ত ট্রাস্ট গঠন করেছেন। ট্রাস্ট ডিড-এ প্রধানমন্ত্রীর অফিস বা সচিবালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হয় নি।”
মাননীয় আদালত,
এই সাক্ষী আমার বিরুদ্ধে দালিলিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ক্ষমতার অপব্যবহারের দাবি করেছেন। এরূপ দাবি নিছক কাল্পনিক, মিথ্যা ও বানোয়াট। মাননীয় আদালতে মামলাটিতে ৩৩জন সাক্ষীর সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দুদকের এই অতি উৎসাহী সাক্ষী হারুন অর রশীদ ছাড়া আর কেউ, কিংবা প্রধানমন্ত্রীর দফতর হতে কোনো সাক্ষী মৌখিকভাবে অথবা দালিলিকভাবে আমার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর পদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো আর্থিক প্রাপ্তির বিষয়ে বা কোনো অপচয়ের বিষয়ে কোন অভিযোগ করেননি। জিয়া চ্যরিটেবল ট্রাস্টেও অনুকূলে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ দলীয় নেতা-কর্মীদের টাকা এবং দলীয় বিভিন্ন একাউন্ট হতে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের একাউন্টে জমাকৃত টাকা। এখানে প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনিক দাপ্তরিক কর্মকান্ডের সাথে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের কর্মকান্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। বিভিন্ন রূপ ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ব্যাংক পেয়িংস্লিপ, ব্যাংক পে-অর্ডার, পে-অর্ডার এ্যাপ্লিকেশন ফরম এগুলি সব Primary documentary evidence। এরূপ evidence-এর ব্যতয় ঘটিয়ে কোনো মৌখিক সাক্ষ্য সুস্পষ্টভাবে সাক্ষ্য-আইন বিরুদ্ধ। আমার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষীর বরাতে বা সাক্ষ্য-আইনের নিরিখে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠনের বিষয়ে কোনোরূপ আইন বিরুদ্ধ কাজ হয়নি।
৬ নং শহীদ মইনুল রোডস্থ আমার এককালীন বাসস্থানটি আমাদের দীর্ঘ দিনের পারিবারিক বাসস্থান ছিল। সেখানে আমি আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একত্রে এক সময় বসবাস করেছি। সেখানেই আমার পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকান্ড চলেছে। আমি প্রধানমন্ত্রী হিসাবেও সেই বাসস্থানে বসবাস করেছি বলেই সেটিকে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন হিসাবে চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ নেই।
মাননীয় আদালত,
সকল পারিপার্শ্বিক অবস্থায় পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, ক্ষমতাসীনদের অভিপ্রায় অনুযায়ী এই মামলা দায়ের করা এবং মামলাটিতে আমাকে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু যে সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী এ মামলা দায়ের হলো তাদের কী অবস্থা? দেশে গণতন্ত্র নেই। কার্যকর সংসদ নেই। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। খুন, অপহরণ, গুম, নির্যাতন ও বিচারহীনতার এক স্বেচ্ছাচারী রাজত্ব চলছে। দেদারছে চলছে ক্ষমতার অপব্যবহার। কারাগারগুলো রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও ভিন্নমতের মানুষ দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে। কথায় কথায় মামলা-হামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতন চলছে। প্রতিবাদের কোনো সুযোগ নেই। টু-শব্দটি করলেই নির্যাতনের খড়গ নেমে আসছে।
চলছে সন্ত্রাস, দখল ও দলীয়করণের বিভীষিকা। বয়োবৃদ্ধ মানুষদের পর্যন্ত দিনের পর দিন পুলিশী রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। সংবাদ-মাধ্যম শৃক্সক্ষলিত। সম্পাদক ও সাংবাদিকরা বন্দী হচ্ছেন। সাংবাদিক দম্পতি নৃশংসভাবে খুন হলেও বিচার হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। নারী-শিশুরা নির্যাতিত ও নিহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বিভিন্ন ধর্মের লোক, এমনকি বিদেশীরা খুন হচ্ছেন। সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কোথাও কারো কোনো নিরাপত্তা ও অধিকার নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে নির্বিচারে গুলি করে প্রতিবাদী মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে। ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করা হচ্ছে। এগুলো কি ক্ষমতার অপব্যবহার নয়? ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি? শেয়ার বাজার লুঠ করে লক্ষ কোটি টাকার তছরূপ হয়ে গেল। নিঃস্ব হলো নিম্ন আয়ের মানুষ। ব্যাংকগুলো লুঠপাট করে শেষ করে দেয়া হচ্ছে। একটি বেসরকারি সংস্থার হিসেবে গত ৭ বছরে ব্যাংক থেকে চুরি হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী ব্যাংকলুটের হাজার হাজার কোটি টাকাকে ‘সামান্য’ বলে অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে দায়মুক্তি দিয়ে সীমাহীন দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। দুর্নীতির প্রমাণিত অভিযোগের সাজা সুপ্রিম কোর্টে বহাল থাকা ব্যক্তিরও মন্ত্রিসভায় ও সংসদে সদস্যপদে বহাল থাকছে। জনগণের অর্থ এবং জনস্বাস্থ্যের তোয়াক্কা না করে পচা গম আমদানির জন্য দায়ী লোকও বহাল তবিয়তে মন্ত্রিত্ব করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নামে আইটি খাতে বিশাল দুর্নীতি চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রিজার্ভের অর্থ থেকে ৮শ’ কোটি টাকা কারসাজি করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সম্পন্ন বিচারের নথিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রবাসীপুত্রের সন্দেহভাজন একটি একাউন্টেই প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থের কথা এসেছে। সে ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য না করে অপ্রমাণিত অভিযোগে মামলা করে সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও হেনস্তা করা হচ্ছে। অপপ্রচার করা হচ্ছে বিএনপির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের গরীব মনুষের অর্থ চুষে সুইস ব্যাংকের একাউন্টগুলোতে জমানো টাকার স্তুপ ফুলে ফেঁপে উঠছে। ২০১৫ সালে শুধু এক বছরেই এই সব একাউন্টে বেড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ফাঁস হওয়া পানামা পেপার্সে বিদেশে অবৈধ পথে ক্ষমতাসীনদের পাচার করা বিপুল অর্থের খবর প্রকাশিত হয়েছে। অফসোর কোম্পানিগুলোতে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই কেলেংকারি নিয়ে দুদক একটি মামলাও দায়ের করেনি। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে তহবিল প্রত্যাহারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। দেশে এখন কোনো খাতই অবাধ লুটপাট থেকে মুক্ত নয়। অথচ এখনো প্রচারণা ও মামলা চলছে আমাদের বিরুদ্ধে। দেশের সম্পদ লুট করে কারা, আর মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হয় কাদেরকে? অপপ্রচার চলে কাদের বিরুদ্ধে? আমাদের বিরুদ্ধে তো কম অপপ্রচার করা হয়নি। সারা দুনিয়ায় চষে বেড়িয়ে এবং সব তন্নতন্ন করে দেখে কয় লাখ বা কয় কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আজ পর্যন্ত আনতে পেরেছে? অথচ তাদের বিরুদ্ধে এক-একটি ঘটনাতেই শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ আজ সকলের মুখে মুখে। যাদের কথা এবং কাজ সম্পূর্ণ বিপরীত এবং যারা নিজেরা দুর্নীতি করে অন্যদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়, তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী এই মামলা দায়ের করা হয়েছে।
কাজেই মাননীয় আদালত, আমি অনুরোধ করবো এই মামলা পর্যালোচনা ও রায় প্রদানের ক্ষেত্রে আইন ও বিবেকের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে আপনাকে সর্বোচ্চ সাবধানতা ও সচেতনতা বজায় রাখতে হবে।
কোনো প্রচারণা, ধুম্রজাল বা কথার মারপ্যাঁচের ওপর নির্ভর না করে, অস্পষ্ট কোনো ধারণা বা অনুমানের ওপর ভিত্তি না করে আপনাকে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অগ্রসর হতে অনুরোধ করবো। সুনির্দিষ্ট, স্পষ্ট ও সন্দেহাতীতভাবে আপনাকে প্রমাণ পেতে হবে আমি কিভাবে, কোথায়, কোন্ পদক্ষেপে আইন লংঘণ কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছি। আমি আবারো দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আপনাকে জানাতে চাই যে, আমি শহীদ জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের কোনো কার্যক্রম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচালনা করি নাই। ফলে শহীদ জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট্রের সঙ্গে আমার প্রধানমন্ত্রীত্বের কোনো সম্পর্ক নাই।
আমি বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে এবং আমার ওপর অর্পিত ট্রাস্টের দায়িত্ব পালনকালে রাষ্ট্রীয় বা সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ট্রাস্ট্রের অনুকূলে কোনো কিছু করতে কখনো কোনো নির্দেশনা দেইনি। কিংবা রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কোনো মেশিনারিকেও ব্যবহার করিনি। এই প্রক্রিয়ায় দলের নেতা-কর্মী এবং শহীদ জিয়ার সমর্থক, অনুসারী ও সহানুভূতিশীলরাই কেবল জড়িত। আমি সরকারি কোনো অর্থ নিইনি বা নেয়ার নির্দেশ দিইনি। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কাউকে অনুদান দিতে বা নিতেও বলিনি। আমার জানা মতে, শহীদ জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টে সকল লেনদেন সম্পূর্ণ বৈধ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। কাউকে কোনো রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে বা অঙ্গীকার করে বা লোভ দেখিয়ে কিংবা কোনো ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে অথবা প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে এ তহবিলে কোনো টাকা নেয়া হয়নি। এমন কোনো অভিযোগও কেউ কখনো করেনি এবং সাক্ষ্য-প্রমাণও নেই।
আমার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তেমন ধরনের কোনো অভিযোগও উত্থাপন করেনি কিংবা এর কোনো প্রমাণও নেই। কাজেই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমার বিরুদ্ধে এ মামলাই হতে পারে না। তবুও হয়েছে কেবল আমাকে হেনস্তা ও হয়রানি করার উদ্দেশ্যে।
মাননীয় আদালত,
এই প্রসঙ্গে আমি একটি মামলার নজির উল্লেখ করতে চাই। মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের আমলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুদক ঐ মামলাটি দায়ের করেছিল।
বার্জ মাউন্টেড দুর্নীতি মামলা নামে বহুল আলোচিত সেই মামলায় অভিযোগ করা হয়েছিলো যে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার ব্যাপারে টেন্ডারের সার-সংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর দফতর ১৯৯৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সার-সংক্ষেপটি গ্রহণ করে। এরপর ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য ধানমন্ডিতে একটি বাড়ি ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা দামে কেনা হয়।
শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণাধীন “বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট”-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকগণ। সামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড গ্রুপের সেই মালিকরাই আবার উল্লেখিত টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী মেসার্স ওয়ার্টশিলা গ্রুপের স্থানীয় প্রতিনিধি ছিলেন। সেই স্থানীয় প্রতিনিধিগণ ১৯৯৭ সালের ৭ অক্টোবর ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর তারিখে ৫৫ লাখ টাকা ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এ দান করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা তাদের অনুকূলে ১৯৯৭ সালে ১১ অক্টোবর তারিখে সার-সংক্ষেপ অনুমোদন এবং ১৯৯৭ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখে বিদ্যুৎ ক্রয় ও বাস্তবায়ন চুক্তি সই করেন। এরপর আবার ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর ঐ স্থানীয় প্রতিনিধিগণ ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর জমি কেনা বাবদ আরো এক কোটি টাকা প্রদান করেন। আমাদের হাইকোর্ট বিভাগ ঐ মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন। ‘শেখ হাসিনা বনাম রাষ্ট্র’ এই মামলাটির বিশদ বিবরণ ৬৩ ডিএলআর ১৬২-তে উল্লেখ রয়েছে।
মাননীয় আদালত,
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে ট্রাস্টের জন্য চাঁদা গ্রহণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও প্রমাণ থাকার পরেও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা সে মামলা হাইকোর্টে খারিজ হয়েছিলো। যদি সেটা দুর্নীতি না হয়ে থাকে, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহার না হয়ে থাকে, তাহলে আমার বিরুদ্ধে এ মামলার রায় ও ফলাফল কী হওয়া উচিত সেটা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের কোনো কাজই আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে করিনি। এর সঙ্গে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট নয়। কাউকে কোনো সুবিধা দিয়ে অথবা বাধ্য করে ট্রাস্টের জন্য কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। সে ধরণের কোনো অভিযোগও নেই। তবুও আমাকে হেয় ও হেনস্তা করার উদ্দেশ্যেই কেবল এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমি মনে করি, এই মামলা দায়েরের ফলে : I am a victim of an unjust situation. আমি চলমান এক অসঙ্গত পরিস্থিতির শিকার মাত্র। আমি জানি এবং আপনিও বুঝতে পারেন যে, আমার বিরুদ্ধে আনীত এই মামলা সরকারি নির্দেশনায়, বেআইনিভাবে প্রভাবিত হয়ে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার অসৎ উদ্দেশ্যে দায়ের ও পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে আনীত কোনো অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষের কোনো সাক্ষী প্রমান করতে পারেননি। এখন তাদের নানা প্রচারণা ও ধু¤্রজালের মধ্যে সত্যকে তুলে এনে প্রতিষ্ঠা করা আপনার দায়িত্ব। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপনাকে সেই কাজটিই করতে হবে। কারণ, বিচারক হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, সুবিচার মানেই হচ্ছে: The quality of being just, impartial and fair. আপনি এ মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যে ও পটভূমি একজন বিজ্ঞ বিচারক হিসাবে নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছেন। আপনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন যে, আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এজাহার, অনুসন্ধান, অভিযোগপত্র, দুর্নীতি দমন কমিশনের কথিত অনুমোদন এবং মামলার কার্যক্রম বেআইনী ও আইনগত ক্ষমতা বহির্ভূত। আপনার বিবেক ও প্রজ্ঞা নিশ্চয়ই আপনাকে বলছে যে, আমার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে উত্থাপিত কোনো অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি এবং আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস পাওয়ার যোগ্য।
মাননীয় আদালত,
আজ এই মামলায় আমাকে যে বিচারের সস্মুখীন করা হয়েছে তা সমগ্র দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে। আপনি জানেন যে, আমাদের বিচার-ব্যবস্থা নিয়ে দেশে-বিদেশে সবখানে আলোচনা চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশের ফৌজদারী বিচার-ব্যবস্থা নিয়ে সম্প্রতি বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। আমি আশা করি, আপনি এসব অনাস্থার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করবেন। প্রমান করবেন, বাংলাদেশের বিচার-ব্যবস্থা ন্যায়ের মানদন্ডে পরিচালিত হয় এবং এখানে ন্যায়-বিচারক আছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে : "Not only must Justice be done, it must also be seen to be done."
আমি আবারও পরিষ্কার করে বলতে চাই : আমি সজ্ঞানে, জ্ঞানত:, জ্ঞাতসারে কোনো অন্যায় করিনি এবং আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আপনি নির্ভয়ে আমার এ বক্তব্যকে গ্রহন করে সুবিচার করবেন, সঠিক রায় দেবেন এবং আমাকে নির্দোষ ঘোষণা করবেন- এ আমার প্রত্যাশা। মাননীয় আদালত, আপনাকে ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ। আস্সালামু আলাইকুম।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ