শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার অসৎ উদ্দেশ্যের প্রকাশ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে জেরুজালেমকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘটনায় মুসলিম বিশ্ব ক্ষোভে ফেটে পড়েছে।
ট্রাম্প এ ঘোষণা দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার অসৎ উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দিয়েছেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, পৃথিবী উল্টে গেলেও ওয়াশিংটন দখলদার ইসরাইলকে পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাবে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?
পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যে এতদিন যত বিপর্যয় ঘটেছে তার বেশিরভাগেরই জন্য দায়ী আমেরিকা ও ইহুদিবাদী ইসরাইল। সমরাস্ত্র দিয়ে ইহুদিবাদীদের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রবণতা এবং এই দখলদারিত্ব থেকে মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক সংকট সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। এ অঞ্চলের কিছু তাবেদার আরব শাসকের কারণে সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদীরা দ্বিগুণ উৎসাহে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প তার বিতর্কিত ঘোষণার মাধ্যমে সেই অপকর্মকে পরিপূর্ণতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের আরো কিছু ভূখ- জবরদখল করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় ৭০ বছর হলো। আর ইহুদিবাদীরা বায়তুল মুকাদ্দাস বা জেরুজালেম দখল করেছে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে। এই দীর্ঘ সময় ধরে ফিলিস্তিনিদের একাংশ বিভিন্ন দেশে শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছেন, একাংশ জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ইহুদিবাদীদের দখলদারিত্বের মধ্যে চরম বৈষম্য ও হুমকি-ধমকির মধ্যে বসবাস করছেন এবং আরেক অংশ গাজা উপত্যকায় অবরুদ্ধ অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। ট্রাম্প তার ঘোষণার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি ফিলিস্তিনি জনগণের এই দুর্দশাকে আরো বাড়িয়ে দিতে চান।
কিন্তু বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কেন এই ঘোষণা দেয়ার জন্য এই সময়টিকে বেছে নিলেন তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। আসলে ইহুদিবাদী ইসরাইল নিজের দখলে থাকা জেরুজালেম শহরকে ইহুদিকরণ করার জন্য বহুদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। তারা এই শহরের মূল অধিবাসী ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের ভূমিতে ইহুদি উপশহর নির্মাণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধরে আনা ইহুদিদেরকে সেখানে বসবাস করতে দিয়েছে। মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে ইহুদিদের উপাসনালয় তৈরি করেছে। এমনকি মুসলমানদের প্রথম কেবল আল-আকসা মসজিদে উগ্র ইহুদিবাদীদের অনুপ্রবেশের সুযোগ দিয়ে এই পবিত্র স্থানের অবমাননা করেছে।
আসলে ট্রাম্প জেরুজালেম সংক্রান্ত বিতর্কিত ঘোষণা দিয়ে দু’টি লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছেন। প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে,  উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী দায়েশকে লেলিয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে টুকরো টুকরো করতে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন এই অঞ্চলে ইসরাইলের প্রভাব বিস্তারের জন্য নতুন খেলা শুরু করা।  দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, ফিলিস্তিন ও লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোকে দমন করে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে ঝামেলামুক্ত জীবন দান করা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ওয়াশিংটন দ্বিতীয় লক্ষ্যকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ট্রাম্পের বিতর্কিত ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় এক বিবৃতিতে বলেছে, “ট্রাম্প এ ঘোষণা দিয়ে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং ফিলিস্তিনি জাতির অধিকার মারাত্মকভাবে লঙ্ঘন করেছেন। এখন মুসলিম উম্মাহসহ অন্যান্য স্বাধীনচেতা ও ন্যায়পরায়ণ জাতির উচিত হবে এই গভীর ও দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেয়া।”
ট্রাম্পের ঘোষণার বিরোধিতা করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পর্যন্ত প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমেরিকা ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের বাকি সবগুলো দেশ ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর একদিকে রয়েছে সারাবিশ্ব এবং অন্যদিকে রয়েছে শুধুমাত্র আমেরিকা ও ইহুদিবাদী ইসরাইল।
মার্কিন কংগ্রেস ১৯৯৫ সালের ২৩ অক্টোবর ইসরাইলস্থ মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেম শহরে স্থানান্তরের প্রস্তাব পাস করে। কিন্তু তখন থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার সাহস দেখাননি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনি প্রচারাভিযানের সময় জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি নির্বাচিত হলে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবেন।
ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর তার এই ঘোষণা বাস্তবায়ন না করার জন্য বিশ্বব্যাপী দাবি ওঠে। কিন্তু সেসব তোয়াক্কা না করে তিনি জেরুজালেমকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ১৯৯৫ সাল থেকে ট্রাম্পের আগ পর্যন্ত সব প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসে অনুমোদিত প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রতি ছয় মাস পরপর স্থগিত করে আসছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প তা স্থগিত রাখতে অস্বীকৃতি জানিয়ে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন।  আমেরিকার অভ্যন্তরীণ আইনে এই প্রক্রিয়া বৈধ হলেও আন্তর্জাতিক আইনে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা সম্পূর্ণ অবৈধ।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অনুযায়ী জেরুজালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাস ইসরাইল অধিকৃত একটি শহর হিসেবে গণ্য। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে নিরাপত্তা পরিষদে পাস করা এক প্রস্তাবে বলা হয়, “১৯৬৭ সালে দখলীকৃত ভূখ- ইসরাইল অধিকৃত ভূখ- হিসেবে পরিচিতি পাবে; অবশ্য ফিলিস্তিন-ইসরাইল আলোচনায় কোনো সমঝোতা অর্জিত হলে এর ব্যতিক্রম করা যাবে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ থেকে এ বিষয়টি প্রতীয়মান হয় যে, দেশটি মধ্যপ্রাচ্য আপোষ আলোচনায় সব সময় ইহুদিবাদী ইসরাইলের নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি, মুসলিম দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব সৃষ্টি করা এবং মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি করা হচ্ছে আমেরিকার প্রধান কাজ। আর এখন মার্কিন সরকার জেরুজালেমকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করছে।
অবশ্য ট্রাম্পের ঘোষণার পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করেছে। দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে আপোষ আলোচনায় ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে চরম নমনীয় আচরণ এবং ওয়াশিংটনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে সন্তুষ্ট থাকার কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলমানদের প্রথম ক্বেবলাসমৃদ্ধ শহরের ব্যাপারে এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ ঘোষণা দেয়ার সাহস পেয়েছেন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (রহ.) ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলদার প্রকৃতি ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যকামী লক্ষ্যের কথা বিবেচনা করে মুসলিম বিশ্বকে কুদস দিবস পালনের আহ্বান জানান।
মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশেষ করে উগ্র তাকফিরি জঙ্গি গোষ্ঠী দায়েশের তৎপরতা প্রমাণ করে, মধ্যপ্রাচ্য বর্তমানে একটি স্পর্শকাতর মুহূর্ত অতিক্রম করছে। এ অবস্থায় মুসলিম বিশ্বকে অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো শত্রুর ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার ক্ষেত্রে অনেকাংশে সফল হলেও চুপচাপ বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বর্তমান স্পর্শকাতর মুহূর্তকে বেছে নেয়ায় বোঝা যায়, বিশ্ব ইহুদিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্র মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে চায়। তারা আল-আকসা মসজিদ ও জেরুজালেম শহরের ইসলামি পরিচিতি ধুয়েমুছে ফেলতে চায়। আমেরিকা জানে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অশুভ লক্ষ্যগুলো চরিতার্থ করার জন্য ইহুদিবাদী ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়ার বিকল্প নেই।
অথচ মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের তৃতীয় পবিত্রতম এই স্থানকে রক্ষা করা মুসলিম বিশ্বের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। এখন আর মৌখিক নিন্দা জানানোর মাধ্যমে দায়িত্ব শেষ করার সুযোগ নেই। মুসলমানদের একথা প্রমাণ করে দিতে হবে, ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সব মুসলমানের বুকে আঘাত করেছেন। -ইন্টারনেট থেকে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ