বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বেগম জিয়ার মামলা ও নির্বাচনের শর্ত

আজ ফেব্রুয়ারি মাসের ছয় তারিখ, একদিন পর আট তারিখ। এই দিনটি অর্থাৎ ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ নিয়ে দেশে বিদেশে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। এই দিন কি ঘটবে অনেকে জানতে চেয়েছেন। উপলক্ষ বেগম জিয়ার মামলা। বখশিবাজারের আলীয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে স্থাপিত মহানগর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারাধীন মামলার বিচারক এই দিন রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেছেন। তার এই ঘোষণার পর পরই বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন রকমের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। একজন মন্ত্রী বলেছেন যে এই মামলায় বেগম জিয়ার শাস্তি হবে এবং তাকে জেলে যেতে হবে। তার এই কথাকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন উঠেছে যে তিনি রায় জানলেন কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া গেছে। উৎসাহী রাজনৈতিক কর্মীরাই বলেছেন রায় আগেই লেখা হয়ে গেছে, বিচার একটা প্রহসনমাত্র, নাটক। বাস্ প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ ঘোষণা দিলেন যে বিএনপি মাঠে নামবে এবং এই দিন ময়দানে থাকবে। আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাসীন দল থেকে পাল্টা হুঙ্কার আসলো যে তারা ময়দান দখলে রাখবে এবং সেখানেই বিএনপি’র সাথে মোকাবেলা করবে। অতি উৎসাহীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ আগুনে ঘৃতাহূতি দেয়ার জন্য নতুন তথ্য নিয়ে হাজির হলেন, তারা বললেন যে বিএনপির সমর্থনে এই দিন জামায়াতও মাঠে থাকবে। আবার তাদের বিপক্ষে আরেকটা গ্রুপও হাজির হয়েছে বলে মনে হয়। তারা বলছে যে জামায়াতের দুর্দিনে বিএনপি কি করেছে যে জামায়াত তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসবে? অবস্থাটা এমন হয়েছে যে সম্ভবত ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে দেশে এমন একটা ঘটনা ঘটবে যাতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাবে। এই যুদ্ধ যদি আদৌ বাধে তাহলে তার পরিণতি কি হবে সে সম্পর্কে কেউ কোনও চিন্তা করছেন বলে মনে হয় না। আবার যুদ্ধ বাধবেই বা কেন। এর আগে অনেক রায় হয়েছে; জেল হয়েছে, ফঁসির রায়ও হয়েছে। কই যুদ্ধ ত বাধেনি। হ্যাঁ জনগণ প্রতিবাদ করেছে এটা ঠিক। আর এও ঠিক যে এমন একটি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদী জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করার জন্য একই দিন পুলিশের গুলিতে ৭৭ জন লোক প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু তাতে কিছু হয়নি। এখন কিছু হবে তা কি আশা করা যায়? আমার দৃষ্টিতে আট আগস্ট রায় ঘোষণার দিন কিছুই হবে না। হওয়া উচিতও হবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যারা যুদ্ধাংদেহী অবস্থানে আছেন তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া দরকার। যারা জামায়াতকে মাঠে নামিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চান তাদের উদ্দেশ্য শুভ বলে আমি মনে করি না।
সরকার বিএনপি প্রধান বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আদালতে তার বিচার হয়েছে। এই মামলা সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে করা একটি মামলা। এই ধরনের মামলা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নেত্রীর বিরুদ্ধেও ছিল এবং অনেকের শাস্তিও হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ১৫টি মামলায় সাড়ে চৌদ্দ হাজার কোটি টাকারও বেশী অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল। বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধেও এই ধরনের মামলা ছিল। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই মামলাগুলো ছিল রাজনৈতিক মামলা। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার দলটির সভানেত্রীসহ সকল নেতা নেত্রীর বিরুদ্ধে রুজু করা মামলা ও মামলার শাস্তি যথাক্রমে প্রত্যাহার ও মওকুফ করে দেন। কিন্তু বিরোধী দল তথা বিএনপি নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে আনীত মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। রাজনীতি এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এখানেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে দু’টি কাজ করেছে। এক. তারা নির্দলীয় নিরপক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের রক্ষাকবচ কেয়ার টেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে যাতে করে তারা নিজেদের ইচ্ছামত নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসতে পারে। দুই. তারা নিজ দলের নেতা-কর্মীদের মামলা ও শাস্তি প্রত্যাহার ও মওকুফ করে নিয়েছে। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের মামলা রেখে দিয়েছে যাতে করে তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়ে পার্লামেন্টে এসে ক্ষমতাসীন হতে না পারে। বেগম জিয়ার মামলা এবং তার রায়কে এই দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। এটা সম্পূর্ণই রাজনৈতিক এবং বিএনপি বা বিরোধী দল মামলা  বা মামলাগুলোকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ মামলাও এই পর্য্যায়েই পড়ে। আওয়ামী লীগ এখানে সফল হয়েছে। এখন মামলার শেষ পর্যায়ে যখন রায়ের প্রশ্ন এসেছে তখন রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে মোকাবেলা করার যে কোনও প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এখানে অনেক স্বার্থান্বেষী মহল ঢুকে পড়তে পারে এবং এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে যার সুযোগ তৃতীয় পক্ষ গ্রহণ করবে, রাজনীতি আর থাকবে না। আমি মনে করি আক্কেলমন্দ কি লিয়ে ইশারা ক’াফি হায়।
শোনা যাচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত তার ভাষণে বলেছেন যে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েই থেমে থাকেননি। নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করে দিয়েছেন। দলীয় প্রচারণায় তিনি, তার মন্ত্রীবর্গ এবং নেতা-নেত্রী সরকারের সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করছেন। অন্যদিকে বিরোধী দল শির দাঁড়া করে খাড়া হতেও পারছে না। ২০ দলীয় ঐক্য জোটকে অবশ্যই এগিয়ে যেতে হবে। আমি শুরুতেই কি যেন শুনতে পারছি। জোট থেকে জামায়াত বিএনপিকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে দেশের বামপন্থী ও আওয়ামী বলয়ের রাজনৈতিক শক্তিসমূহ আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছে। এই চেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে। এই বিষয়টিকে উষ্কিয়ে দেয়ার জন্য নতুন প্রচেষ্টা চলছে। বিএনপিকে জামায়াতের বিরুদ্ধে, জামায়াতকে বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে জামায়াতের দুর্দিনে বিএনপি তার জন্য কি করেছে? কেউ কেউ আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বন্দ্ব যুদ্ধে জামায়াতের অবস্থান ঠিক করতেও চাচ্ছেন এবং দেনা পাওনার নানা হিসাবও কষার চেষ্টা করছেন। আমি মনে করি, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশদলীয় জোটের শক্তিশালী ঐক্যের বিকল্প কিছু নেই। জোটভুক্ত সকল দলের অংশগ্রহণের মধ্যে এই ঐক্য, এখানে পদ পদবির বিষয় নেই। এটা স্বীকার করতেই হবে যে যত ঝড়-ঝঞ্ঝাই আসুক, দল হিসাবে জামায়াত অত্যন্ত শক্তিশালী, দৃঢ় বিশ্বাস ও ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত; তার জনপ্রিয়তা যেমন এলাকাভিত্তিক তেমনি আদর্শ ও চেতনাভিত্তিকও। পক্ষান্তরে জেনারেল জিয়া ও বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তা বহুমুখী। মুক্তিযোদ্ধ জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা ও পরবর্তী রাষ্ট্রপতি জিয়ার দেশ প্রেমের একাগ্রতা, নিয়ম ও সততা-নিষ্ঠা তার দল বিএনপিকে জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছিয়ে দিয়েছিল এবং স্বৈরতন্ত্র থেকে দেশবাসীকে মুক্ত গণতন্ত্রে বিচরণে সহায়তা, কর্মীবাহিনীর নিষ্ঠা একাগ্রতা ও নেতৃত্বের মান প্রভৃতিকে সামনে রেখেই জোটের আসন বণ্টন হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং তার প্রতি লক্ষ্য রেখেই ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে আমি মনে করি। তার আগে বাগবিত-া অপ্রয়োজনীয়।
আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে ২০ দলীয় জোট নেত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কয়েকটি শর্তের কথা বলেছেন তার মধ্যে তিনটি শর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন; ১. নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে, ২. ভোটের আগে সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে এবং ৩. নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। বেগম জিয়ার এই দাবিগুলো অত্যন্ত সংগত এবং নব্বই’র দশকে এই দাবিগুলো আদায় করার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগ বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছিল। এই আন্দোলনেরই এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ “কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন” এই শিরোনামে দৈনিক ভোরের কাগজে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। এই নিবন্ধটির প্রথম কিস্তি ২৩/১০/৯৪ এবং শেষ কিস্তি ২৪/১০/৯৪ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে তিনি এই নিবন্ধে তাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্য করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত এই সরকার ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হবার তিন মেয়াদ যেতে না যেতেই এই আওয়ামী লীগই ভোল পাল্টিয়ে সংবিধান থেকে এই ব্যবস্থা তুলে দিয়ে বর্তমান সংকটের সৃষ্টি করেছে। জনাব তোফায়েল তখন তার নিবন্ধে বলেছিলেন, “আজকে যদি দেশ ও জাতির স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী ৩/৪/৫টা নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করাই তাহলে আমার মনে হয়, আমরা একটা সিস্টেমে যেতে পারবো। অর্থাৎ আমাদের এই আন্দোলন হচ্ছে সাংবিধানিক একটি ভিত্তি দাঁড় করানোর জন্য। আজকাল যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন তারা দ্বিতীয়বার কিভাবে বিজয়ী হবেন, তৃতীয়বার কিভাবে বিজয়ী হবেন, চতুর্থবার কিভাবে ক্ষমতায় থাকবেন, সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে প্রশাসনকে দলীয়করণ করেন। তারা দলকে দুর্নীতির মধ্যে নিমজ্জিত করেন। দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনকে নষ্ট করেন। দলতত্ত্ব কায়েম করতে গিয়ে এমনভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নেন সরকার তখন আর জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে চান না। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কথা ‘জবাবদিহিতা'। আজকে পার্লামেন্টে আমরা যখন দুর্নীতির প্রশ্ন তুলি, অন্যান্য প্রশ্ন উত্থাপন করি, কিন্তু তার কোনো অর্থবহ আলোচনা হয় না। সেখানে কোনো জবাবদিহিতা নেই। কারণ এ সরকার মনে করে, আগামী নির্বাচন যেহেতু তাদের অধীনে হবে, সেহেতু বাংলাদেশের মানুষ তাকে প্রশ্ন করবে না- ক্ষমতায় গিয়ে ভালো করেছে কি করেনি, ওয়াদা রক্ষা করেছে কি করেনি। কিন্তু কোনো সরকার যদি দেখে, নির্বাচনের ৯০ দিন আগে একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, তাহলে অবশ্যই  সে সরকার জনগণের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করবেন। কারণ, তখন সরকার দুর্নীতির আশ্রয় নিতে, নিজের পরিবার-পরিজনকে বিত্তশালী করতে, প্রশাসনকে দলীয়করণ করতে ভয় পাবেন এবং এমন কতগুলো কাজ সরকার করবেন যা ভালো কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। যার ফলে জনগণ তাকে ভোট দেবে। এই লক্ষ্যকে সামনে নিয়েই নিরপেক্ষ, নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন আমরা তুলেছি।”
কেয়ারটেকার সরকারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাও এক ও অভিন্ন মত পোষণ করেছেন। আশির দশকের শেষ ভাগ এবং নব্বই দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত তিনি এই সরকারের পক্ষে অনুষ্ঠিত সভা-সমাবেশ, সাংবাদিক সম্মেলন সর্বত্র একটি কথাই বলেছেন এবং তা হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে কখনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে না।
ক্ষমতাসীন দল প্রশাসনকে দলীয়করণ করে সর্বদাই ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে এবং নির্বাচনকে প্রভাবিত করে তার ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনে। তিনি সর্বদা এ কথাই বলেছেন যে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নাই এবং কেয়ারটেকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন কখনো অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হতে পারে না। তিনি সর্বদা জোর দিয়ে বলেছেন, কেয়ারটেকার সরকারের যেহেতু ক্ষমতায় যাবার অভিলাষ নেই সেহেতু এই ব্যবস্থাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের একমাত্র গ্যারান্টি। ১৯৯৪ সালের ১৫ জুন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জাতীয় দৈনিক ও সংবাদ সংস্থার সম্পাদকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন। এতে তার দলীয় নেতাদের মধ্যে জনাব আব্দুল মান্নান, তোফায়েল আহমদ, আমীর হোসেন আমু ও অধ্যাপক আবু সাইয়িদ উপস্থিত ছিলেন। এতে দৈনিক ইত্তেফাক, ইনকিলাব, বাংলার বাণী, বাংলাদেশ অবজারভার, ফাইন্যানসিয়াল এক্সপ্রেস, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং ইউএনবি’র প্রধান সম্পাদক/সম্পাদকরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৬-০৬-১৯৯৪ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী, মতবিনিময়কালে শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আমি প্রধানমন্ত্রী হব এই ভয়ে ভীত হবার কিছু নেই। প্রয়োজনে আমি নির্বাচন করবো না। তবুও যতদিন গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ না করবে ততদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হোক না কেন তাতে নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না। এরপর গঙ্গা-যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলন অহিংস থাকেনি। সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল। হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে সারা দেশকে অচল করে দেয়া হয়েছিল। বন্দর অচল হবার ফলে আমদানি-রফতানি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থবিরতা এসেছিল। যানবাহন তথা বাস, ট্রাক, ট্রেন ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এই আন্দোলনে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সম্পদ হানি ছাড়াও সারাদেশে মোট ৭১ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে এবং পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে আহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল কয়েক সহস্র। এই সম্পদ ও প্রাণের বিনিময়ে ১৯৯৬ সালে দেশে রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক হানাহানি ও হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে অঙ্গীভূত করে নেয় এবং এই ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দুটিতে শেখ হাসিনার দল এবং একটিতে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়।
সন্দেহ নেই সর্বশেষ কেয়ারটেকার সরকার ও তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল প্রহসনমূলক। সাংবিধানিক বিধান মেনে এই কেয়ারটেকার সরকারটি গঠিত হয়নি এবং তা ছিল এক এগারোর কেয়ারটেকার সরকার। এই সরকারকে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা স্বয়ং তার আন্দোলনের ফসল তথা আওয়ামী লীগের ‘সন্তান বলে’ ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই সন্তানের বদৌলতে এবং প্রতিবেশী দেশের টাকার বসতা পৃষ্ঠপোষকতা ও পরামর্শের বলে ক্ষমতায় এসে তিনি কেয়ারটেকার সরকারের ব্যবস্থাটিকে বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেছেন এবং দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা পুনর্বহাল করেছেন। বেগম জিয়ার এই দাবি গণদাবি। সরকার যদি অব্যাহতভাবে গণদাবি প্রত্যাখ্যান করেন তা হলে দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতারণা থেকে মুক্ত হবার পথ নিজেরাই বেছে নেবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ