শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

এক কাপ চা ...

আফসানা মিমি : এককালে তিনি বেশ ভালো গান করতেন শোনা যায়। তবে সে কথা আজ রহস্যঘন ইতিহাস, এখন  কালে ভদ্রে তারমুখে দু’-একটা অস্ফুট  শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যায় কিনা কে জানে?... কলেজ হোস্টেলের প্রভোস্ট ম্যম...বিশাল একটা ফ্ল্যাটের একমাত্র বাসিন্দা।  বয়স ষাটের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। আত্মীয়- স্বজনেরা যা ছিলো সবাই বিদেশে। চায়ের প্রতি বিশেষ কোনো আকর্ষণ তার কোনোদিনই ছিলো না, শুধু ভার্সিটিতে পড়ার সময়কার ব্যস্তসমস্ত দিনগুলোতে হয়তো নিজেকে সান্ত¡না দিতেন এই ভেবে শেষ বয়সের শীতের বিকেলে রোদে বসে কড়া লিকারে, ঘন দুধ মিশিয়ে চা খেতে খেতে গল্প করবেন,
অসম্ভব রকম মেধাবী হওয়ার সাথে সাথে প্রচন্ড রকম প্রগতিবাদী মানসিকতা, তাই সময় প্রবাহে নামের সাথে যোগ হয়েছে ছোট, বড়, প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় অনেকগুলো ডিগ্রী। সাথে একটা ভালো চাকরি, নারীর ক্ষমতায়ন সুলভ মানসিকতার দরুন সংসারের দিকে ফেরার ফুরসতটুকুই হয়নি, তরতর করে বয়ে গেছে সময়, একইসাথে শ্যুগার লেভেলটাও! আর কাষ্ঠল একটা মাথাব্যথা, এখন নিসঃঙ্গ জীবনের অপ্রিয় চিরসঙ্গী এই মাথাব্যথা সারাতে প্রতি বিকেলে বারান্দায় বসে কড়া  এক কাপ চিনিবিহীন চা খেতে খেতে হয়তো তার কৈশরের কথা মনে পরে, পড়তে পড়তে  মাথাব্যথা শুরু হলে চেঁচিয়ে ওঠা-
মা! এদিকে আসো...
তখন মা নারকেল তেলের শিশিটা এনে আঁজলা ভরে তেল ঢেলে মাথায় অনেকক্ষণ ধরে ঘষে দেবে, আর বলতে থাকবে - আর পড়তে হবে না, ঘুমাও এখন!
মায়ের আদরমাখা বকুনি এখনও কানে অবিকল বাজতে থাকে, চায়ের কাপ শেষ হয়ে আসে, চারিদিকে সন্ধ্যা নামতে শুরু করে, বুজে থাকা চোখ দুটো খুলে আস্তে আস্তে উঠে রুমে চলে যান, হয়তো তার ঘুম পেয়ে গেছে।
দুবছর ধরে এই একই কাহিনী লক্ষ্য করছে তুলি, একই ভাবে প্রতি বিকেলে এসে বসা, একটু পরে চোখ বুজে থাকা, বিকেল গড়ালেই উঠে চলে যাওয়া। টিচার্স কোয়ার্টারের তিন তলার করিডোর ঘেঁষে এই প্রাত্যহিক ঘটনা, ছাত্রী হোস্টেলের চারতলার মুখোমুখি রুমটার জানালে দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায়। ওটাই তুলির রুম!
কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের সাইন্সের ছাত্রী তুলি! প্রভোস্ট ম্যাম সম্পর্কে শুধু এটুকুই তার জানা- ম্যাম জানি কেমন!
এ দুবছরে একবার শুধু ওনার সাথে সামনাসামনি দেখা হয়েছে,আর কথাও। প্রথমদিকে আসার পরে,ম্যাম সবাইকে ডেকে বলে দিলেন, এ হোস্টেলে ফোন রাখা নিষিদ্ধ, তোমাদের কারো কাছে ফোন আছে কিনা
 সত্যি কথা বলতে সবার কাছেই আছে, থাকবে নাই বা কেনো? এ যুগে ফোন ছাড়া কি চলে, তাছাড়া বাড়ি থেকে এই প্রথম এতদূর থাকা, কিন্তু সবমিলিয়েতা কেউ স্বীকার করলো না, কথিত আছে ম্যাম ফোন পেলে জমা নিয়ে নেন, তখন বাবাকে বাড়ি থেকে এসে জরিমানা দিয়ে ফোন নিয়ে যেতে হয়। এত্ত ঝামেলা!
কিন্তু প্রচ- স্পষ্টবাদী তুলি বললো আমার কাছে আছে তো!
তার এই স্পষ্টত বোকামিতে বান্ধবীরা হতবাক, তারা আর একটু বেশি অবাক হয়ে গেলো যখন সবাইকে নির্বাক করে দিয়ে ম্যাম বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে এখন তবে এসো!
কিছুই যখন বলার ছিলো না তখন অযথা এতো কান্ড করার হেতুটা যে কি বিড়বিড় করতে করতে রুমে চলে গেলো  সবাই।
আজও তার ব্যক্তিত্ব দু’বছর আগের মতই সম্ভবত তুলির কাছে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য !
সে যাই হোক, বিকেল হলেই তুলিরও স্বভাব দাঁড়িয়েছে জানালা দিয়ে মুখ বারিয়ে ওনার ব্যক্তিত্বটাকে বুঝতে চেষ্টা করা। কিন্তু আজও তুলি বরাবরের মত অকৃতকার্য!
কিন্তু কি ব্যাপার আজ তো প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, ওনাকে তো দেখা যাচ্ছে না!
অসুখ করলো নাকি? করতেই পারে, বয়স তো আর সুখের নয়।
যাই হোক, রাতে একবার পাশের বেডের রিনি কথা তুললো- প্রভোস্ট ম্যমের কি হয়েছে জানিস নাকি তুলি, আজ ওনাকে দফতরে পেলাম না। একটা এপ্লিকেশনে সই লাগতো। তুলি কি ভেবে বললো- জানি না, তবে জানা যায়।এপ্লিকেশনটা আমাকে দিস তো, কাল একবার কোয়ার্টারের দিকে গিয়ে দেখে আসব ভাবছি।
 :কি বলিস তুই, ম্যমের কোয়ার্টারে যাবি? তা তুই একাই যাস, আমি বাবা পারবো না।
:বেশ, আমিই যাবনি। তোকে যেতে হবে না,
:তোর সাহস বটে তুলি।
:হুম, ঠিক তোর উল্টোটিই যে আমাকে হতে হবে!
পরদিন ঠিক বিকেল বেলায় তুলি গিয়ে হাজির তিন তলার কোয়ার্টার ফ্ল্যাটে, অনবরত কলিংবেল বাজিয়ে চলেছে সে, সোয়া একঘন্টা হলো, তার বিরক্তি আসার কথা,অথচ ওনার কি হলো তা জানার ঔতসুক্য নিয়ে চাইলেও ফিরে আসতে পারছে না।...
প্রায় পৌনে দুঘণ্টা পর টেবিলের অপর প্রান্তে বসে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা এটে খচখচ করে সই করে দিতে দিতে উনি বললেন:
- এভাবে কেউ বাসায় আসেনি কখনো।
তুলি উত্তর দিলো না। আসলে উনি খুশি হয়েছেন নাকি বিরক্ত ,তা ওনার ভাবলেশহীন চেহারা দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
- দু:খিত, তাহলে আমি উঠি?
-এখন বসো, এককাপ চা খেয়ে যাও।
চায়ের প্রতি বিশেষ একটা অনাগ্রহ আছে তুলির। একবার পরীক্ষার আগের রাতে ঘুম ঠেকাতে তিন কাপ কড়া চা খেয়ে সারারাত ঘুমাতে পারেনি সে, আর পরেরদিন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। সেই দু:সহ স্মৃতি সে আজও ভোলেনি। তারপরও সে বসে থাকলো, হয়ত কিছুটা সময় পাওয়া যাবে,তার প্রশ্নের উত্তরটা পেলেও পেয়ে যেতে পারে।
কিছুক্ষণ পর উনি চা নিয়ে এলেন। তুলি কাপ হাতে নিয়ে
ঠাই বসে আছে, আর একটু পরপর একখানা করে প্রশ্ন করছে - আপনি একাই থাকেন?... আর কে কে আছে আত্মীয়,তারা কোথায় থাকে? ইত্যাদি ...  উনি একটারও জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তুলি জবাব না পেয়েও একেবারে দমে গেলো না।
অনেকক্ষণ পরে উনি মুখ খুললেন :
- তোমার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
- অসুবিধা নেই। আমি চা ঠাণ্ডাক পুরোনো ধুলোপড়া ট্রফির দিকে দেখিয়ে তুলি বলে উঠলো :
- বাহ! ভারী সুন্দর, এগুলো সব আপনার? কিসের স্বীকৃতি স্বরূপ?
তুলির শেষ প্রশ্নে উনি কেমন চমকে উঠলেন। হয়ত চোখ ছলছল করলো, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা থাকায় ধরা গেলো না, হয়ত গলাটা ভারী শোনাতো! নেহায়েত কিছুসময় চুপ থাকায় তাও বোঝা গেলো না।
এবার নিরবতা ভেঙে বললেন :
- উত্তরের জানালার ওপারের দৃশ্য দেখলে হয়তো তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেতে পারতে, দু:খিত আমি সেই অনুমতি দিতে পারছি না।
- দৃশ্য না দেখলেও চলবে, গল্প শুনতে পারি মনে হয় । গল্প শুনতে আমি খুব পছন্দ করি।
- সব গল্প তো বলা যায় না, বললে শোনা যায় না, আর শুনলে সহ্য করা যায় না!
তুলি পানির মত একঢোকে চা গিলে, উঠে দাঁড়ালো
- আজ তবে যাই, সন্ধ্যা হয়ে আসছে’।
এই বলে হনহন করে বেড়িয়ে এলো।
- দরজা ভিড়িয়ে দিও।
এটুকু বলে উনি ঘরের ভেতর চলে গেলেন।
দ্রুত পায়ে তুলি কোয়ার্টার গেইট দিয়ে বেড়িয়ে এলো, এবার বুঝি আর পা চলছে না। সে ঠিক বুঝতে পারছে,
‘এই গল্প প্রাপ্তির নয়, এই গল্প হারাবার’।
কোয়ার্টার গেইট থেকে হোস্টেল গেইট মিনিট পাঁচেক পথ। পথে একটা মোড়ে এসে তুলির পা থেমে গেছে... একটা বিলবোর্ড! এটা কি এখানে ছিলো না?
নাকি সে আগে লক্ষ্য করেনি, সে নিজেও জানে না। বিমূঢ় হয়ে একবার বিলবোর্ডের দিকে আর একবার কোয়ার্টারের জানালার দিকে তাকাচ্ছে। একটা সরল অংকের জটিল সমাধান খুব সম্ভব সে মিলিয়ে ফেলেছে...
বিলবোর্ডে লেখা ছিলো -
‘দেখিয়ে দাও, অদেখা তোমায়।’

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ