শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

লালন মুচি হলেও তার অন্তর বিভূতিময়

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : লালন দুই দশকের অধিক কাল ধরে কমলাপুর রেলস্টেশনে জুতাসেলাই আর পোলিশের কাজ করে। প্রতিদিন ক’টাকাইবা সে রোজগার করে? ৪শ’ থেকে ৫শ’। হয়তো এ থেকে আবার চাঁদাও দিতে হয় নিয়মিত। ৪ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসারের চাকা ঠেলতে হয় লালনকে বাকি টাকায়। ৪ থেকে ৫শ’ টাকা আজকাল তেমন কিছু নয়। চাল, ডাল, সবজি কিনতেই শেষ। ঘরভাড়াও দিতে হয় মাসশেষে ২ থেকে ৩ হাজার টাকার মতো। এতে বস্তিঘরের ভাড়া হতে পারে। এমনই কষ্টের কেষ্ট হচ্ছে লালন।
হ্যাঁ, কমলাপুরের লালনের কথাই বলছি। যার জন্য পৃথিবীর আলো আর ভালোবাসার স্পর্শে এখনও বেঁচে আছেন ট্রেনে দু’পা বিচ্ছিন্ন হওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের ছাত্রী রুবিনা। লালন শুধু যে রুবিনাকে উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হয়েছিল তা কিন্তু না। ওর বিচ্ছিন্ন দু’পা জড়িয়ে ওকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়ে দেয়। ওই দিন কমলাপুর রেলস্টেশনে কি লালন একা ছিল? রেলওয়ের লোকজন, পুলিশ, যাত্রীরা ছিলেন না? ছিলেন। সবাই ছিলেন। কিন্তু তারা কেউ রুবিনাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি। বিচ্ছিন্ন পা, রক্তাক্ত ও বিপন্ন মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে মুচি লালন তা সত্যই বিরল এবং অভাবনীয়। শুধু রুবিনাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েই থেমে থাকেনি লালন। এরপর প্রায় প্রতিদিনই আসছে হাসপাতালে। খবর নিচ্ছে রুবিনার প্রায় নিয়মিতই।
লালনের এটুকু পরিচয় হয়তো অনেকেরই জানা হয়ে গেছে ফেসবুক অথবা প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে। তার একটা বাইসাইকেল দরকার ছিল এমনটাই জানিয়েছিল সে।  কিন্তু গত ৪ ফেব্রুয়ারি পার্থ রায় নামে এক তরুণ হাসপাতালে গিয়ে আবিষ্কার করে অন্যরকম এক লালনকে।
তার আগে বলে রাখা ভালো যে, রুবিনার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন অনেকেই। এসেছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব হূমায়ুন কবির। সঙ্গে এনেছিলেন রান্না করা খাবার। রুবিনার মায়ের জন্য এনেছিলেন জামাকাপড় আর জুতা। তিনি এর আগেও এসেছেন রান্না করা খাবার নিয়ে। এসেছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত রওশন মনি। তিনি রুবিনার পাশের গ্রামের। ছুটে এসেছেন আহত মেয়েটিকে একটু আশ্বাস দিতে। পাশে দাঁড়াতে। তিনি করতে চান লালন আর রুবিনার জন্য সামান্য কিছু। এসে কিছুক্ষণ পরেই লালনের হাতে একটা টাকার খাম ধরিয়ে দেন তার দায়িত্ববোধ ও সাহসিকতার পুরস্কার হিসেবে। কিন্তু লালন যা করলো তা হতবাক হবার মতো বৈকি!
এবার মুচি লালনের কথা শুনুন। কী করেছে সে? খামটা হাতে নিয়ে এক মুহূর্তও নিজের হাতে রাখবার দরকার মনে করেনি লালন। সঙ্গে সঙ্গে তুলে দেয় রুবিনার হাতে। আর বলে, ’আগে আপায় ভালো হোক। তাহলেই আমি খুশি।’
হয়তো বিষয়টা জেনে আশ্চর্য হচ্ছেন। আসলে ঠিক এমন করেই সবাইকে অবাক করেছিল লালন সেদিন। কমলাপুর রেলস্টেশনে এক কোণায় বসে লালন। সঙ্গে থাকে জুতা সেলাইয়ের জন্য সুঁই-সুতা, বাক্সে চামড়ার টুকরো, কালি, ব্রাস। আর হাত চালিয়ে যা পায় তা দিয়েই চালাতে হয় ৪ সন্তানসহ নিজের সংসার। নিজে এতো টানাহেঁচড়ায় থেকেও লালন যা করলো তা রীতিমত বিস্মিত হবার ব্যাপার।
কিছুক্ষণ পর লালন চলে যায় নিচে। প্রায় বিশ মিনিট পর পার্থসহ অন্যরা নিচে নেমে দেখেন: লালনের হাতে মিষ্টির প্যাকেট। মুখে হাসি। সবাইকে দেখেই জড়ো করে ধরে বললো, ’ভাই আপনারা টাকা নিয়ে যান, কিছু খান, আমি এতো টাকা কী করবো?’
অবাক হবার মাত্রাটা যেন আরও বেড়ে গেল পার্থ ও তার সঙ্গীদের। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে লালনকে ওপরে পাঠান তারা।
প্রায় ২০ মিনিট পর ওয়ার্ডে ফিরে এসে শোনেন, যাওয়ার সময় নাকি মিষ্টি আর কিছু টাকাও দিয়ে গেছে লালন রুবিনার হাতে। শুধু তাই নয়, রুবিনার আশপাশে থাকা বেডের রোগীদের হাতেও ৫শ’ টাকা করে দিয়ে গেছে। অর্থাৎ তাকে দেয়া এক টাকাও নিজের জন্য রাখেনি লালন। এসব কথা লেখেন পার্থ রায় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে।
ধন-সম্পদ বা বিত্ত-বৈভব অনেকেরই থাকে। তা আছেও। মধ্যপ্রাচ্য বা অন্য কোনও ধনি দেশে যাবার দরকার নেই। আমাদের এ দেশেও বড়লোক আছেন, যাদের সম্পদের কোনও হিসাব নেই। নিজেরাও জানেন না তাদের কত টাকা কোথায় আছে। অনেকে বিদেশের ব্যাংকে ডলার আর ইউরো জমিয়ে রেখেছেন। তার হিসাব জানা নেই। এদের কেউ কেউ তা তুলতেও পারছেন না। তবু রুবিনা কিংবা লালনদের জন্য তাদের পকেট থেকে কিছু বেরোয় না। যাদের বেরোয় তারাও অনেকে রুবিনাদের মতো। চাকুরির অর্থে কোনওমতে দিন চলে। তাদেরই পকেট থেকে বেরোয় কিছু না কিছু। বড়লোকের এদিকে নজর দেবার অবকাশ কই?
পেশায় মুচি লালন অন্য সবাইকে টেক্কা দিয়ে যেভাবে রুবিনাকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়ে ওর জীবন রক্ষা করেছে তা এক কথায় নজিরবিহীন। কমলাপুর রেলস্টেশনে দায়িত্বরত অনেকেই ছিলেন। ছিল রেলপুলিশ। মেট্রোপলিটান পুলিশের সদস্যদেরও থাকবার কথা। এছাড়া আরও অনেক শিক্ষিত ভদ্রলোক নিশ্চয়ই সেদিন কমলাপুর রেলস্টেশনে ছিলেন। কিন্তু কারুর বিবেক সাড়া দেয়নি আহত ও মরণাপন্ন মেয়েটিকে হাসপাতালে নেবার জন্য। মানুষের চোখে অশিক্ষিত ও নিম্নপেশার লালনের বিবেক কীভাবে জেগে উঠলো তা ভেবে বিস্মিত হতে হয় বৈকি বারবার। এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে খাটো করে লাভ নেই। বরং এজন্য লালনকে এবং ওর কর্তব্যবোধ দেখে তথাকথিত শিক্ষিতদের নিজেনিজে চপেটাঘাত অনুভব করা উচিত।
ছোটবেলা মানে ছাত্রজীবনে একটা প্রবাদ শুনেছিলাম। তখন এটা শুনে খুব খারাপ মনে হতো। এখন কিন্তু ততোটা খারাপ মনে হয় না। প্রবাদটা হচ্ছে, ‘যতো পড়া ততো শড়া।’ কারণ লেখাপড়া জানা মানুষ অন্যকে ঠকায়। প্রতারণা করে। স্বার্থপর হয়। কিন্তু অশিক্ষিত নিরক্ষর মানুষ হয় সহজ-সরল। সাধামাটা। কারুর ক্ষতি করে না। ওদের মনে অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকে। কপটতা কী তা ওদের জানা নেই। কর্মজীবনে অনেককেই দেখা যায় যাদের কথা ও কাজে মিল নেই। বাইরে এক। ভেতরে অন্যরকম। স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় এমন সহকর্মীর রোজ দেখা মেলে। অথচ এরা শিক্ষিত। আধুনিক। চেহারাসুরতে বেশ পরহেজগার। কিন্তু ‘বগল মে ইট’। অথচ লালনের মতো অশিক্ষিতরা অন্যের বিপদে ছুটে যায়। নিজের কাজ ফেলে অন্যের জীবন বাঁচাতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। এখন বলুন, খাঁটি সোনা কাকে বলবেন? লালনকে, না যারা সেদিন রুবিনার বিপন্ন অবস্থা দেখে দ্রুত সটকে পড়েছিলেন ঝামেলা এড়িয়ে? অবশ্য ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। সব শিক্ষিতই স্বার্থপর এমন বলা যায় না। আবার সব অশিক্ষিতই লালনের মতো সাহসী এবং কর্তব্যসচেতন তাও নয়।
ভালো-মন্দ সবার মধ্যেই থাকে। বিত্তবান হলেই সব খারাপ কিংবা সব বিত্তহীনই লালনের মতো ভালো মানুষ হবেন এমন ভাবা মুশকিল। তবে লালন পেশায় মুচি হয়ে যে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে তা এককথায় অনন্য। লালন চটজলদি রুবিনাকে যেভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেছে তা মুচির মতো এক নিম্নপেশার মানুষের পক্ষে সত্যই কঠিন। কারণ হাসপাতাল ঘিরে আজকাল যেসব অশুভ চক্র তৎপর থাকে তাতে একজন সচেতন শিক্ষিত মানুষের পক্ষেও একাজ সম্পন্ন করা বেশ দুরূহ। কিন্তু লালনের পক্ষে কীভাবে তা সম্ভব হলো ভেবে বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
মানবতা, মহানুভবতা, ঔদার্য, বিপন্নের সহায়তা ইত্যাদি গুণাবলী সবার থাকে না। কারুর বিপুল অর্থ-বিত্তের সম্ভার হাতের মুঠোয় থাকলেও লালন হতে পারেন না। বেচারা লালন রুবিনার জন্য যা করেছে তা একটি অভাবনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার অভাব বা দারিদ্র্য দেখে অনেকে সাহায্য করতে চাইলেও সে নেয়নি। বরং রুবিনার সুস্থ হয়ে ওঠবার বিষয়টিকে সে প্রাধান্য দিয়েছে। এটা অনেকেই পারেন না। বরং একশ্রেণির মানুষকে পথেঘাটে, বিভিন্ন যানবাহনে দেখা যায় ছেলে, বাবা কিংবা মায়ের ইনিয়েবিনিয়ে মারাত্মক অসুখের কথা বলে অর্থ সাহায্য চাইতে। খোঁজ নিলে দেখা যায় এদের সিংহভাগই প্রতারণা করে অর্থ রোজগার করেন। মানুষের কাছে মিথ্যে বলে অর্থ রোজগার যারা করেন তারা প্রতারক। ঠকবাজ। অবশ্য সাহায্যপ্রার্থী সবাই মিথ্যুক নন। এদের মধ্যে দুই-একজন প্রকৃত বিপদাপন্ন অবশ্যই থাকেন। এদের খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা অবশ্যই দরকার।
কোন মানুষ কখন বিপদাপন্ন হয়ে পড়েন বলা যায় না। রুবিনা কি জানতেন তাকে এমন নিদারুণ সংকটের মুখোমুখি হতে হবে? কল্পনাও করেননি। কত আশা আর স্বপ্ন নিয়ে তিনি পঞ্চগড়ের গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। পড়াশোনা করছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন তার মাথায় যেন বজ্রাঘাত ঘটলো!  মাথা ঘুরে রেললাইনে পড়ে গেলে ইঞ্জিনের চাকায় তার দু’পাই কাটা পড়ে। এমতাবস্থায় লালন তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়। এতে রুবিনা প্রাণে বেঁচে গেছেন। আমরা তার পরিপূর্ণ সুস্থতা চাই। তবে রুবিনার পা পাবার সম্ভাবনা নেই। হয়তো কৃত্রিম পায়ের ওপর নির্ভর করেই তাকে চলতে হবে। মেয়েটির সব স্বপ্ন আর আশা-আকাক্সক্ষা এভাবে মিসমার হবে আমরা কেউ আশা করিনি।
দুর্ভাগ্যক্রমে আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকার বিপন্ন রুবিনাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসা পেশায় সামান্য মুচি হলেও লালনের অন্তরে যে মহানুভবতার বিভূতি দেখেছি তা অনন্য এবং অসাধারণ। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে খাটো করতে চাই না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ