বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ভাষা এবং ভাষা দর্শনের লড়াই

পঞ্জিকার পাতায় এক উজ্জ্বল দিন ২১শে ফেব্রুয়ারি। ২১ আমাদের অহংকারের দিন, জাতীয় জাগরণের দিন। আগে এ দিনটি পালিত হতো শহীদ দিবস হিসেবে। ২০০০ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এর লক্ষ্য মানুষকে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে আরও সচেতন করা। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এই জনপদের মানুষ পালন করেছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা সংগ্রাম করেছে, যার চূড়ান্ত পরিণতি লক্ষ্য করা যায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। রক্তের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে বাংলা পায় তার যোগ্য স্বীকৃতি। তাই আজও আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারকে।
মাতৃভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার, মৌলিক অধিকার। জন্মের পর মায়ের কোলেই মানুষ মাতৃভাষার সাথে পরিচিত হয়। পরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুর মাতৃভাষা শেখার বিষয়টি পূর্ণতা পেতে থাকে শিক্ষা ও চর্চার মাধ্যমে। আমরা জানি, শিক্ষা তথা জ্ঞান অর্জন ছাড়া মানুষ যোগ্য হতে পারে না, জাতি এগুতে পারে না। কিন্তু ভাষা ছাড়া কি জ্ঞান অর্জন কখন ও সম্ভব? জ্ঞান বলি, ভাব বলি কোন কিছুরই প্রকাশ ভাষা ছাড়া সম্ভব নয়। ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআনে ভাষা প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে। সূরা আর-রহমানের ৩-৪ নম্বর আয়াতে মহান প্রভু বলেছেন, “আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন।” আর ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা উপলব্ধি করা যায় পবিত্র কুরআনের সূরা ইব্রাহিমের ৪ নম্বর আয়াতে। এই আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষি করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।” পবিত্র কুরআনের আর একটি আয়াত থেকে এ কথা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায় যে, পৃথিবীতে এতো যে ভাষা তা আসলে বৈচিত্র্যের সমাহার। তাই ভাষাকে কেন্দ্র করে কারো প্রতি বিদ্বেষ কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদ মানবোচিত বিষয় হতে পারে না। এ কারণেই পবিত্র কুরআনে সূরা রূমের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।” পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত তিনটি সূরায় ভাষা সম্পর্কে যে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে, তার আলোকে মানব জাতি নিজেদের জন্য একটি ভাষা-দর্শন নির্মাণ করতে পারে।
বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সেই বিষয়টি এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আইন-আদালতে, প্রশাসনে চলছে ইংরেজি ভাষা। জনসাধারণের কাছে বিদ্যুৎ, পানি ও টেলিফোনের বিল আসে ইংরেজি ভাষায়। ডাক্তার সাহেবরা বাংলাভাষী মানুষকে ব্যবস্থাপত্র দেন ইংরেজি ভাষায়। এতে মানুষকে পড়তে হয় অসুবিধায়। কিন্তু জনগণকে এমন অসুবিধায় ফেলার কারণ কী? এখন তো ইংরেজি কিংবা উর্দুওয়ালারা সরকার চালান না, বাংলা ভাষীরা সরকার পরিচালনার পরও কেন আজ বাংলা সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত নয়? এর কোন সদুত্তর আছে কী? সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ আরো কিছু বিষয়ে অনুবাদ ও পরিভাষা সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছু কাজ হয়েছে, তবে বাকি রয়েছে অনেকটাই। প্রসঙ্গত এখানে আকাশ-সংস্কৃতির কথাও উল্লেখ করতে হয়। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রেই অকারণে বাংলা ভাষার সাথে মিশ্রণ ঘটানো হচ্ছে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার। এমন মিশ্রণ ভাষার ক্ষেত্রে দোষণীয়। এছাড়া অনেকেই হীনমন্যতার কারণে কথা বলতে গিয়ে অযথা বাংলার সাথে ইংরেজির মিশ্রণ ঘটান। অনেকে আবার কথা বলতে গিয়ে বাংলার সাথে আঞ্চলিক ভাষারও মিশ্রণ ঘটান। এসব যেন ভাষার ক্ষেত্রে এক ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা। এমন উচ্ছৃঙ্খলতা পরিহার করে আমাদের উচিত বাংলা ভাষার শৃঙ্খলাকে মান্য করা।
পরিশেষে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট, দহন-পীড়ন, নিষ্ঠুরতা, উগ্রতা ও বৈরীতা নিয়ে কথা বলতে হয়। একুশের সাথে ন্যায়, মানবিকতা, অধিকার ভাবনা ও গণতান্ত্রিক চেতনা যে উচ্চতায় জড়িত ছিল, বর্তমান সময়ে তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের একুশের আনুষ্ঠানিকতা তেমন অর্থবহ হয়ে উঠতে পারছে না। বিষয়টি কি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক নয়?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ