শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ওষুধের বাজার

দেশের ওষুধের বাজারে বর্তমানে চরম বিশৃংখলা ও স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। চিকিৎসার জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে জনগণকে শুধু বেশি দামই দিতে হচ্ছে না, প্রতারিতও হতে হচ্ছে। বিগত কয়েকদিনের দৈনিকে প্রকাশিত এবং বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত রিপোর্টে জানা গেছে, এ ব্যাপারে অন্তরালে ওষুধের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি রয়েছে নামকরা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি। ভীতি ও উদ্বেগের কারণ হলো, সব জেনেও সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় খাদ্যপণ্যের মতো সাধারণ ওষুধের পাশাপাশি দাম বাড়ানো হচ্ছে এমনকি জীবন রক্ষাকারী সকল ওষুধেরও। রিপোর্টে বিশেষ করে ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধের কথা জানানো হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে,  ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধে এরই মধ্যে ছেয়ে গেছে দেশের ওষুধের বাজার। এসব বিষয়ে জানা সম্ভব হচ্ছে না বলে জনগণও ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধই কিনছে এবং খাচ্ছে। তারা শুধু অসুস্থ ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, নানা অসুখে ভুগে বহু মানুষের মৃত্যুও ঘটছে।
এ ধরনের ওষুধের তালিকা অনেক দীর্ঘ। প্রস্তুতকারী কোম্পানীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। ওষুধগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যান্সার, কিডনি ও ডায়াবেটিসসহ মারাত্মক কিছু রোগের জন্য ব্যবহৃত দুষ্প্রাপ্য ও খুবই দামী বিভিন্ন ওষুধ। তাছাড়া পেনিসিলিন, নন-পেনিসিলিন ও সেফালোস্পেরিনসহ অ্যান্টিবায়োটিক ধরনের কিছু বিশেষ ওষুধও রয়েছে, যেগুলো কঠিন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। রিপোর্টে আরো জানানো হয়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এমন অন্তত ২৯টি প্রস্তুতকারী কোম্পানীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল, যে কোম্পানীগুলো ভেজাল ও স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক বিভিন্ন ওষুধ তৈরি করে বলে কমিটি প্রমাণ পেয়েছে।
কিন্তু তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কোম্পানীগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকার এমনকি নাম ধরে ধরে কমিটির উল্লেখ করা বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুত করা থেকে নিবৃত্ত থাকার জন্যও কোম্পানীগুলোকে নির্দেশ দেয়নি। এর ফলে একদিকে ওইসব কোম্পানি বহাল তবিয়তে তাদের ওষুধ প্রস্তুত করার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের এই প্রশ্নসাপেক্ষ নমনীয় নীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার নামান্তর মনে করে নতুন নতুন আরো কিছু কোম্পানীও ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধ প্রস্তুত করার অঘোষিত প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। জানা গেছে, সব মিলিয়ে অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি কোম্পানি বর্তমানে ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধ প্রস্তুত করার কার্যক্রম চালাচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। বছর খানেক আগেও যেখানে দেড় থেকে দু’হাজার টাকায় ডায়াবেটিসের ইনসুলিন পাওয়া যেতো সেখানে একই ইনসুলিনের জন্য বর্তমানে আড়াই হাজার থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে। কম-বেশি একই রকম হারে বেড়েছে অন্য সব জরুরি ওষুধের দামও।
প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর অবশ্য যুক্তির অভাব নেই। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি এবং আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার মতো বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরছে প্রতিটি কোম্পানি। ইনসুলিনসহ যেসব ওষুধ আমদানি করতে হয় সেগুলোর ব্যাপারেও ‘অকাট্য’ বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে। অন্যদিকে তথ্যাভিজ্ঞরা বলেছেন, নানা বাহারী রঙের দামী মোড়ক ও বোতলসহ এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলোর পেছনে সহজেই অর্থের ব্যয় অনেক পরিমাণে কমানো সম্ভব এবং কমানো উচিতও। তাছাড়া কাঁচামাল ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ধরনের যুক্তিগুলোকেও গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। কারণ, তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কোম্পানিগুলোর বহুদিন ধরেই নানা অজুহাতে ওষুধের দাম বাড়িয়ে চলেছে। কাঁচামাল বা ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাদের এই দাম বাড়ানোর কোনো সম্পর্ক নেই। ইচ্ছা হলেই তারা দাম বাড়িয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়েও ব্যতিক্রম হয়নি।
ওদিকে ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধ প্রস্তুত করার মধ্য দিয়েও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক অপরাধ করে চলেছে কোম্পানিগুলো। এ বাপারে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ব্যবসায়ী নামের একটি বিশেষ গোষ্ঠী। গণমাধ্যমের রিপোর্টে নাম ধরে ধরে তাদের সম্পর্কে জানানও হয়েছে। কিন্তু কোনো ওষুধ বা কোম্পানির ব্যাপারেই সরকারি কোনো বিভাগ বা দফতরের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখনো হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, বিষয়টি দেখার ও প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব যেসব সরকারি সংস্থার সেসবের কর্তাব্যক্তিদের ঘুষের বিনিময়ে থামিয়ে রাখা এবং ‘ম্যানেজ’ করা হচ্ছে। সামান্য কিছু নগদ অর্থের লোভে কর্তাব্যক্তিরা নানা রোগে বিপন্ন হয়ে পড়া জনগণকে নিশ্চিত বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। এভাবে দেশের বাজারে ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধের অবাধ বিক্রির কারণে সব মিলিয়েই এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এসবই সম্ভব হচ্ছে সরকারের গাফিলতির কারণে। কারণ, বিএসটিআইসহ এমন অনেক সংস্থা ও বিভাগ রয়েছে যারা সঠিকভাবে যার যার দায়িত্ব পালন করলে কথায় কথায় দাম বাড়ানো এবং এত বেশি ধরনের ওষুধে ভেজাল মেশানো ও সেগুলোকে খোলা বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। অন্যদিকে বাস্তবে সেটাই হচ্ছে এবং হচ্ছেও বিপুল পরিমাণে। এর ফলে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। দীর্ঘ মেয়াদে তারাই বরং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে পুরো জাতিকেই ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। টাকার লোভে এদেশেরই এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী নামধারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জাতি ধ্বংসের এই ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে অংশ নিচ্ছে। আমরা মনে করি, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি এবং ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধের ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সদিচ্ছা থাকলে কোন ধরনের ওষুধে ভেজাল মেশানো হচ্ছে সে বিষয়ে জানার জন্য এ বিষয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টকে ভিত্তি করা যায়। তাছাড়া আরো অনেক সংস্থাই মাঝেমধ্যে ওষুধ ও খাদ্যপণ্য সম্পর্কে জরিপ ও গবেষণা করে থাকে। সরকার চাইলে তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতেও অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করতে পারে। সেটাই করা উচিত। পাশাপাশি দরকার সেই সব কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া, ঘুষের বিনিময়ে যারা জাতি ধ্বংসের কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছে।
আমরা মনে করি, ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধ যারা প্রস্তুত ও বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তো নিতে হবেই, সরকারকে একই সঙ্গে জনগণকে সচেতন করার জন্যও তৎপর হতে হবে, যাতে কোনো ওষুধ কেনার আগে তারা সহজে সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। সব মিলিয়ে আমরা চাই, জীবন রক্ষাকারীসহ সকল ওষুধের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে আনা হোক এবং ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধ বিক্রি বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া হোক, যাতে কোনো গোষ্ঠীর পক্ষেই জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা সম্ভব না হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ