কঠিন পরীক্ষায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট
নাজমুল ইসলাম জুয়েল : বিশ্ব ক্রিকেটে ক্ষয়িঞ্চু দল হিসেবেই এখন বেশি বিবেচিত হয়ে থাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাম। পূর্বের সেই প্রভাব এখন আর দেখাই যায়না। যদিও দু’টি বিশ্বকাপ জয়ের পর ছোট ফরম্যাটের টোয়েন্টি-২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল ক্যারিবীয়রা। এরপরই যেন পথহারা হয়ে গেছে তারা। নিজে নামতে নামতে বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলতে হচ্ছে ক্লাইভ লয়েড, ভিভিয়ান রিচার্ডস, গর্ডন গ্রীনিজদের দেশটিকে। অথচ বিশ্বকাপের প্রথম দু’টি আসরে মানে ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে পরপর দু’বার বিশ্বকাপ জিতেছিল তারা। এর পরে আর কখনো ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ জয় তো দূরের কথা, ফাইনালেও পৌঁছাতে পারেনি ক্যারিবিয়ানরা। আর এবার তো র্যাংকিংয়ের সেরা আট থেকে ছিটকে গিয়ে খেলতে হচ্ছে বাছাইপর্ব। দুর্বল পারফর্মেন্সের কারণে ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের শীর্ষ আটে জায়গা করতে না পাওয়ায় এমন করুণ দশায় পড়তে হয়েছে ক্রিস গেইল, মারলন স্যামুয়েলদের। টোয়েন্টি-২০ ফ্র্যাঞ্চাইজির লোভনীয় অর্থ আয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ায় দেশটি হারিয়েছে বেশ ক’জন গুরুত্বপূর্ণ তারকা ক্রিকেটারকে। তবে ‘ইউনিভার্স বস’ খেতাবধারী গেইল তার ক্যারিয়ারে ২২তম ওডিআই সেঞ্চুরি যুক্ত করার লক্ষ্যে দলকে এগিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জিম্বাবুয়ের এই বাছাইপর্বে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তিনি পাকিস্তান সুপার লিগে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছেন। যে কারণে সবার দৃষ্টি এখন গেইলের দিকে। দেখতে চায় ৩৮ বছর বয়সী এই ক্যারিবীয় তারকা পঞ্চমবারের মত বিশ্ব মঞ্চে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন কি-না। গ্রুপ ‘এ’ তে জেসন হোল্ডারের দলের প্রতিপক্ষরা হল নেদারল্যান্ডস, পাপুয়া নিউ গিনি, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও টেস্ট ক্রিকেটের নতুন সদস্য আয়ারল্যান্ড। জিম্বাবুয়ের মাটিতে গত ৪ মার্চ শুরু হয়েছে ২০১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বাছাইপর্ব। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে অনুষ্ঠিতব্য টুর্নামেন্টের দু’টি জায়গা পেতে এই রাউন্ডে অংশ নিচ্ছে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্টইন্ডিজসহ ১০টি দেশ। তবে ফেভারিটের তকমা লেগে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানের গায়ে। অবশ্য সদ্য টেস্ট মর্যাদা পাওয়া আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবুয়েও ঘটিয়ে ফেলতে পারে অঘটন। ৪-২৫ মার্চ পর্যন্ত এই বাছাইপর্বের খেলা নিয়ে এখন কৌতুহলের শেষ নেই।
বাছাইপর্ব না পেরিয়েই বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন
বাছাইপর্বের বাধা পেরুনোর আগেই বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টোয়েন্টি-২০’তে ক্রিকেট বিশ্বের পরাশক্তি সর্বাধিক দু’বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। বিপরীত চিত্র রঙিন পোশাকের ওয়ানডে ফরমেটে! ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ ব্যাক-টু-ব্যাক ওয়ার্ল্ডকাপ জয়ের পর ক্যারিবীয়দের হাতে আর ধরা দেয়নি পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। সেই আক্ষেপ ঘোচানোর স্বপ্ন দেখছেন বর্তমান অধিনায়ক জেসন হোল্ডার। হোল্ডারের বিশ্বাস, অনূর্ধ্ব-১৯ ও নারী টিমের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরেকটি বিশ্বকাপ জেতার এটাই সময়। উইন্ডিজ টিমের ২০১৬ টোয়েন্টি-২০ ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ২০১৬ ক্রিকেট ওয়ার্ল্ডকাপ জয়ের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটে ভালো করছি, আমরা নারী ক্রিকেট এবং অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট পর্যায়েও ভালো করছি। আমি মনে করি, আমাদের আরেকটি ওয়ার্ল্ডকাপ জয়ের এটাই উপযুক্ত সময়। বাস্তবতা বলছে, ক্যারিবীয়দের ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের পক্ষে বাজি ধরার লোক খুবই কম পাওয়া যাবে। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের র্যাংকিংয়ে শীর্ষ আট দলের বাইরে থেকে সরাসরি ২০১৯ বিশ্বকাপের মূল পর্বে উঠতে ব্যর্থ হয় তারা। বাছাইপর্বের বাধা পেরিয়েই উত্তীর্ণ হতে হবে। র্যাংকিং দুর্দশায় গত বছর আট দলের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও জায়গা মেলেনি এক সময়ের পরাক্রমশালীদের। ক্যারিবীয় ক্রিকেটে তা এক লজ্জার অধ্যায় হয়েই থাকবে। হোল্ডার জোর দিয়েই বলছেন, পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে তাদের ঘুরে দাঁড়ানো বড্ড প্রয়োজন। বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব শুধুমাত্র উইনিং কম্বিনেশন খুঁজে পেতে সাহায্য করবে না, আগামী বছর ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে একটা মোমেন্টাম নিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি। এখন একটি বড় সাফল্য খুববেশি প্রয়োজন দেশটির।
ক্রিস গেইলের চ্যালেঞ্জ
ক্রিস গেইল এখনো বিশ্ব ক্রিকেটের দানবীয় ব্যাটসম্যানদের একজন। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলবেন এই বাহাতি, এটাই যেন বড় খবর দেশটির জন্য। কারণ যেখানে কিরেয়ন পোলার্ড, সুনীল নারিন, আন্দ্রে রাসেল খেলবেন না বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে, সেখানে গেইলই ব্যতিক্রম। দেশের প্রতিনিধিত্ব করার চেয়ে তাঁদের কাছে পিএসএলই বড়। উল্টো অবস্থা গেইলের। এই দানব ক্রিকেটারে মানেই তো টোয়েন্টি-২০’র ‘ফেরিওয়ালা’। বিশ্বের এমন কোনো নামকরা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ নেই যেখানে তাঁর ডাক পড়েনি। প্রতিটি আসরই নিজের মতো করে মাতিয়েছেন এই তারকা। তাঁকে অনুসরণ করে কাইরন পোলার্ড কিংবা সুনীল নারাইনরাও এখন টোয়েন্টি-২০’র বড় তারকা। পিএসএলেও পোলার্ড, নারাইনরা থাকলেও গেইল প্রাধান্য দিচ্ছেন দেশের প্রয়োজনকেই। ২০১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বাছাইপর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোয়াডে আছেন গেইল। ৫০ ওভারের ক্রিকেটের প্রথম দুটি বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নরা এবার সরাসরি খেলার সুযোগ পাচ্ছে না। এটা একটা বড় বিপর্যয়ই। সেখান থেকে দলকে টেনে তুলতে দরকার পরীক্ষিত ক্রিকেটারদের। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে কী এমন ক্রিকেটারদের অভাব পড়েছে? মোটেই না, বরং পোলার্ড, নারাইন, রাসেল, ব্রাভোরা একসঙ্গে মাঠে নামা যেকোনো দলের জন্যই সমীহ তৈরিতে যথেষ্ট। কিন্তু বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সব তারকা ক্রিকেটারকে একসঙ্গে পাচ্ছে কোথায়? আছেন তো শুধু মারলন স্যামুয়েলস আর গেইল। বাকিদের কাছে তো দেশের চেয়ে পিএসএল বড়! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে বাছাইপর্ব থেকে উত্তরণের কোনো মাথাব্যথাই নেই পোলার্ড, নারাইন, ড্যারেন ব্রাভো ও আন্দ্রে রাসেলদের। একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের জন্য তাঁরা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দেশের হয়ে খেলবেন না! কিন্তু গেইল থাকছেন। সে কারণে তার জন্য এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জই বলা যায়।
লড়াইয়ে আফগানিস্তানও
টেস্ট স্ট্যাটাস পেলেও এখন বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে খেলতে হচ্ছে আফগানিস্তানকে। সে কারণে লড়াইটা তাদেরও করতে হবে। আর টিন এইজ লেগ স্পিনার রশিদ খানের নেতৃত্বে বিগত ১২ মাসে অভূতপুর্ব সফলতা অর্জন করেছে যুদ্ধবিধ্বনস্ত দেশটি। নিয়মিত অধিনায়ক আসগর স্তানিকজাই ইনজুরিতে পড়ায় ১৯ বছর বয়সী এই উদীয়মান তারকা কাঁধে তুলে নিয়েছেন জিম্বাবুয়ে মিশনের শুরুতে আফগান দলের নেতৃত্ব। তিনি পৌঁছে গেছেন ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্রুততম একশ’ উইকেট সংগ্রহের রেকর্ড বইয়ে নাম লেখানোর দ্বার প্রান্তে। সদ্য সমাপ্ত ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগের (আইপিএল) নিলামে এই স্পিনার বিক্রি হয়েছেন ১০ লাখ ৪১ হাজার মার্কিন ডলারে। ৩৭ ওডিআই ম্যাচ থেকে এরই মধ্যে ৮৬ উইকেট শিকার করে নেয়া এই বোলারকে কিনে নিয়েছে সানরাইজার্স হায়দারাবাদ। তার উত্থানের সামনে হুমকির মুখে পড়ে গেছে দ্রুততম উইকেটের সেঞ্চুরি পূরণ করা মিচেল স্টার্কের রেকর্ড। ৫২ ম্যাচ খেলে ১০০ উইকেট সংগ্রহ করে ওই রেকর্ডটি দখলে নিয়েছেন তিনি। যা যে কোন সময় ভেঙে যেতে পারে এই লেগ ব্রেকের গুগলিতে। তবে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে না পারলে এসব রেকর্ডের যে কোন মূল্যই থাকবে না।
ভাল নয় জিম্বাবুয়ের অবস্থা
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের স্বাগতিবক হয়েছে এবার জিম্বাবুয়ে, তবে তাদের অবস্থাও ভাল নয়। স্বাগতিক ১৯৮৩ সাল থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপের আসরে নিয়মিত অংশ নেয়া জিম্বাবুয়ে বিগত ১৫ বছর ধরেই নিম্নমুখী অবস্থানে রয়েছে। বাছাইপর্বের আয়োজক এই দেশটি সর্বশেষ তিন বিশ্বকাপের আসরে অংশ নিয়ে মাত্র তিনটি ম্যাচে জয়ের স্বাদ পেয়েছে। বাছাই পর্বে প্রতিপক্ষ দলগুলো হচ্ছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্কটল্যান্ড, নেপাল ও হংকং। সর্বশেষ গতমাসে আফগানিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে অংশ নিয়ে পরাজিত হয়েছে ৪-১ ম্যাচের বিশাল ব্যবধানে। এবার গ্রুপ পর্বেই দলটিকে আফগান বাধার মুখে পড়তে হবে। সম্প্রতি ব্রেন্ডন টেইলর, কাইল জার্ভিস ও শন উইলিয়ামস দলে ফেরায় জিম্বাবুয়ের সামর্থ্য বেড়েছে। তবে বাছাইপর্বে নীচের র্যাংকিংয়ের দলগুলোর কাছে হেরে গেলে তাদের চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে।
আক্রমণের নেশায় নেপালীরা
ক্রিকেটে এখন উঠতি শক্তিদের একটি নেপাল। দ্বিতীয় বিভাগের বিশ্ব ক্রিকেটের শিরোপা জয় করে আসার পর নেপাল বাছাই পর্বে আঁচড় বসাতে পারে যে কোন দলকেই। শেষ বলে কানাডার বিপক্ষে এক উইকেটের রোমাঞ্চকর এক জয় নিয়ে তারা জিম্বাবুয়ের এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের সুযোগ আদায় করেছে। এর আগে নামিবিয়ার বিপক্ষেও অসাধারণ এক জয় পায় হিমালয় কন্যার ক্রিকেটাররা। ১৭ বছর বয়সি লেগ স্পিনার সন্দীপ লামিচানের নেতৃত্বে বাছাইপর্বে অংশ নেয়া নেপালকে টুর্নামেন্টে হাস্যকর বলে মনে হলেও যে কোন একটি জয় ক্রিকেট পাগল জাতিকে করে দিতে পারে আত্মহারা।
নতুন করে ওয়ানডে স্ট্যাটাসের যুদ্ধ
শুধু বিশ্বকাপে খেলার টিকিটই নয়, নতুন করে ওয়ানডে স্ট্যাটাসের জন্যও লড়তে হবে দেশগুলোকে। টুর্নামেন্ট থেকে শক্তিশালী দলগুলো বিশ্ব মঞ্চে পৌঁছালেও সেখানে রয়েছে সুপার সিক্স রাউন্ড। যেখান থেকে তিনটি দলের সুযোগ থাকবে ওয়ানডে মর্যাদা পাওয়ার। ইতোমধ্যে আইসিসি’র পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়া আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ২০২২ সাল পর্যন্ত ওডিআই মর্যাদা পাওয়া ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ চ্যাম্পিয়ন নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে যুক্ত হবে ওই তিন এসোসিয়েট দল। ফলে আগামী দুই সপ্তাহের উদ্বোধনী লড়াইয়ে নেপাল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, স্কটল্যান্ড এবং পাপুয়া নিউ গিনি সুযোগ পাবে নিজেদের মর্যাদার আসনে বসানোর।