ছাত্রশিবিরের শহীদ দিবস আজ
স্টাফ রিপোর্টার : আজ রোববার ১১ মার্চ ইসলামী ছাত্রশিবিরের শহীদ দিবস। ১৯৮২ সালের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বর শহীদ সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জাব্বারের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ছাত্রশিবিরের যাত্রা শুরুর পর এই দিনে বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ হলেন শহীদ সাব্বির আহমদ, শহীদ আবদুল হামিদ, আইয়ুব আলী, আবদুল জাব্বারের পথ ধরে ২২৬ শহীদের নজরানা পেশ করেছে এই সংগঠন। শহীদ দিবস উপলক্ষে ইসলামী ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে দেশব্যাপী কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
কী ঘটেছিল এই দিনে? ১৯৮২ সালে ১০ মার্চ, ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতরণ করেন লিফলেট। ১১ মার্চ নবীনবরণ। এদিন সকাল ৮টা থেকেই প্রশাসনিক ভবনের পশ্চিম চত্বরে শিবিরের নবীনবরণের ডাকে সাড়া দেয় হাজার তরুণ-যুবকের দল। ছাত্র-জনতার ঢল নামে নীল প্যান্ডেলের সম্মুখপানে। ৯টায় কুরআন তেলাওয়াতের প্রাণকাড়া সুমধুর বাণী দিয়ে নবীনবরণ শুরু হতে যাচ্ছিল।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে আগের দিনের ঘটনা ও শিবিরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকডজন পুলিশসহ ম্যাজিস্ট্রেট অপেক্ষা করছে। হঠাৎ সাড়ে ৯টার দিকে গাড়িতে শত শত ছাত্রমৈত্রী, জাসদ, ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের আগমন ঘটে রাবি ক্যাম্পাসে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা মিলিত হয় রাবি শহীদ মিনার পাদদেশে। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্রলীগ যৌথভাবে নিরস্ত্র শিবিরের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালায়।
নবীনবরণ হয়ে যায় পণ্ড। শত শত অস্ত্রবাজ, নেশাখোরদের হকিস্টিক, রামদা, কিরিচ চাইনিজ কুড়ালের আক্রমণে শিবির নেতা-কর্মীরা ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হয়ে যায়। মজলুমের ওপর জালিমের অব্যাহত হামলায় শিবির নেতা-কর্মীরা আর্তনাদ করতে থাকে। বীভৎস দৃশ্য, করুণ-বেদানবিধুর প্রতিচ্ছবি, তবুও তৎকালীন ভিসি ও প্রক্টর রক্তমাখা আহত নিরস্ত্র অসহায় শিবিরের মর্মস্পর্শী করুণ দৃশ্যাবলী নির্লিপ্তভাবে অবলোকন করেন। শত জনতার বিবেক ফেটে চৌচির হলেও তাদের বিবেকে পড়েনি কোন বেদনার রেখাপাত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। সেদিন পুলিশ ভিসির অনুমতির অপেক্ষায় ছিল। শিক্ষক-ছাত্র কারও অনুরোধেও পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে দেননি তিনি। ফলে রক্তে লালে লাল হয় মতিহারের সবুজ চত্বর।
নিরুপায়, অসহায়, নিরস্ত্র শিবির নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাস থেকে মেইনগেট দিয়ে বের হয়ে চলে আসতে চেষ্টা কারে। আক্রমণে ৭০/৮০ জন মারাত্মক আহত, ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকে। মুখে শুধু আল্লাহ বাঁচাও শব্দ ছাড়া কোন আওয়াজ ছিল না।
শহীদ সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার শহরের দায়িত্বশীল হলেও নবীনবরণ অনুষ্ঠান বাস্তবায়নে তারা ছিলেন সদা তৎপর। বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা তাই শহর থেকেই শিবির নির্মূল করার জঘন্য নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। পূর্বপরিকল্পিতভাবেই হামলা পরিচালনা করা হয়। তাই আবারো তাদের চতুর্মুখী হামলায় ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে শিবির কর্মীরা।
আল্লাহর রাহে শিবিরের প্রথম নজরানা : এমনি মুহূর্তে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহীদ জোহার মাজারের সামনে শিবির নেতা, উপশহরের কৃতী সন্তান সাব্বিরের ওপর নারকীয় হামলা চালানো হয়। রড-কিরিচ-রামদার শত শত আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত আহত অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। জোহরে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের সাথেই যেন করুণ সুরে ভেসে এলো সাব্বির আর নেই! জোহরের নামায পড়তেও পারলেন না শিবিরের সর্বপ্রথম শহীদ হিসেবে চলে গেলেন মহান প্রভুর কাছে।
এ সময় আরো শত শত নেতাকর্মীকে আহত আর রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ সময় শত জনতার সম্মুখে বিএনসিসির সামনে শিবিরে নেতা আব্দুল হামিদের মাথার নিচে ইট রেখে অনেক ইট আর রড দ্বারা আঘাত করলে মগজ ছিটকে বের হয়ে যায়। রাজশাহী কলেজ থেকে আরবি অনার্স পরীক্ষা দেয়া আর হলো না হামিদের। চলে গেলেন তিনিও।
শহীদ আবদুল হামিদের রক্তমাখা বেদনার প্রতিচ্ছবি প্রতিক্ষণ প্রাণে দোলা দেয়। মনে পড়লেই হৃদয়ে জাগে শিহরণ! কিন্তু পাষাণ নিষ্ঠুরদের হাতও কাঁপেনি। শহীদ সাব্বিরের শোকে মুহ্যমান আবাল বৃদ্ধবনিতা এক শহীদের বেদনায় শোকাহত জনতার প্রাণে মাত্র ৮/১০ ঘণ্টার মধ্যেই শহীদ আবদুল হামিদের শাহাদাতের খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো।
১১ মার্চের বেদনার আঁধার ভেদ করে ১২ মার্চের রক্তিম সূর্য উদিত হলো। মাত্র ৩৫ ঘণ্টার ব্যবধানে আহত চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ মার্চ প্রভুর দরবারে পাড়ি দিলেন শহীদ আইয়ূব। উদ্ভিদ পরীক্ষায় অনার্স না হলেও শাহাদাতের মর্যাদায় হলেন উদ্ভাসিত। শহীদ সাব্বির, হামিদ যেমন শহর শাখার জোন সভাপতি ছিলেন তেমনি শহীদ আইয়ুবও ছিলেন শহর শাখার অফিস সম্পাদক। তার হাসিমাখা চাহনি, অপূর্ব ওয়াল রাইটিং আর মায়াবি চেহারা বেদনার প্রতিচ্ছবি আজও ডাকে বারে বার। প্রতিদিন সূর্য ফিরে আসে শুধু ওরা আসে না ফিরে ...? দীর্ঘদিন আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকলেন রসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবদুল জাব্বার। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি যান। গান গেয়ে সান্ত¡না খুঁজতেন এভাবে ‘আমাকে শহীদ করে সেই মিছিলে শামিল করে নিও’, ‘আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়’। তার প্রাণের আকুতি ৯ মাস পর ২৮ ডিসেম্বর প্রভুর দরবারে কবুল হলো। তিনিও শাহাদাতের পিয়ালা পান করলেন। শহীদ সাব্বির, হামিদ, আইয়ুবের মত শহীদ জাব্বারের শাহাদাতেও পারলো না কেউ অশ্রু নিবারণ করতে। শহীদ আর অগণিত আহত, ক্ষত-বিক্ষত রক্তমাখা প্রতিচ্ছবি সত্যিই বেদনাবিধুর করে দেয় সবার হৃদয়ে।
আজো কাঁদায় : ৮২ সালের ১১ মার্চের নারকীয় ঘটনায় জুলুম নির্যাতন আর আহতদের হৃদয় বিদারক করুণ দৃশ্যের অবতারণায় সেদিন শোকের ছায়া নেমে আসে। সবার বিবেক স্তব্ধ হয়ে যায়। পত্রিকা, রেডিও-টিভি প্রচার মিডিয়াসহ সর্বমহলে এই নৃশংস ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় ধারাবাহিকভাবে! ফলে শিবিরের প্রতি বিবেকবানদের মানবিক সহানুভূতি আলৌকিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। উক্ত ঘটনায় মারাত্মক আহত ছাত্রনেতা মামুনের সাতদিন পরও জ্ঞান ফেরেনি। উন্নত চিকিৎসা আর অমানবিক ঘটনার জন্য তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারও ছুটে যান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনিও তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। আর অজ্ঞান মামুনের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা সামরিক হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দেন। রাষ্ট্রপতির মহতি উদ্যোগ এবং শিবিরের নেতা-কর্মীদের ত্যাগ কুরবানি সর্বোপরি শাহাদাতের ঘটনা শিবিরের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। তাই উক্ত মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণে ইসলামী ছাত্রশিবির এই ১১ মার্চকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ যেই আলো নিভিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল তা আজ লাখো তরুণের পথের দিশা। শত জুলুম, নির্যাতন উত্তাল তরঙ্গমালার এক সাগর রক্ত পেরিয়ে আল্লাহর দ্বীনের পথিক বান্দারা আজ মিলিত হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরে। লাখো নাবিক আর পথহারা যুবকের দল ভিড় জমাচ্ছে এই কাফেলার বিপ্লবী মিছিলে। শত শত বেদনার প্রতিচ্ছবি ইসলামী আন্দোলনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে।