শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

পানি সংকট মোকাবেলায় প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার : আজ ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস। ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পানির জন্য প্রকৃতি’। এবছর দিবসটির লক্ষ্য একবিংশ শতাব্দিতে পানি সংকট মোকাবেলায় প্রকৃতির সমন্বয়ে কিভাবে পানি ব্যবহারের উপযোগিতা বৃদ্ধি করা যায় তা খুঁজে বের করা এবং প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে বিশ্বজুড়ে পানি সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী মানুষের পরিবেশ বিরূপ কর্মকান্ডের ফলে বনভূমি, কৃষিভূমি, নদ-নদী ও জলাভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে বন্যা, খরা, পানির স্বল্পতা এবং পানি দূষণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। আমরা যখন আমাদের ইকোসিস্টেমকে উপেক্ষা করবো, তখন সবাইকে বাঁচাতে এবং তাদের জীবনমান সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়বে। সুতরাং প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমেই পানি সংকটজনিত অধিকাংশ সমস্যা দূর করা সম্ভব।
পবা’র উদ্যোগে গতকাল বুধবার, সকাল ১১টায়, পবা কার্যালয়ে বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে “পানি সংকট মোকাবেলায় প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের গুরুত্ব”-শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত পরিবেশবাদীরা অভিমত ব্যক্ত করেন। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান-এর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার, পবা’র সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, নাসফের সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী, বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলন-এর সভাপতি প্রকৌ. মো. আনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ,পবা’র সদস্য মোস্তারী বেগম, কানিজ ফাতেমা, আবুল হাসানাত চুন্নু, সেতু সংঘ-এর প্রতিষ্ঠাতা মো. ইলিয়াস হায়দার, ডাব্লিউবিবি-ট্রাস্ট-এর প্রকল্প কর্মকর্তা শুভ কর্মকার, নাসফ-এর সহ-সাধারণ সম্পাদক অলিভা পারভীন, বিসিএইচআরডি-এর পরিচালক মো. মমতাজুর রহমান মোহন, সৈয়দা দিলরুবা আক্তার, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান-এর ছাত্র নাসির আহমেদ পাটোয়ারি প্রমুখ।
প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান মূল প্রবন্ধে বলেন, বর্তমান বন্যার ঝ্্ুঁকিতে রয়েছে ১.২ বিলিয়ন মানুষ, যা ২০৫০ সালে ১.৬ বিলিয়নে দাড়াবে যা বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। ১.৮ বিলিয়ন মানুষ ভূমি ক্ষয় ও মরুকরণ প্রক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত এবং কমপক্ষে ৬৫ শতাংশ বনভূমি ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে রয়েছে। মানুয়ের কর্মকান্ডের ফলে ১৯০০ সাল থেকে ৬৪-৭১ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গিয়েছে। কৃষি ভূমির মাটি ক্ষয়ের ফলে প্রতি বছর ২৫-৪০ বিলিয়ন টন টপসয়েল হারিয়ে যাচ্ছে, যাতে ফলন কমে যাচ্ছে এবং টপসয়েলে প্রচুর পরিমাণে নাট্রোজেন ও ফসফরাস থাকায় তা পানি দূষণে ভূমিকা রাখছে। অবিলম্বে এ দূষণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬ অনুযায়ী সারা বিশ্বে ২০৩০ সাল নাগাদ পানি ও স্যানিটেশনের প্রাপ্যতা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব। টেকসই উন্নয়নের অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রেও প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
জাতিসংঘের দেয়া এক তথ্যানুযায়ী তিনি বলেন, বিশ্বে বর্তমানে ২.১ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ সুপেয় পানি সেবা থেকে বঞ্চিত। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব জনসংখ্যা ২ বিলিয়ন বৃদ্ধি পাবে এবং বিশ্বব্যাপী পানির চাহিদা ৩০শতাংশ বেড়ে যাবে। বর্তমানে বিশ্বে কৃষি খাতে ৭০শতাংশ যার  বেশির ভাগই সেচ কাজে, শিল্প খাতে ২০শতাংশ বিশেষ করে জ্বালানি ও উৎপাদনে, গৃহস্থালি কাজে ১০শতাংশ যার এক শতাংশেরও কম সুপেয় পানি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অন্যান্য বক্তারা বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তন, ইত্যাদির বিরুপ প্রভাব বাংলাদেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এ কারণে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার আমুল পরিবর্তন ঘটছে। গড় তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়েছে যে কোন মৌসুমের ক্ষেত্রে, বৃষ্টিপাতের ধরন ও সময় বদলে গেছে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে ৩০০ টির বেশী নদী রয়েছে। যার মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের এবং ৩টি মিয়ানমারের সাথে সংশি¬ষ্ট। পদ্মা, মেঘনা, যুমনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী। এদের অসংখ্য উপনদী ও শাখানদী রয়েছে। যুগ যুগ ধরে এদেশের কোটি  কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা আবর্তিত হচ্ছে নদীকে কেন্দ্র করে। দেশে প্রায় ২৪,০০০ কিলোমিটার নদী, প্রবাহ এবং খাল আছে যা যৌথভাবে দেশের পৃষ্ঠের প্রায় ৭%। বছরে ১.২- ২.৪ বিলিয়ন টন পলি নদীবাহিত হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। পলি পড়ে নদীগুলো ক্রমন্বয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও নদীগুলো দখল, ভরাট ও দূষণের শিকার। ফলে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে, নৌ চলাচল বিঘিœত হচ্ছে এবং নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী পড়ছে। ভাটির দেশ হিসাবে অভিন্ন  নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় আমাদের দেশে পানি সংকট আরো ঘনিভূত হচ্ছে এবং নৌ চলাচল, সেচ ব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্য হুমকীর মুখে পড়ছে। নদীতে পানি কমে যাওয়া বা না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাওয়া এবং নদী হারিয়ে যাওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রকৃতি নির্ভর ধান চাষের পরিবর্তে খরা মৌসুমে সেচ  ও রাসায়নিক সার  নির্ভর ধান চাষের ফলে ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি সংকট তীব্রতর হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ এধরনের শহর পৃথিবীতে বিরল। এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকায় জলাশয় ও নি¤œাঞ্চল-এর পরিমাণ ছিল ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ২৯৫২ ও ১৩৫২৮ হেক্টর, ১৯৮৮ সালে  যথাক্রমে ২১০৪ ও ১২৭১৮ হেক্টর এবং ২০০৮ সালে  যথাক্রমে ১৯৯১ ও ৬৪১৫ হেক্টর। ১৯৬০ সাল হতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল যথাক্রমে ৩২.৫০% ও ৫২.৫০% হ্রাস পেয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৭০% নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে পাল্লা দিয়ে চলছে ভরাট কার্যক্রম। ভরাটের এ গতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শতভাগ নিম্নাঞ্চল হারিয়ে যাবে। ঢাকার নিম্নাঞ্চল এবং চারদিকে নদীগুলো ছাড়া যে জলাভূমি রয়েছে তা হচ্ছে লেক। লেক পরিবেশগত সুফল প্রদান করে, জীবনের গুণগত মান উন্নয়নে প্রভাব ফেলে এবং বিশাল পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করে, খরা ও বন্যার প্রভাব থেকে রক্ষা করে।
পবা ২০১৬ এলাকাভেদে তাপমাত্রার তারতম্য নিরুপণের লক্ষ্যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা জরিপ করে। জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায় যে, ধানমন্ডি লেক এলাকার চেয়ে ঢাকার যে কোন এলাকার তাপমাত্রা ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি বেশি। এর প্রধান কারণ হলো ধানমন্ডিতে একটি লেক রয়েছে এবং লেককে ঘিরে সবুজ বেষ্টনী গড়ে উঠেছে। গাছপালা একদিকে তাপ শুষে নেয় অন্যদিকে শীতল অক্সিজেন সরবরাহ করে। জলাভূমিও তাপ শোষণ করে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা গাছপালা ও জলাভূমি দুটোই ধ্বংস করছি এবং রাজধানী ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ