নারী শিক্ষা জাগরণের আন্দোলনে বেগম রোকেয়ার পূর্বসুরিরা
মো: জোবায়ের আলী জুয়েল : এ উপমহাদেশের নারী শিক্ষার ইতিহাস যেমন করুণ, তেমনি প্রচ্ছন্ন ও নৈরাশ্যজনক। শিক্ষা সভ্যতার বাহন ও উন্নয়নের চাবিকাঠি, কিন্তু এ সত্য পরাধীন দেশে স্বীকৃত হয়নি বলে এ দেশে শিক্ষার বিস্তার ঘটে বহু দেরিতে। অতীত ইতিহাসে শুধু যে মুসলিম মেয়েরাই অজ্ঞ অশিক্ষিত ছিল তা নয়, হিন্দু মেয়েরাও অজ্ঞ ও শিক্ষা বঞ্চিত ছিল।
এদেশে সাড়ে পাঁচ শতাব্দী ধরে মুসলিম শাসন ব্যবস্থা ছিল। তখন গুটিকয়েক বিদুষী সম্রাজ্ঞী নিজ উদ্যোগে জ্ঞানার্জন করলেও সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষা বিস্তার ঘটেনি। আঠারো শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও বৃটিশ শাসনের শুরুর অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ পার হওয়ার পর গুটিকয়েক সমাজদর্শী দেশ-নেতা ও সংস্কারের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও পাশ্চাত্য ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে নারী শিক্ষার উদ্যোগ নেন। উনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম একটি বিষয় ছিল নারী শিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা। এদেশে নারী শিক্ষা প্রবর্তনের প্রথম চেষ্টা করে খ্রিষ্টান মিশনারিরা। তাঁরা ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে “ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি” নামে একটি সমিতি স্থাপন করে নারীদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। এই সমিতির উদ্যোগে বাঙালি মেয়েদের জন্য গৌরবাড়িতে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দের মে-জুন মাসে। পরে এ সমিতি জানবাজার, চিৎপুর, শ্যামবাজার, বরাহনগর প্রভৃতি অঞ্চলে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। অন্যটি “Ladies Society for native Female Education in Calcutta and its Vicnity” এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে (তথ্যসূত্র: অমলেন্দু দে, বাঙালি বুদ্ধিজীবি ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, পৃষ্ঠা ২৮)। ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫-১৮৪২ খ্রি.) এই প্রতিষ্ঠানের জন্য চাঁদা দিয়েছিলেন।
বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক নারী শিক্ষার সূচনা হয় ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মে। জেইডি বেথুনের (১৮০১-১৮৫১ খ্রি.) প্রচেষ্টায় ন্যাটিভ ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে (তথ্যসূত্র: শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, কলকাতা, নিউএজ পাবলিশার্স প্রা. লি.)। এই স্কুলটি পরে “বেথুন স্কুল” নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৫০ থেকে ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় এই স্কুলের সম্পাদক ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে এটিই সর্বপ্রথম প্রাতিষ্ঠানিক মেয়েদের স্কুল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জন ইলিয়ট ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন।
প্রাচীন যুগের কোনো মহিলা কবির পদ বা রচনা এখনো আবিস্কৃত হয়নি। মধ্যযুগে প্রথম মহিলা কবি হিসেবে চ-ীদাসের সাধন সঙ্গিনী রজকিনী রামী বা রামতারাকে দেখা যায় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। তাঁর পূর্বে কোনো লেখিকার ভণিতাযুক্ত কোনো পদের সন্ধান পাওয়া যায় না।
রামীর পরবর্তীতে ইন্দ্রমুখী, মাধুরী, গোপী, রসময়ী দেবী নাম্নী বৈষ্ণব নারী কবির ভণিতা যুক্তপদ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীর কবি মাধবী দাসী শ্রী চৈতন্যের সমসাময়িক ছিলেন। তাঁর অনেকগুলো পদ পদকল্পতরুতে পাওয়া যায়। ষোড়শ শতকের আরেক কবি হলেন চন্দ্রাবতী। তিনি বিখ্যাত মনসামঙ্গল রচয়িতা বংশী দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্যা। খনা একজন গুণবতী রমণী ছিলেন। তাঁর জ্যোতিষ-শাস্ত্র সংক্রান্ত বিজ্ঞ মন্তব্যগুলো বাংলার গৃহ প্রবাদে পরিণত হয়েছে। তিনি মুসলমান শাসনের প্রথম যুগে এই প্রদেশে বসবাস করতেন।
অষ্টাদশ শতকে প্রথম মুসলিম মহিলা কবি রহিমুন্নেসাকে দেখা যায়। তাঁর পূর্বে মুসলিম লেখিকার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। অষ্টাদশ শতকের শেষ ও উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আরো কিছু লেখিকার রচনা পাওয়া যায়। যেমন- আনন্দময়ী দেবী, গঙ্গামনি দেবী, যজ্ঞেশ্বরী দেবী, সুন্দরী দেবী, দ্রব্যময়ী দেবী, লক্ষ্মী দেবী প্রমূখ। কিন্তু এঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়না (তথ্যসূত্র: শ্রীমতি অনুরূপা দেবী, সাহিত্যে নারী, স্রষ্টী ও সৃষ্টি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৯ খ্রি. পৃষ্ঠা ১০২)।
বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম উপন্যাস “ফুলমনি ও করুনার বিবরণ”। তবে খুব আশ্চর্যের বিষয় বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস লিখেছেন একজন ইংরেজ নারী হানা ক্যাথরিন ম্যালেনস। “ফুলমনি ও করুনার বিবরণ” প্রকাশিত হয় ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে। “ফুলমনি ও করুণার বিবরণ” ইংরেজী সহ তৎকালীন সময়ে উপমহাদেশের আরও কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়। তবে পরবর্তীতে কোনো কারণে “ফুলমনি ও করুণার বিবরণ” পাঠকের দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। ফলে বাংলা ভাষায় লিখিত প্রথম উপন্যাস কোনটি এ বিষয়টি ঢাকা পড়ে যায়।
বাঙালি মহিলা রচিত প্রথম বই কৃষ্ণ কামিনী দাসীর “চিত্ত বিলাসিনী” প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় রাসসুন্দরী দেবীর “আমার জীবন”। এটি বাঙালি মহিলার লেখা প্রথম আত্মজীবনী। ছাপার হরফে যাঁর প্রবন্ধ পুস্তক প্রথম প্রকাশিত হয় তিনি বোধ হয় কৈলাস বাসিনী দেবী। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর এই প্রবন্ধ পুস্তকটি প্রকাশিত হয়। এখানে বোধ হয় বলার কারণ এই যে, কৈলাস বাসিনী দেবীর বছর দুয়েক আগে পাবনার বামা সুন্দরী দেবীরও একটি প্রবন্ধ মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই আড়াই হাজার শব্দের প্রবন্ধটিকে কেউ বই বলে বিবেচনা করলে কৈলাস বাসিনী প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থকার বা গ্রন্থকর্ত্রী হিসেবে মর্যাদা পাবেন না। কিন্তু সত্যিকার ভাবে একটা গোটা প্রবন্ধ বই প্রকাশের কৃতিত্ব কৈলাস বাসিনীরই প্রাপ্য।
নারী সম্পাদিত প্রথম বাংলা পত্রিকা “বঙ্গমহিলা” প্রকাশিত হয় খিদিরপুর থেকে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে। এটি ছিল পাক্ষিক। সম্পাদনায় ছিলেন মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়। মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্রের ইতহাসে প্রথম নারী সম্পাদক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন মাসিক “আন্নেসার” সুফিয়া খাতুন। “আন্নেসা” প্রথম মুসসমান নারী সম্পাদিত পত্রিকা। মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ সিদ্দিকী কর্তৃক চট্টগ্রাম থেকে এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে (১৩২৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ)। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয় স্বর্ণকুমারী দেবীর “সখী সমিতি”। এটি বাঙালি নারী পরিচালিত প্রথম প্রতিষ্ঠান।
বাংলার প্রথম দু’জন মহিলা গ্রাজুয়েট কাদম্বিনী বসূ (১৮৬১-১৯২৩ খ্রি.) ও চন্দ্রমুখী বসূ (১৮৬৯-১৯৪৫ খ্রি.)। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কাদম্বিনী বসূ ও সরলা দাস মহিলাদের মধ্যে প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি পান। কাদম্বিনী বসূ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রী। সরকার ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জন্য বেথুন স্কুলে কলেজ শাখা খোলে। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বি.এ পাশ করেন। বেথুন কলেজে তখন হিন্দু মেয়েদের প্রবেশাধিকার ছিল। চন্দ্রমুখী বসূ খ্রিষ্টান বলে বেথুন কলেজে প্রবেশাধিকার পাননি। তিনি এফ.এ (ফার্স্ট আটর্স) পড়েন ফ্রি-চার্জ-নর্মাল স্কুলে। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে অ্যালেন ডি. অ্যাব্রু নামে এক খ্রিষ্টান ছাত্রী বেথুন কলেজে ভর্তি হলে চন্দ্রমুখী বসুও ভর্তি হন এবং ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ এবং ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজিতে এম.এ পাশ করেন। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মেয়ে যিনি ইংরেজিতে এম.এ পাশ করেন এবং এই কলেজেই অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হন।
১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাদম্বিনীর বিয়ে হয় এবং কোলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা করেন তবে মেডিসিন পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার জন্য এম.বি উপাধি পাননি। অধ্যক্ষ তাঁকে গ্র্যাজুয়েট অব বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ জিবিএমসি উপাধি দেন। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং পরে L.R.C.P (এডিনবরা) L.R.C.S (গ্লাসগো) এবং D.F.P.S (ডাবলিন) উপাধি নিয়ে দেশে ফেরেন। কিছুদিন তিনি ডাফরিন হাসপাতালে ডাক্তারী করেন। পরে স্বাধীন চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করেন। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তিনি প্রথম নারী বক্তা।
কাদম্বিনী বসুর সঙ্গে মেডিকেল কলেজে আরও দুজন মেয়ে ডাক্তারি পড়তেন। তাঁরা হলেন ভার্জিনিয়া মেরী মিত্র ও বিধু মুখী বসু। ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত প্রথম এমবি পরীক্ষায় ভার্জিনিয়া প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিধু মুখী ও এমবি পরীক্ষায় পাশ করেন। এই এমবি পরীক্ষায় কাদম্বিনী বসু (১৮৬১-১৯২৩ খ্রি.) অকৃতকার্য হন। ঐ সময় ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বেথুন স্কুলে মুসলিম মেয়েদের পড়ার অনুমতি ছিলনা (তথ্যসূত্র: মালেকা বেগম, বাংলার নারী আন্দোলন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রেস লি. ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পৃষ্ঠা নং ৪৭)।
আধুনিককালে প্রথম মুসলমান লেখিকা কে ? আমরাও সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারিনা। কিন্তু বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.) অথবা ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী নওয়াব (১৮৩৪-১৯০৩ খ্রি.) যে নন, তা’ নি:সন্দেহে বলা যায়।
খোন্দকার শামসুদ্দীন মুহম্মদ সিদ্দিকীর “উচিত শ্রবণ” অর্থাৎ “পারমার্থিক ভাব” (১৮৬০ খ্রি.) গ্রন্থকে প্রথম মুসলমান লিখিত গদ্যগ্রন্থ বলে দাবি করা হয়। এটি প্রকাশিত হয়েছিল উমেশ চন্দ্র দত্ত সম্পাদিত কলকাতার “বামা বোধিনী” পত্রিকায়।
খোন্দকার শামসুদ্দিন মুহম্মদ সিদ্দিকী (১৮০৮-১৮৭০ খ্রি.) বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে “ভাবলাভ” নামে তাঁর একটি কবিতা পুস্তক প্রকাশিত হয়। এসময় উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যিক চুড়ামনি মীর মোশারফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১২ খ্রি.) বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। ১২৭১ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে (এ হিসেব মতে ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এক পূর্ব পুরুষ মুন্সী বশারতুল্লাহ খোন্দকার শামসুদ্দিন মুহম্মদ সিদ্দিকী কর্তৃক রচিত “উচিত শ্রবণ” নামক একটি বই নকল করেন। খুব সম্ভব কোন মুদ্রিত পুস্তক থেকেই এটি নকল করা হয়েছিল। “উচিত শ্রবণ” (অর্থাৎ “পারমার্থিক ভাব”) একটি ধর্মপুস্তক। Blue hard’s catalogue of Bengali printed Books in the Library of the British Museum থেকে জানা যায় “উচিত শ্রবণ” ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ছাপা হয়। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৬৬। ধর্মীয় বিষয়বস্তু ও গুঢ়তত্ত্ব বিষয় আলোচনা ছিল বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মীর মোশারফ হোসেনের প্রথম বই “রতœাবতী” প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। তারও বহু আগে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে “উচিত শ্রবণ” প্রকাশিত হয়েছিল। খোন্দকার শামসুদ্দিন মুহম্মদ সিদ্দিকীই যে প্রথম বাঙালি মুসলান গদ্য লেখক এ থেকে তা’ প্রমাণিত হয়।
জেনে রাখা ভালো বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের যুগে আরও দু’জন মুসলমান লেখকের নাম পাওয়া যায়। তাঁদের একজন গোলাম হোসেন এবং আর একজন শেখ আজিমউদ্দীন। তাঁরা উভয়েই পশ্চিমবঙ্গের লোক। গোলাম হোসেন “হাড় জ্বালানী” নামক একটি নক্সা জাতীয় রচনা লেখেন। “হাড় জ্বালানী” ১৬ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা। এটি ১২৭১ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে “কলিকাতা গরণ হাটা ষ্ট্রীটের ৯২ নং ভবনে এ্যাংলো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত হয়। শাশুড়ী বউয়ের ঝগড়া চিরন্তন। এই চিরন্তন বিষয় নিয়ে এ ক্ষুদ্র নক্সাটি রচিত। এতে লেখকের সমাজ সচেতনতার ছাপ সুস্পষ্ট।
শেখ আজিম উদ্দিন এর “কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে” ও ১৬ পৃষ্ঠার একটি ক্ষুদ্র প্রহসন। বইটি ১২৭৫ বঙ্গাব্দের ৩’রা জৈষ্ঠ ইংরেজী ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা গরণ হাটা ষ্ট্রীটে ২৬৮ নং ভবনে শ্রী কালিনাথ শীলের জ্ঞান দ্বীপক যন্ত্রে শ্রী সিদ্ধেশ্বর ঘোষ দ্বারা দ্বিতীয়বার মুদ্রিত হয়। সম্ভবত বছর খানেক পূর্বে এটি প্রথমবার মুদ্রিত হয়েছিল। “কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে” মাইকেল মধুসূদনের (১৮২৪-১৮৭৩ খ্রি.) “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো” (১৮৬০ খ্রি.) এবং দীন বন্ধু মিত্রের (১৮৩০-১৮৭৩ খ্রি.) “বিয়ে পাগলা বুড়ো”র (১৮৬৬ খ্রি.) মতো সমাজ সচেতন প্রহসন। আজিম উদ্দীনের “কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে” গদ্যে-পদ্যে রচিত হলেও পদ্যের তুলনায় গদ্যের ভাগ বেশি।
গোলাম হোসেনের “হাড় জ্বালানী”র প্রকাশকাল ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে। আজিম উদ্দীনের “কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে”র প্রকাশকাল ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। খোন্দকার শামসুদ্দীন মুহম্মদ সিদ্দিকীর “উচিত শ্রবণ” প্রকাশিত হয় এগুলোর বহুপূর্বে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে। সুতরাং খোন্দকার শামসুদ্দীনই প্রথম বাঙালি মুসলমান গদ্য লেখক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সেই অন্ধকার যুগে বাঙালি মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে এঁরাই যে আমাদের সাহিত্য সাধনার পথ দেখিয়ে গেছেন তার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।
তবে এক্ষেত্রে আরেকজনের নাম উল্লেখ করতে হয় তাঁর নাম শিমুয়েল পির বক্স। নাম দৃষ্টে মনে হয় যে ভদ্রলোক একসময় মুসলমান ছিলেন পরে ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হন। তাঁর খ্রিষ্টান হওয়ার সার্থকতার পরিচয় পাওয়া যায় “খ্রিষ্টীয় গীত সংহিতা”র একটি সংস্করণ সম্পাদনা করার মধ্যে দিয়ে। পির বক্স “বিধবা বিরহ নাটক” নামে একটি সামাজিক নক্সা-জাতীয় নাটক রচনা করেছিলেন। নাটকটি ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বিধবা-বিবাহের উদ্দেশ্য নিয়ে নাটকটি রচিত হয়। ছয় অঙ্কে সমাপ্ত নাটকটিতে তৎকালীন হিন্দু সমাজ-জীবনের যে চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে, তাতে নাট্যকারের বাস্তব-সচেতনতা অসঙ্কোচে প্রকাশ পেয়েছে। নাটকের বিধবা নায়িকা মনোমোহিনী তাঁর অতিবৃদ্ধ কামাতুর পিতার বিবাহ প্রবৃত্তি দেখে এবং আপন যৌবনের ব্যর্থতার কথা ভেবে অসহিষ্ণু হয়ে কুল ত্যাগ করে। এ ঘটনাটিকেই পল্লবিত করে নাটকটি রচিত হয়েছে। নাট্যকার স্থানে স্থানে সংলাপ-রচনার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেহেতু শিমুয়েল পিরবক্স খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তাই তাঁর গ্রন্থকে মুসলমান গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবেনা।
উনিশ শতকের দিকে নারী শিক্ষার প্রতি সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিকুল পরিবেশের কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। ফলে কিছু সংখ্যক হিন্দু মহিলা এ সময় সাহিত্য চর্চায় এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে রাস সুন্দরী দেবী, বামা সুন্দরী দেবী, হরকুমারী দেবী, কৃষ্ণকামিনী দাসী, কৈলাস বাসিনী দেবী, কৃষ্ণ ভাবিনী দাসী, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, স্বর্ণ কুমারী দেবী, গিরিন্দ্র মোহিনী দাসী, প্রসন্ন ময়ী দাসী, কুমুদিনী বসু, ইন্দিরা দেবী প্রমুখ মহিলার নাম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু পুরো উনিশ শতকে মাত্র সাতজন মুসলিম মহিলার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তাঁদের মধ্যে চারজনের রচনা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এরা হলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধূরানী, হাজী সহিফা বিবি, আজিজননেসা খাতুন ও খায়রুন্নেসা খাতুন। অন্য তিন মহিলা রচনা বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এদের মধ্যে বিবি তাহেরনন্নেসা, ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করে বামাবোধিনী পত্রিকায় একটি পত্র লিখেছিলেন।
এরপর ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরের অছিমন্নেসা খাতুন সিদ্দিকার “শরৎ যামিনী” নামের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো। বামাবোধিনী পত্রিকার সম্পাদক কবিতার শেষে মুসলিম মহিলার বাংলাভাষায় কবিতা চর্চায় আনন্দ প্রকাশ করে মন্তব্য করেছিলেন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের লতিফুন্নেসার বঙ্গীয় “মুসলিম মহিলার প্রতি” শীর্ষক একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। সম্ভবত তিনিই ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন (Sonia Nishat, The world of Muslim Women Colonial Bengal. 1876-1939, New york; E.J. BRILL, 1996, P.215)।
এই গুটিকয়েক মুসলিম মহিলার এ সামান্য সাহিত্য সৃষ্টি সমগ্র উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম মহিলার সাহিত্য সাধনারূপে বিরাজ করছে।
খোন্দকার শামসুদ্দীন মুহম্মদ সিদ্দিকীর “উচিত শ্রবণ” অর্থাৎ “পারমার্থিকভাব” (১৮৬০ খ্রি.) গ্রন্থ প্রকাশিত হবার পাঁচ বছরের মধ্যে বিবি তাহেরন নেসা নামক একজন মুসলমান মহিলার রচিত একটি গদ্য নিবন্ধ বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই মহিলাকেই সম্ভবত প্রথম মুসলমান গদ্য লেখিকা বলে আখ্যায়িত করা যায়। তাঁর পিতার নাম ছিল মুন্সি মোহাম্মদ তরিকুল্লাহ।
তাঁর ১২ জন ছেলে মেয়ের মধ্যে একমাত্র কণ্যা ছিলেন তাহেরন নেসা। তাঁর জন্ম সম্ভবত ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ী গ্রামে। রংপুর জেলার প্রথম মুসলিম গ্রাজুয়েট ও বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মুসলমানদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কোরানের বাংলা অনুবাদক খান বাহাদুর তসলিম উদ্দিন (১৮৫২-১৯২৭ খ্রি.) ছিলেন তাঁর আপন ভাই। বিবি তাহেরণ নেসার পুত্র ছিলেন দিনাজপুরের প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট ও বি.এল উকিল খান বাহাদুর একিন উদ্দিন আহমদ (১৮৬২-১৯৩৩ খ্রি.)
বামা বোধিনী পত্রিকার “বামা রচনা বিভাগে” প্রকাশিত এই নিবন্ধের কোনা নাম দেয়া হয়নি। পত্রিকায় প্রকাশের জন্য রচনাটি লেখিকা তাহেরন নেসা যে ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর-নভেম্বর মাসের আগেই উমেশ চন্দ্র সম্পাদিত বামা বোধিনী পত্রিকা দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন তার প্রমান আছে। তাহেরন নেসার রচনাটি শেষ পর্যন্ত ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ফ্রেব্রুয়ারী-মার্চ সংখ্যায় বামা বোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয।
তাহের নেসার কোনো বিস্তারিত পরিচয় মেলেনা। তাঁর এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধের শেষে তাঁর আরও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বোদা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রথম শেণির ছাত্রী। এই বোদা হলো বর্তমান পঞ্চগড় জেলায়। “চন্দন বাড়ি” এই গ্রামেই বালিকা বিদ্যালয়টি ছিল। কিন্তু ১৮৬৪ সালে কলকাতা থেকে অতদুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় কাজ করছিলো এবং তাতে তখন প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত খোলা হয়েছিল- একে খুব সাধারণ ঘটনা বলে মনে করা শক্ত। কোলকাতা থেকে সদ্য প্রকাশিত উমেশচন্দ্র দত্ত সম্পাদিত “বামা বোধিনী” পত্রিকা ও ততদিন সেখানে পৌঁছে গেছে সেটাকেও খুব সাধারণ ঘটনা বলে মনে হয়না। সে যাই হোক তখন বঙ্গদেশে মহিলাদের কোনো উচ্চ বিদ্যালয় ছিলনা। সূতরাং এটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এরকম একটি পাঠশালায় অধ্যয়নরত মুসলিম পরিবারে একটি গ্রাম্য বালিকার পক্ষে লিখতে পারার কৃতিত্বকে অসামান্য বলেই বিবেচনা করা হয়। লেখিকা এ নিবন্ধে তৎকালীন স্ত্রী শিক্ষার উপকারিতা এবং উপযোগিতা বর্ণনা করেছেন। প্রবন্ধের প্রথমে তিনি বলেছেন স্ত্রী এবং পুরুষ শ্রেণি কোনো একটি না-থাকলে পৃথিবীর “পরম মঙ্গলা কর নিয়ম সকল প্রতিপালিত” হতো না, বরং পৃথিবী “জনশূন্য অর ন্যানি তুল্য বোধ হতো” কিন্তু লেখিকা আক্ষেপ করে বলেছেন এ দেশের মহিলারা সেই বিদ্যা ধনে বঞ্চিত হয়ে বিশ্বের অনুপম শৃঙ্খলার মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন। “স্ত্রী লোকেরা স্বল্পবুদ্ধি এবং স্বভাব চঞ্চল”। তাহেরণ নেসা সেকালের এই জনপ্রিয় বিশ্বাস কে মেনে নিয়ে বলেছেন বিদ্যার অভাবে এই স্ত্রী লোকদের পক্ষে যে কোনো অনর্থ করা সম্ভব। কারণ “এমন কোনো গর্হিত কর্মই নাই যে তাহা মূর্খ দ্বারা হয়না”। তাছাড়া “অজাত ও মৃতপুত্র কেবল একবার দু:খদায়ক, কিন্তু মূর্খ সন্তান অসীম দু:খের উৎস”।
অপরপক্ষে বিদ্যোপার্জনের দ্বারা স্ত্রীগণের হৃদয়াকাশ আলোকিত হলে তারা “শৃঙ্খলার সঙ্গে সংসার ধর্ম প্রতিপালন পূর্বক আপনার ও স্বীয় পরিবারের যে কত অনির্বচনীয় আনন্দোৎপত্তি করতে পারে তা’ বর্ণনা করে শেষ করা যায়না।” নারী সুশিক্ষা পেলে “বিদ্বান পুত্রের মতোই” পিতৃ ও স্বামী উভয়কুল সমুজ্জল করতে পারেন।
উপসংহারে লেখিকা বলেছেন- “যদি ধরাধামকে যথার্থই সুখধাম রূপে দেখার বাসনা থাকে” তাহলে পুরুষ সমাজ যেন সকল ঔদাসীন্য বর্জন করে “স্ত্রীগণকে বিদ্যাভূষায় ভূষিত করতে চেস্টা” করেন। প্রসঙ্গত লেখিকা লীলাবতি, খনা, রানী ভবনাী প্রমুখ মহিলার দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করেন।
বিবি তাহেরন নেসা সেকালে নিতান্ত তুচ্ছ বালিকা বিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রী ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর ভাষা এবং রচনাশৈলী সেকালের বহু গদ্য লেখকের তুলনায় পরিণত ছিলো। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে গোটা বঙ্গদেশে বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ৯৫-তে এবং এসব বিদ্যালয়ে মোট ২,৪৮৬ জন ছাত্রী তালিকাভূক্ত ছিলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাহেরণ নেসার অস্তিত্বকে প্রায় অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। তাঁর রচনাটি প্রকাশিত হওয়ার আগে সেটি যে তারই লেখা তার ভালো প্রমান পাঠাতে বলা হয়েছিল। লেখিকা নিশ্চয়ই এমন প্রমান পাঠিয়েছিলেন যে, নিবন্ধটি তাঁরই রচনা। প্রকাশিত নিবন্ধের শুরুতে বামাবোধিনী পত্রিকার “বামা কুল হিতৈষী সম্পাদক” কে সম্বোধন করে তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেন। সূতরাং আমরা ধরে নিতে পারি, এটি তাঁর নিজেরই লেখা।
বিবি তাহেরন নেসার আর কোনো রচনা অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। বর্তমান প্রবন্ধটি তাহেরণ নেসার প্রকাশিত রচনার মধ্যে সম্ভবত সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ। বর্তমান রচনায় যে মহৎ সম্ভাবনার বীজ লুকানো ছিলো, হয়তো লেখিকার বিবাহের ফলে সেকালে বহু মহিলার মতোই তা’ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল। কিন্তু তা’ সর্ত্ত্বেও বলা যায়, সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য নিবন্ধটি স্ত্রী শিক্ষার গুণগত মানের বিচারে এতো অসাধারণ যে এরই দাবিতে বিবি তাহেরণ নেসা প্রথম যুগের মুসলমান গদ্য রচয়িতাদের মধ্যেতো বটেই এমনকি তাবৎ মহিলা লেখকের মধ্যেও একটি বিশিষ্ট স্থান লাভ করতে পারে।
২। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী (১৮৩৪-১৯০৩ খ্রি.)
নওয়ার ফয়জুন্নেসা চৌধূরানী ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লা (ত্রিপুরা) জেলার পশ্চিমগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ শাসনাধীন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান মহিলা নওয়াব ও নারী শিক্ষার রূপকার ও প্রজাবৎসল জমিদার। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধূরানী বাংলাদেশে তিনি একমাত্র মহিলা যিনি এই উপাধি পান। তাঁর পিতা আহমেদ আলী চৌধূরী (মৃত্যু ১৮৪৪ খ্রি.) ছিলেন একজন নামকরা জমিদার। মা’আফরুন্নেসা (মৃত্যু ১৮৮৫ খ্রি.)।
আহমেদ আলীর পূর্ব-পুরুষ দিল্লীর বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে সনদ লাভ করে হোমনাবাদ পরগণার জমিদান হন। ফয়জুন্নেসার বড় দুই ভাই ছিলেন এয়াকুব আলী চৌধুরী ও ইউসুফ আলী চৌধুরী। তাঁর ছোট বোন লতিফুন্নেসা চৌধুরানী ও আমিরুন্নেসা চৌধুরানী।
ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী বাউক সারের জমিদার মোহাম্মদ গাজী চৌধুরীর সঙ্গে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পিতার দিকে থেকে তিনি তাঁর দুর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন।
গাজী চৌধুরীর একান্ত আগ্রহে এই বিয়ে সুসম্পন্ন হয়। ফয়জুন্নেসা স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন। তাঁর দুটি কন্যা সন্তান ছিল আরশাদুন্নেসা ও বদরুন্নেসা। ফয়জুন্নেসার দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। ৬/৭ বছরের মাথায় স্বপত্নী বিদ্বেষের কারণে তাঁর স্বামী থেকে বিচ্ছেদ ঘটে। তিনি পিতৃগৃহে ফিরে বাকী জীবন অতিবাহিত করেন। দ্বিতীয় কন্যা বদরুন্নেসা তাঁর সঙ্গেই ছিল।
১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। ফয়জুন্নেসা নিজ চেষ্টায় বাংলা শেখেন এবং সংস্কৃতি ভাষায়ও শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ইংরেজী ভাষা জানতেন কিনা জানা যায়নি। কিন্তু ইংরেজী শিক্ষার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল তা’ প্রমাণিত। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নিজ খরচে তিনি কুমিল্লায় ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাজউদ্দীন মিয়া তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন। শৈশবে তাঁর নিকট তিনি শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর গৃহে পরিবারিক লাইব্রেরী ছিল। এই লাইব্রেরীতে তিনি নিয়মিত লেখাপড়া করতেন। ফয়জুন্নেসার বাংলা ভাষা শিক্ষার এবং বাংলা গ্রন্থ রচনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এদিক থেকে তিনি বেগম রোকেয়ার অগ্রগামী ছিলেন।
[অসমাপ্ত)