শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

এক রিকশাওয়ালার কাহিনী এবং...

খান মুহাম্মদ ইয়াকুব আলী : মানুষ কখন কোন্্ কাজে আঘাত পায় আর কোন্্ কাজে আনন্দ পায় তা বলা কঠিন। দেখা যায় কোটি টাকা পেয়ে যতটুকু আনন্দ পায়, তার চেয়ে বেশি আনন্দ পায় একটি খিলি পান খেয়ে। মা-বাবা সন্তানের অর্জিত লক্ষ টাকার চেয়ে একটু মুচকি হাসিতে বেশি আনন্দ পায়। বায়েজিদ বোস্তামী আল্লাহ্র অলি ছিলেন। তার মা ছেলের কাছে এক গ্লাস পানি চেয়েছিলেন। ছোট ছেলে পানি নিয়ে হাজির হওয়ার পর দেখে মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। বায়েজিদ ভাবলো মাকে ঘুম থেকে ডাকলে তার কষ্ট হবে, আবার আমি ঘুমিয়ে পড়লে মা পানি চাইলে পাবে কোথায়। তাই সে পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।  ঘুম ভাঙার পর মা তার ছোট ছেলেটিকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেনÑ ‘বাবা একি! তুমি পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো’ মহীয়সী নারীর যোগ্য সন্তান বিষয়টির ব্যাখ্যা দেয়ার পর মা পানি পান করে সন্তানকে ঘুমোতে বললেন আর তিনি রুমের দরজা বন্ধ করে মহান আল্লাহ্র কাছে সেজদায় পড়ে গেলেন। বললেন ‘হে আমার প্রভু তুমি আমার বায়েজিদকে তোমার প্রিয় বান্দাহ্ হিসেবে কবুল কর।’ মহান আল্লাহ্ তাঁর দোয়া কবুল করে বায়েজিদ বোস্তামীকে আল্লাহ্র অলি হিসেবে কবুল করেন। তাই বলছিলাম, অনেক বড় বিষয়েও মানুষ খুশি হয় না। আবার সামান্য কিছুতে মানুষের হৃদয় জয় করে নেয়। শিরোনামে যে রিকশাচালকের কথা বললাম, তার রিকশায় উঠে গন্তব্যে এসে ২৫ টাকা ভাড়া দেয়ার পর সে ৫ টাকা ফেরত দিয়ে দিল। আমি বললাম ৫ টাকা নিন। উত্তরে সে বললো ভাড়া ২০ টাকা ২৫ টাকা নিবো কেন। আমি বললাম, আমি খুশি হয়ে দিয়েছি। মনে হলো সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার ৫ টাকা গ্রহণ করলো। বিষয়টি মনে নাড়া দিল এবং লেখকদের বাতিক কিছু একটা পেলেই লিখতে বসে যায়, তার ব্যতিক্রম ঘটলো না। ভাবলাম কতই না ভালো হতো দেশের জনগণ অন্তত এই রিকশাওয়ালার মত হলেও সমাজটায় কত শান্তি হতো। মনে পড়ে দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ইফতার মাহফিলের কথা। মালিক পক্ষের একজন বলেছিলেন, ‘আমরা আপনাদের আরো অনেক কিছু দিতে চাই, কিন্তু তা পারিনি। অন্যদিকে কর্মচারীদের পক্ষে একজন বললেন, ‘আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। যেখানে মালিক বলে আমরা কিছু দিতে পারলাম না। আর কর্মচারী বলে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। সে প্রতিষ্ঠানে কোনদিন মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না। সেখানে আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হয়। টিভিতে এক অনুষ্ঠানে দেখিয়েছিল, এমন হলে কেমন হতো’। সে অনুষ্ঠানে গোশ্ত বিক্রেতা বলছে, ‘না ভাই আপনাকে আর হাড় দিবো না, এই গোশ্ত নিন। আর ক্রেতা বলছেন, না ভাই একটা হাড় দিন অন্যথায় আপনার ক্ষতি হয়ে যাবে।’ রিকশায় উঠে ভাড়া দেয়ার সময় যাত্রী ২০ টাকা দিচ্ছে আর রিকশাওয়ালা বলছে না আমার ভাড়া ১০টাকা তাই দিন। তখন ভেবেছিলাম, সত্যিই এমন তো হয় না। আজ বহুদিন পরে দেখলাম, এমনটিও হয়। কয়েকদিন পূর্বে আমার একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘চিতই পিঠার দোকান থেকেও শিখার আছে অনেক কিছু।’ সেখানে পিঠা বিক্রেতা বৃদ্ধা যে মিষ্টি সুরে বলেছিলেন, বাবা একটু বন’। তার কথায় মুগ্ধ হয়ে সে লিখাটি লিখেছিলাম। মনের মাঝে একটা হিনমন্যতা কাজ করছিল, এটা কি কোন লেখার পর্যায়ে পড়ে? কিন্তু আমার হিনমন্যতা দূর হলো এবং লেখার বিষয়ে আরো আগ্রহী হলাম এজন্য যে, ঢাকার সম্ভ্রান্ত এলাকা উত্তরা মডেল টাউনে বসবাসরত এক ব্যক্তি, কথাবার্তায় মনে হলো অত্যন্ত ভদ্র ও উচ্চমানের শিক্ষিত লোক। নাম জনাব ওবায়দুল হক। তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, ‘এ যাবত আপনার সকল লেখা কাটিং করে রেখেছি অথচ আপনাকে চিনি না এবং ফোন নম্বরও যোগাড় করতে পারিনি। আজ নম্বর যোগাড় করে ফোন দিলাম, এজন্য যে, আপনার চিতই পিঠার দোকানের লিখাটি নিয়ে আমার পরিবারের মধ্যে পাঠচক্র হয়েছে। ভদ্রলোকের কথায় আমি এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছি যে, নিজেকে লেখক ভাবতে ইচ্ছে করে। তাই এবার রিকশাওয়ালার নিকট থেকেও শিখার আছে অনেক কিছু, তা না বলে বললাম, ৫ টাকা ফেরত দিলেন রিকশাওয়ালা। আর সেই চিতই পিঠা বিক্রেতা বৃদ্ধ মহিলার চরিত্র আর আচরণ যদি আমাদের মধ্যে থাকত, থাকতো যদি আমাদের রাজনীতিবিদদের কথা, আর আচরণে। তবে কতইনা ভালো হতো। এটা হওয়া সম্ভব এটা কোন কঠিন কাজও নয়। কেবলই মানসিকতা। কেবল আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের অন্য দেশেও দেখা যায়, রাষ্ট্রপ্রধানের সন্তান বা তিনি নিজে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করেন। কিসের এত অভাব? অভাব কেবলই উন্নত চরিত্রের। এ মানসিকতা দূর করা সম্ভব, এর জন্য অবাস্তব কবিতা বলার দরকার নেই। “এমন যদি হতো ইচ্ছে হলেই আমি হতাম প্রজাপতির মত।” না প্রজাপতির মত হওয়ার দরকার নেই। কেবল একটি সিদ্ধান্তই যথেষ্ট, আমার আর চাহিদা নেই। কেবল একটু ভাবলেই হয়, আমি কি ঐ রিকশাচালকের মত হতে পারি না। কেন নিজেকে এতটা নিচের মনে করবো? কেন এমন চরিত্র ধারণ করবোÑ যা একজন রিকশাওয়ালার চরিত্রের সমানও নয়। যাদের নিকট থেকে আচরণ শিখার কথা ছিল, তারাই আজ একেবারে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তি হওয়ার মত অবস্থান থেকে দূরে। উদাহরণ দিলে বুঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে যেমন শিখার আছে। আবার অনুপ্রেরণাও পাওয়া যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এ ভাষণকে তাদের সিলেবাসের একটি পড়া মনে করে। কলাম লেখকও ৭ই মার্চের ভাষণ লিখে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করেছে। পক্ষান্তরে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জনসভায় যে বক্তব্য রেখে যাচ্ছেন তা থেকে আমাদের কি শিখার আছে, তা খুঁজে পাই না। বরিশাল, খুলনা ও সিলেটের জনসভায় একই রকম বক্তব্য। যার মূলকথা, ‘খালেদা জিয়া দুর্নীতিবাজ, তাই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে নৌকা মার্কায় ভোট দিন।’ বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে একই কথা বললেন ‘জনগণ আর দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে নৌকা মার্কায় ভোট দিন।’ এখানে বলার ইচ্ছে জাগে, এতই যদি উন্নয়ন করে থাকেন, তা কি জনগণ চোখে দেখে না। জনগণের কি চোখের পাওয়ার কমে গেছে? উন্নয়ন করে থাকলে আপনি না চাইলেও জনগণ ভোট দেয়ার জন্য পাগল হয়ে যাবে। যেমন রিকশাওয়ালা ৫ টাকা নিতে চাইল না, অথচ আমি তাকে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলাম। সে তার পাওনার অতিরিক্ত নিতে চাইলো না, এটাই তার ব্যক্তিত্ব। একেই বলে নৈতিকতা। আমিও তার আচরণে মুগ্ধ হয়ে ৫ টাকা বেশি দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলাম। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা কেন নিজের কার্যক্রমের উপর আস্থা রেখে নিজেকে ঐ রিকশাওয়ালার মত অন্যের উপর ছেড়ে দিতে পারেন না। যদি সত্যিই ভাল কাজ করে থাকেন। তবে কি জনগণ অবিবেচক যে, আপনার ভালো কাজের সম্মানী দিবে না। তাই বলি, আস্থা রাখুন নিজের কর্মের উপর, আস্থা রাখুন জনগণের উপর।

কেবল একটি কথা মনে করিয়ে দেই, নিজের কর্ম ভালো হলে জনগণই তার প্রতি ঝুঁকে পড়বে। আমাদের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের প্রতি মানুষের ভালবাসা এখনও আছে, তিনি যদি আবার কোন দায়িত্বে আসতেন মানুষ তা সম্মানের সাথে গ্রহণ করত। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ জনগণের হৃদয় জয় করে নেন। তাকে জনগণ আবারও ডাকছে। ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমদিনেজাদ দুইবার রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তাদের দেশে দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন না। অন্যথায় তিনি আবারও প্রেসিডেন্ট হতেন। আমরা জনগণের ভোট কেটে, ভোট কেন্দ্রে কুকুরকে ঘুম পাড়িয়ে ঘরে বসেই এমপি মন্ত্রী হয়ে যাই। আবার বলি জনগণ আমাদের সমর্থন করার জন্য উপচে পড়েছে। যদি তাই হয়, তবে কেন বলতে পারছি না, তোমরা যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন চাও, আমি সেভাবেই প্রস্তুত। যে নেকী আমি করেছি, জনগণের সমর্থনে আমার নেকীর পাল্লাই ভারী হবে।’ এমন একটি সৎসাহস দেখানোর মত বুকের পাটা কি আছে। ভারতের কংগ্রেস নেত্রী ক্ষমতায় যাওয়ার পরও বললেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হবো না, বাংলাদেশে আসার পূর্বে বলে দিলেন আমাকে ভিআইপি সম্মান দিবেন না এমন একটি কথা বলার সাহসও কি আছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ