শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মেধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : শাসকরা যেন দেশের মেধাবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেছে। এই যুদ্ধের প্রথম মহড়া অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ৮ এপ্রিল রাতে। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ছাত্র ও চাকরি প্রার্থীরা ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৮ এপ্রিল শাহবাগে সমবেত হন। ফলে গোটা শাহবাগ এলাকা অচল হয়ে পড়ে। ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য সন্ধ্যা সোয়া সাতটা থেকে পুলিশ এই নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। তারা আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর টিয়ার শেল, রাবার বুলেট, জলকামান নিয়ে হামলে পড়ে। এতে শতাধিক ছাত্র আহত হন। গ্রেফতার করা হয়েছে ২০ জন ছাত্রকে। শত শত পুলিশের একযোগে এই হামলায় শাহবাগ এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেখান থেকে সরে যান ছাত্ররা। কিন্তু তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে যার যার বাসায় চলে যাননি। বরং ছড়িয়ে পড়েন শাহবাগ, নীলক্ষেত, দোয়েল চত্বর, টিএসসি প্রভৃতি এলাকায়। রাতভর আন্দোলন চলেছে। ৯ তারিখও সারাদিন ধরে বিরতিহীনভাবে আন্দোলন চলেছে। ৯ তারিখে সন্ধ্যায় যখন এই লেখা লিখতে বসেছি, তখনও ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান করছিলেন।

কোটা ব্যবস্থার মাজেজা হলো এই যে, সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ কোটায় হয়। বাকি মাত্র ৪৪ শতাংশ চাকরি হয় মেধার ভিত্তিতে। এটা কোনো অবস্থাতেই যৌক্তিক হতে পারে না। ফলে দেশ ক্রমেই মেধাহীনদের হাতে চলে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে যখন ছাত্ররা দাবি উত্থাপন করলেন তখন প্রধানমন্ত্রী রেগে গিয়ে বললেন, কোটা ব্যবস্থা থাকবে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও এই কোটার সুবিধা পাবে। কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবি তোলেননি শিক্ষার্থীরা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোটা থাকাটা তারা যৌক্তিকই মনে করেছেন। সে জন্য তারা কোটা সংস্কারের কথা বলেছেন, বাতিলের কথা বলেননি। যেমন মহিলা কোটা, কিংবা প্রতিবন্ধী কোটা, এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্তুতি কোটাÑএগুলোকে কেউ অস্বীকার করেননি।

তবে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা কোটার জন্য যুদ্ধ করেননি। তাই কোটার কথা বললে তাদের অপমান করা হয়। কিন্তু তারা এর সংস্কার চেয়েছেন। যাতে অধিক হারে মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারে। এই কোটার গ্রাস শুধু চাকরির ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা এক সর্বনাশা ব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকলে কিংবা মেডিকেলে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন না করলে তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে নেয়া হচ্ছে। মেডিকেল কলেজে পড়ানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত না হয় মানা যায়, তিনি কোনোমতে পাস বা থার্ড ক্লাস পেয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন। তারপর কি করবেন সেটা অনিশ্চিত। কিন্তু মেডিকেলে কলেজের অযোগ্যদের ভর্তি করার ফলে মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সরকার যেন এটাকে নিয়ে গর্বই করছে। আবার দেশে উপজাতীয় জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের সামান্য বেশি। কিন্তু তাদের জন্য সংরক্ষিত আছে ৫ শতাংশ আসন। তবে বিপদের কথা এই যে, এই ৫ শতাংশ আসনের সবটুকুর সুবিধা নিচ্ছেন চাকমা উপজাতীয়রা। অন্যান্য উপজাতীয় এর কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারছেন না। তাছাড়া ১ শতাংশ লোকের জন্য ৫ শতাংশ আসন কেন সংরক্ষিত থাকবে? ছাত্রদের দাবি ছিল, এই কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে ১৫-২০ শতাংশে নিয়ে আসা হোক। বাকি ৮০-৮৫ শতাংশ আসুক মেধার ভিত্তিতে। মেধার ভিত্তিতে এলে সরকারের লাভ, জনগণের লাভ এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও লাভ। মেধাহীন জাতি কখনো অগ্রসর হতে পারে না। এই কোটা-ফোটা করতে গিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রশাসনে এখন ইংরেজি জানা লোকের অভাব পড়েছে। অনেক সময় কোনো চিঠিপত্র বোঝার জন্য বা তার জবাব তৈরি করার জন্য ইংরেজি জানা লোক ভাড়া করে আনতে হয়। 

এটা যে হয়েছে তার কারণও ভিন্ন। একদিকে কেটায় তো মেধা খায়ই। অপরদিকে বাকি মেধার ভাগ যে ৪৪ শতাংশ তাতে ঘটে দলীয়করণ। নানা কৌশলে দলের লোকদেরই এসব জায়গায় চাকরি দেয়া হয়। মেধাবীরা রাস্তায় ঘোরে। সে দিকে বিবেচনা করলে মেধার ভিত্তিতে ৫-১০ শতাংশ লোকের চাকরি হয় কিনা সন্দেহ। মেধা আসবে কী ভাবে, কারণ প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শুনলাম, সামরিক বাহিনীতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কেবল যেন মেধা বিবেচনায় নেয়া না হয়। তার রাজনীতিক বিশ্বাসও যেন বিবেচনায় নেয়া হয়। এ ভয়ঙ্কর কথা। এখানে মেধাবীদের বঞ্চিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়। অর্থাৎ সরকার এমন এক ব্যবস্থা করেছে যাতে মেধাবীরা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে না পারে। ঢুকে বেরিয়ে গেলেও যাতে সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে না পারে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে রাষ্ট্র ক্রমেই মেধাশূন্য হয়ে পড়েছে। চারদিকে মেধাহীনতা, নৈতিক অধঃপতন আর ঘুষ দুর্নীতিতে ভরে গেছে। তাই কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীরা কোটা ব্যবস্থাকে যৌক্তিক রূপ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সরকার গত ৫ এপ্রিল এক পরিপত্র জারি করে কোটা ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ অবস্থায় গত ৮ এপ্রিল রাতে শত শত পুলিশ এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। টেলিভিশনে তার লাইভ বিবরণী আমরা দেখেছি। মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধক্ষেত্র। এই আন্দোলন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। কোথায়ও কোথায়ও কলেজের ছাত্ররাও কোটা সংস্কারের দাবিতে ক্লাস বর্জন করে আন্দোলনে শরিক হয়। ৯ তারিখ দিনভর বিক্ষোভ, আন্দোলন চলেছে। ৮ তারিখ মধ্য রাতে কোটা সংস্কারের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা গেট ভেঙে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলেন। তাদের বাধা দিয়েছে ছাত্রলীগ ও পুলিশ। সে বাধাও অতিক্রম করে তারা এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন টিএসসিতে, পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। পুলিশ ছাত্রীদের লক্ষ্য করেও অবিরাম টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুঁড়েছে। টিএসসির সড়ক দ্বীপের আলো নিভিয়ে দিয়ে তারা এমন নারকীয় তা-ব ঘটিয়েছে। ছাত্রীরা টিএসসি’র ভেতরে যখন চলে যান তখন, আন্দোলনরত ছাত্ররা এক প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করে ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। আর ব্যুহের ভেতরে ছাত্রীরা কোটা সংস্কার দাবিতে অবিরাম স্লোগান দিতে থাকে। এই ছিল ৮ তারিখ রাতের চিত্র। কিন্তু থেমে যাননি তারা। রাত দেড়টার সময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নানক সাহেব গিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, তারা যেন আন্দোলন স্থগিত করে। সরকার কোটা সংস্কারের বিষয়টি বিবেচনা করবে। কিন্তু এতেও ছাত্ররা থামেননি। তারা রাতভর বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। এলাকা ছেড়ে দেননি। আর এ কথা বিশ্বাস করেননি যে, সত্যি সত্যি সরকার কোটা সংস্কারে আন্তরিক হবে। সে জন্য তাদের দাবি ছিল এই সংস্কারের ঘোষণা এখনই দেয়া হোক। যদি আইন করতে হয়, সংসদ অধিবেশন চলছে, আইন পাস করা হোক। কোটার অভিশাপ থেকে মেধাবীদের মুক্ত করা হোক। সেটি হয়নি।

এরপর ঘোষণা এলো যে, আন্দোলনকারী ছাত্রদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৈঠকে বসবেন। আন্দোলন সারা দেশে চালু হয়ে যায়, সকল বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে যায়। যে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের দিকে গুলিবর্ষণ করেছিল, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ধাওয়া খেয়ে তারাও হয় পগারপার। পরে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা ‘বিবেকের তাড়নায়’ ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ফলে সাধারণত সরকার ছাত্রলীগ দিয়ে ঠেঙিয়ে যা আদায় করে, এখানে তা আদায় করা সম্ভব হয় না। আন্দোলনকারীরা ভয়-ভীতিকে পরোয়া করেননি, এমনকি ছাত্রলীগকেও না। তারা ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষ যথাসম্ভব এড়িয়ে গেছেন। এর মধ্যে একদল মুখোশধারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ভিসি’র বাসভবনে হামলা চালায়। এরা সাবোটিয়ার। আন্দোলনের গতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য তারা এই কাজ করেছে। ভিসি আক্তারুজ্জামান বলেছেন, তাকে হত্যার জন্য এ হামলা করা হয়েছিল। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিদাররা ভিসি’র বাসভবন হামলা করতে যাবেন কোন যুক্তিতে? কারণ কোটা সংস্কারে ভিসি’র কোনো ভূমিকা নেই। এর মধ্যে অনেকে আবার জামায়াত-শিবিরের গন্ধও আবিষ্কার করেছেন। তাতেও মনে হয় বিষয়টি সাবোটাজই ছিল।

দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন সময়ে কোটা সংস্কারের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, কোটা পদ্ধতি মেধা বিকাশের পথে অন্তরায়। আলোচিত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবাল তিনিও বলেছেন, তিনি কোটার পক্ষে নন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কোটা সংস্কারের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। টেলিভিশনে দেখলাম অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকও সংস্কারের পক্ষে। তাহলে কার স্বার্থে কোটা পদ্ধতি বহাল থাকবে? একদিকে ছাত্রদের আশ্বাস দেয়া হলো যে, কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করা হবে। অপরদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব বললেন, কোটা সংস্কার কোনোভাবেই হবে না। অর্থাৎ শুরুতেই প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে একটি প্রতিনিধি দল দেখা করেছেন। সেখানে তাদের বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী যেহেতু আগামী এক মাসে দু’বার বিদেশ সফরে যাবেন সুতরাং আন্দোলন এক মাস স্থগিত রাখা হোক। আলোচনাকারীরা যখন টিএসসি এলাকায় ফিরে এসে এই প্রস্তাবের কথা শোনান, তখন সমবেত হাজার হাজার শিক্ষার্থী ‘মানি না মানি না’ বলে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেন। কারণ তারা উপলব্ধি করেছেন, এটি তাদের সঙ্গে কালক্ষেপণের মাধ্যমে প্রতারণার কৌশল বৈ আর কিছু না। 

ইতিমধ্যে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে গেছে। সর্বত্র সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস বর্জন করেছে এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ছাত্রদের ওপর এই হামলার লক্ষ্য কী? কেন তাদের ওপর তাদের বিরুদ্ধে এইভাবে যুদ্ধ গোষণা করা হবে? ইতিহাসের সাক্ষ্যে আমরা দেখেছি, ছাত্রদের এই ধরনের আন্দোলন কখনই বিফলে যায় না। শেষ পর্যন্ত তাদের বিজয় অর্জন হয়। ’৫২-তে দেখেছি, ’৬২-তে দেখেছি, ’৬৯-এ দেখেছি, ’৭১-এ দেখেছি, ’৯০-এ দেখেছি। ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়ই। সরকার হয়তো ভেবেছিল, পুলিশ আর ছাত্রলীগ দিয়ে এ আন্দোলন দমন করে দেবে। কিন্তু তা যে শেষ পর্যন্ত পারা যায় না। সরকার সেটা উপলব্ধি করলে ভাল করবে। আমরা বলি, অবিলম্বে কোটা সংস্কারে ন্যায্য দাবি না মেনে নেয়া হোক। কোটা নামিয়ে আনা হোক ১৫-২০ শতাংশে। তাহলে কেবল মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে জায়গা করে নিতে পারবে। সরকার মেধার সংকটে ভুগবে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ