পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে খুলনা অঞ্চলে বাড়ছে পুষ্টিহীনতা
খুলনা অফিস : শিক্ষা ও অর্থনীতিতে খুলনা অঞ্চলের ব্যাপক সফলতা এসেছে। দেশ এখন উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে। কিন্তু যাদের হাত দিয়ে দেশের এ অর্জন সেই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে বয়সের তুলনায় তাদের দৈহিক উচ্চতা, ওজন কম হচ্ছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এ হার কমিয়ে আনতে পুষ্টিজ্ঞানবিষয়ক সচেতনতার প্রয়োজন বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেল্থ ২০১৪ সালে খুলনা বিভাগে পুষ্টিবিষয়ক একটি সার্ভে পরিচালনা করে। সেখানে তারা বলেছে, ২৫.৫ শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। ২৮.১ শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় উচ্চতা (খাটো বা বামন) কম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে মারা যায় প্রতি হাজারে ৪১ জন যা বাংলাদেশের জাতীয় হার প্রতি হাজারে ২৮ জন। অর্থাৎ সারা দেশে প্রতি হাজারে মারা যায় ২৮ জন কিন্তু শুধু খুলনা বিভাগে মারা যায় ৪১ জন শিশু। জন্মের এক বছরের মধ্যে মারা যায় প্রতি হাজারে ৪৭ জন যা বাংলাদেশের জাতীয় হার প্রতি হাজারে ৩৮ জন। জন্মের ৫ বছরের মধ্যে মারা যায় প্রতি হাজারে ৫৬ জন যা বাংলাদেশের জাতীয় হার প্রতি হাজারে ৪৬ জন। জন্মের ১ ঘন্টার মধ্যে মাতৃদুগ্ধ পান করে ৩৯.১ শতাংশ শিশু। জন্মের ১ দিনের মধ্যে মাতৃদুগ্ধ পান করে ৮১.১ শতাংশ শিশু। জন্মের সময় ২৫শ’ গ্রামের নিচে ওজন থাকে ২৪.২ শতাংশ শিশু। ৫০.৫ শতাংশ শুধুমাত্র বুকের দুধ পান করে।
খুলনা সিভিল সার্জন এএসএম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখন আর মানুষ না খেয়ে থাকে না। কিন্তু মানুষের মধ্যে সঠিক পুষ্টিজ্ঞান না থাকায় শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের ঠিক মত চেকআপ এবং পরিচর্যা করা হয় না। আবার শিশু জন্মের পরে মায়েদের পরবর্তী সেবা দিতে অনেকেই অনীহা প্রকাশ করে। ফলে নারী এবং শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগতে থাকে। একজন দুর্বল মায়ের কাছ থেকে ভাল শিশু আশা করা যায় না।
পুষ্টিহীনতায় স্কুলে উপস্থিতি কমছে : রিমা আক্তার, মিম, মাহফুজা আক্তার তামান্না, উম্মে হাবিবা, শাহানা আক্তার রুবাইয়া, ইশরাত জাহান, কুসুম আক্তার শিলা সবাই শিক্ষার্থী। নগরীর সিটি গার্লস্ স্কুলে বিভিন্ন শ্রেণিতে অধ্যয়ন করে। স্কুলেও নিয়মিত আসার চেষ্টা করে। তবে তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যায় তাদের মধ্যে পুষ্টি সমস্যা রয়েছে। স্কুলে মোট শিক্ষার্থীর ৭৫ শতাংশই এই সমস্যায় ভোগে। এ কারণে স্কুলে অনুপস্থিতিও বৃদ্ধি পায়। এমন কথা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি জানিয়েছেন তাদের শিক্ষকও।
জানা গেছে, নগরীর সিটি গার্লস্ স্কুলটি খুলনা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক পরিচালিত। স্কুলটিতে প্লে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। সর্বমোট শিক্ষার্থী ২৩৪ জন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষকের ভাষ্য অনুযায়ী ৭৫ শতাংশই পুষ্টিহীনতায় ভোগে। নিয়মিত হাজির হতে পারে না স্কুলে। বছরের অধিকাংশ সময়ই থাকে অসুস্থ। গড় ভিত্তিতে দৈনিক ৩০ শতাংশই শ্রেণিতে অনুপস্থিত থাকে। বিভিন্ন সময়ে স্কুলে অভিভাবক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের মায়েরা জানিয়েছেন তাদের সন্তানদের চাহিদার ৬০ শতাংশই পূরণ করতে পারে না। এছাড়া দারিদ্রতার কারণও বাধা হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষার্থীদের পুষ্টি পূরণে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশও এর জন্য কম দায়ি নয়। এদিকে এ কারণে দিন দিন প্রতিষ্ঠানটিতে অনুপস্থিতির হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রিমা আক্তার। তিনি বলেন, তার খাওয়া দাওয়াতে কোন সমস্যা নেই। বাড়িতে যা রান্না করা হয় তা সে খেতে পারে।
মিম নামের সপ্তম শ্রেণির আরেক ছাত্রী বলেন, তারও কোন কিছুতে সমস্যা নেই। মাঝে মাঝে কিছুটা সমস্যা হয়। মাঝে মাঝে অনুপস্থিতও থাকে।
মাহফুজা আক্তার তামান্না অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। তিনি বলেন, তার শারিরীক কোনো সমস্যা নেই। তবে খাওয়া-দাওয়ায়ও কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু বেগুন ও কলাসহ আরও অনেক খাবার খেতে পছন্দ হয় না।
অষ্টম শ্রেণির আরেক ছাত্রী উম্মে হাবিবা বলেন, তার মাছ ও ডিম জাতীয় খাবার খেতে ভাল লাগে না। কিন্তু আইসক্রীম খেতে খুবই পছন্দ হয়।
শাহানা আক্তার রুবাইয়া পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। তিনি বলেন, অসুস্থতার কারণে তিনি প্রায়ই স্কুলে হাজির হতে পারেন না। খাওয়া দাওয়াতেও খুব আগ্রহ নেই।
ইশরাত জাহান নামের পঞ্চম শ্রেণির আরেক ছাত্রী বলেন, তারও খাওয়া-দাওয়া সংক্রান্ত কিছুটা অনাগ্রহ রয়েছে। স্কুলেও উপস্থিত হতে পারে না ঠিকমতো।
অষ্টম শ্রেণির কুসুম আক্তার শিলা বলেন, তার খাওয়া দাওয়ায় কোনো সমস্যা নেই। স্কুলেও আসতে কোন সমস্যা হয় না।
নগরীর সিটি গার্লস্ স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহ মো. জিয়াউর রহমান স্বাধীন বলেন, স্কুলে শিক্ষার্থীদের ৭৫ শতাংশ পুষ্টিহীনতায় ভোগে। বিভিন্ন সময় তিনি এ ধরনের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলেছেন। কিন্তু পারিবারিক দারিদ্রতা আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এর জন্য দায়ি। এর কারণে স্কুলে উপস্থিতিও হ্রাস পাচ্ছে। এমনকি গত রোববার দশম শ্রেণির কোন শিক্ষার্থীই উপস্থিত হয়নি। তবে কমিউনিটিভিত্তিক সচেতন করা গেলে এ সমস্যা সমাধান করা যায়। তারপরেও তিনি এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।