শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

অরক্ষিত উপকূলবাসীর টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি ২৭বছরেও উপেক্ষিত

শাহজালাল শাহেদ, কক্সবাজার : আজ ভয়াল ২৯এপ্রিল। শোককে শক্তিতে পরিণত করার কথা ভাবতে ভাবতে পূর্ণ হলো ২৭টি বছর। এইদিনে শোকাতুর মানুষগুলো স্বজন হারানোর বেদনায় ঢুকরে কাঁদে আর চোখের জলে বুক ভাসায়। দুঃসহ স্মৃতি চোখের জলে ভাসলেই গা আঁতকে উঠে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের লোমগুলো শিউরে উঠে এখনও। সেই জলে ভেসে থাকা দাগ না কাটা উপকূলবাসী এখনও অরক্ষিত। টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি জানিয়ে আসছে তখন থেকে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব দাবি উপেক্ষিত হচ্ছে বরাবরই। মানুষগুলো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সাথে অরক্ষিত ভাবে বসবাস করছে সেখানে।
তাই উপকূলবাসীর একটাই আবেদন, যে করেই হোক সরকারের সহযোগিতায় সংশ্লিষ্ট মহল চতুরপাশে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় যেনো এগিয়ে আসেন। এমনটাই প্রত্যাশা দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে স্মৃতি বয়ে বেড়ানো শোকাহত মানুষগুলোর।
সূত্রমতে, কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, ধলঘাটা, কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি, চকরিয়া, পেকুয়া, চট্টগ্রামে বাঁশখালী, সন্দ্বীপসহ উপকূলীয় এলাকা ২৯এপ্রিল ৯১এর ঘুর্ণিঝড়ে ল-ভ- যায়। সীমানা চিহ্ন পর্যন্ত মুছে গিয়েছে এ প্রলয়ংকরীতে। লাশ আর লাশে দেখা মিলেছে এ মাঠ থেকে ও মাঠে। পরিণত হয়েছে এক ধংসস্তুপে। যেখানে মানুষের ঠাঁই বলতেই কোন কিছু ছিলনা।
ল-ভ- ধ্বংসজজ্ঞের ছবি ও সংবাদ সংগ্রহে এসেছিল দেশি সাংবাদিকদের পাশাপাশি বিদেশী গণমাধ্যমের সাংবাদিকগণও এমনটি জানিয়েছেন কক্সবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক কামাল হোসেন আজাদ। তিনি ঘুর্ণিঝড় পরবর্তী ধ্বংসজজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে প্রতিবেদককে বলেন, সেদিন ভাগ্যানুক্রমে অল্প সংখ্যক বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো কার বাড়ির ভিটে কোনটা- সেই সীমানা চিহ্ন নির্ধারণ করাটাও মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। এমনকি বহু মানুষের গায়ে ঠিকমতো কাপড়ও ছিলনা। লাশের খোঁজ মেলাতে গিয়ে স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছিল সেখানকার। দুর্গত মানুষের বরাত দিয়ে তিনি জানান, অনেকে প্রাণে বেঁচেছিল গাছের সাথে বাদুর ঝোলা করে থাকা নারীদের চুল ধরে।   
চকরিয়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকদলের সাধারণ সম্পাদক ও বর্গাচাষি সমিতির নেতা মো. মহিউদ্দিন পুতু প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ১৯৯১ সালের ২৯এপ্রিলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ভাই প্রকৃতির দান একটি কুকুরের পূর্ভাবাসে আমি আর আমার পিতা বেঁচে গিয়েছিলাম। আমি ঘূর্ণিঝড়ের আগেরদিন চিংড়ী প্রজেক্টে গিয়েছিলাম। তখন আসরের নামাজের ওয়াক্ত হয়েছে। আমি যখন প্রজেক্টে পৌঁছি, তখন আমার আব্বা ছিরিম (বাইন) মাছ ধরার জন্য একটি পুটলিতে করে ছাই মজুদ করতেছিল। বাসার কুকুর আব্বার পিছু নিয়ে আশেপাশে ঘুরতেছিল। আব্বা বলতে লাগল কুকুরকে উদ্দেশ্য করে, আমার গায়ে বাজিসনা (লাগিসনা) আমার অজু আছে আমি নামাজ পড়বো। আব্বা আমাকে বলল, বাসায় ডেকসিতে কিছু ভাত আছে এগুলো কুকুরকে এনে দাও। আমি এনে দিলাম। তারপর আমি দেখতেছি কুকুর ভাত না খেয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। আমি গলা বড় করে শাসনের সুরে বলতে লাগলাম; এই কুকুর ভাত না খেয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?। আব্বা নামাজ পড়ে উঠে আমাকে বলল কুকুর ভাত কোথায় নিয়ে যাচ্ছে দেখ। আমি কুকুরের পিছু নিলাম; দেখতেছি কুকুর গেওয়া গাছের নিচে গর্ত করে ভাত লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে! এটা আমি আব্বাকে গিয়ে বললাম। আব্বা আমার কাছে প্রশ্ন করল এখন কয় নাম্বার সিগন্যাল?। আমি বলেছিলাম মনে হয় ৫নং মহাবিপদ সংকেত চলছে। আব্বা বলতে লাগলো এই ঘূর্ণিঝড় অবশ্যই হবে কারণ কুকুর যখন বিপদ দেখে খাদ্য মজুদ করতেছে! বিলম্ব না করে আমি সকালে বাড়িতে এসে পৌঁছি! আব্বা বদরখালীর পাশে ফিশারী অফিসে চলে গিয়েছিল অন্য সবাইকে ডেকে নিয়ে।
উপকূলীয় জনপদ মহেশখালী ধলঘাটার বাসিন্দা জনৈক নেসার আহমদ বলেন, আমি আমার মা, বোন, ভাবি, ভাগিনা এবং ভাতিজাসহ পরিবারের সাতজনকে হারিয়েছি।
চকরিয়া আনওয়ারুল উলুম কামিল মাদরাসার অফিস সহকারী মাওলানা নোমান শিবলী, আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তা অবর্ণনীয়। যা বলে শেষ করা যাবেনা। এক দুঃসহ স্মৃতির নাম ২৯এপ্রিল।
কক্সবাজার সদরের ঘোনারপাড়া কলেজের দক্ষিণপাশে ১১বছর বয়সের (ঘূর্ণিঝড়কালীণ বয়স) হাসনা হেনা সিকদার বলেন, আমি ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে একটি মসজিদের ছাদের উপর ওঠে গিয়েছিলাম, সকাল বেলায় দেখি আমাদের ঘর ভেঙে তছনছ হয়ে যায় এবং মুরগ-মুরগী সব মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। পড়ে আছে গাছের বড় বড় ডালপালা। তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না, অনেক ক্ষতি হয়েছিলো। হ্যাঁ এক পরিবারের তিন সদস্য মাটির দেওয়াল চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। আমি তখন ছোট ছিলাম, চোখের জল ফেলা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিলো না। বাড়ির লোকজন সবাই মিলে ঘরবাড়ি মেরামত করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাও দেখেছিলাম প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে।
চকরিয়া উন্নয়ন ফোরামের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান চৌধুরী মানিক বলেন, একান্নব্বইর ঘূর্ণিঝড় ভুলার মতো নয়। সেইদিন মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে। বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি ছিলো দুর্ভিক্ষের মতো। আজকের এইদিনে স্বজন হারানো মানুষগুলোর জন্য সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। একইভাবে সেইদিন নিহত স্বজনদের মাগফিরাত কামনা করছি। 
এদিকে প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড় ১৯৯১ এর ২৯এপ্রিল চকরিয়া-পেকুয়াসহ উপকূলীয় জনপদে মর্মান্তিকভাবে প্রাণহাণির ঘটনায় নিহতদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জননেতা আলহাজ্ব জাফর আলম বি.এ (অনার্স) এম.এ। তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে তিনি আজকের এইদিনে শোকাহত পরিবারের প্রতিও গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। মহান আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য সেই শোক সইবার ধৈর্য্য কামনা করেন।
অন্যদিকে দিবসটিকে কেন্দ্র করে উপকূলীয় জনপদের ঘূর্ণি আক্রান্ত বাসিন্দারা বিভিন্ন ব্যানারে নানান কর্মসূচি পালন করবে বলে জানা গেছে। তৎমধ্যে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, শোক র‌্যালি, এতিমদের মাঝে খাবার বিতরণ ও স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা সভা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ