মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারকেই সমাধান করতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার : নাইক্ষ্যংছড়ির কোনারপাড়ার শূন্য রেখায় এবং উখিয়ার কুতুপালংয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখে, তাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শুনে গেলেন বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা। তারা বললেন, সঙ্কটের মাত্রা খুবই ভয়াবহ, কিন্তু রাতারাতি এই সঙ্কটের সমাধান করে ফেলা সম্ভব নয়। তবে তারা নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা করে সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সমাধানটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন, এই সঙ্কট থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবেন না- সেই প্রতিশ্রুতি তারা দিয়ে গেলেন।
তারা বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে এসেছে, তাই যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা মিয়ানমারকেই সমাধান করতে হবে। তাদের ভাষ্য, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফেরত যেতে ও নিরাপদ জীবন দিতে হবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় কিছু সময় লাগতে পারে।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ব্রিফিংয়ে এই প্রতিনিধি দলের প্রধান জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের চলতি অধিবেশনের সভাপতি পেরুর প্রতিনিধি গুস্তাবো আদোলফো মেসা কুয়াদ্রা ভেলাসকাস বলেন, সমস্যা কতটা গভীর তা বুঝতেই আমাদের এ সফর। আমরা ক্যাম্প ঘুরে দেখেছি, মানুষের সাথে কথা বলেছি, পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি বাস্তব ধারণা পেয়েছি।
গতকাল রোববার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল। সেখানে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখার পর সাংবাদিক সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি কারেন পিয়ার্স বলেন, আমরা এখান থেকে মিয়ানমারে যাবো। তাদের কাছ থেকে শুনতে চাইবো, সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হতে পারে তারা। এদিকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আমরা নিরাপত্তা পরিষদে সমর্থন দেওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবো ও রোহিঙ্গাদের উপকারে আসে এমন সিদ্ধান্ত নেবো।
কুয়েতের প্রতিনিধি মনসুর আল উতাইবি আশ্বাস দিলেন, আমরা এখান থেকে মিয়ানমারে যাবো ও সেখান থেকে নিউইয়র্কে ফিরে বিষয়টি নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচনা করবো। তবে আমরা এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না যে, আমরা দ্রুত কোনও ব্যবস্থা নেবো।
 রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি সরাসরি দেখতে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য দেশের প্রতিনিধিরাসহ মোট ৪০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল শনিবার বিকালে কক্সবাজার পৌঁছায়। তবে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচ দেশের মধ্যে কেবল যুক্তরাজ্যই তাদের স্থায়ী প্রতিনিধিকে এই সফরে পাঠিয়েছে, বাকি চার দেশ পাঠিয়েছে উপ প্রতিনিধিকে।
গতকাল সকালে তারা প্রথমে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রুর কোনারপাড়ায় সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ঘুরে দেখেন। সেখানে তারা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেন, তাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এক ঘণ্টার বেশি সময় সেখানে কাটিয়ে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা যান উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেখানে তারা ইউএনএইচসিআর, আইওএমসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যক্রম ঘুরে দেখেন এবং তাদের  প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের মতামত শোনেন।
রাশিয়ার উপ স্থায়ী প্রতিনিধি দিমিত্রি পোলিয়ানস্কি বলেন, সিকিউরিটি কাউন্সিলের ওপর অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু আমাদের হাতে কোনো ম্যাজিক সলিউশন নেই। আমরা সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সমাধানটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। সেজন্যই বাংলাদেশে এখানে এবং মিয়ানমারের পরিস্থিতি আসলে কেমন, তা দেখা আমাদের জন্য জরুরি ছিল। রাশিয়ার প্রতিনিধি বলেন,আমরা এখনও দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে এই সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী। আমরা দুই দেশের সরকারকেই বোঝাতে চেষ্টা করছি যেন তারা গঠনমূলক আলোচনা চালিয়ে যায়। আর আমরাও নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা করে সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সমাধানটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। তিনি বলেন, কিছু কিছু সময় থাকে যখন সঙ্কটের কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তারা একটি ‘ভালো’ সমাধান খুঁজে বের করতে চান, যা ‘সবার কাছে গ্রহণযাগ্য’ হবে।
নিরাপত্তা পরিষদে চীনের উপ স্থায়ী প্রতিনিধি উ হাইতাও বলেন, আমরা এখনই কোনো সমাধান বা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেওয়ার জন্য হয়ত প্রস্তুত নই। আমি বলতে চাই, এখানে এসে, ক্যাম্প পরিদর্শনের মধ্যে দিয়ে, কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে আমাদের মিশন শুরু হল। যে পরিমাণ সাংবাদিক এখানে আছেন, তাতে স্পষ্ট যে বিষয়টি মিডিয়ার কতটা মনোযোগে আছে। তিনি বলেন, আমি বলতে চাই, আমরা এখানে প্রমোদ ভ্রমণে বা ছুটি কাটাতে আসিনি। আমরা এখানে এসেছি কারণ এটাকে আমরা গুরুতর সঙ্কট বলে মনে করছি এবং সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছি। সুতরাং আজই আপনারা আমাদের কাছে কোনো একটি সিদ্ধান্তের আশা করবেন না। আমরা প্রতিশ্রুতি দিতে চাই, এই সঙ্কট থেকে আমরা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেব না।
এই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ব্রিফিংয়ে বলেন, কিছু বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সব দেশের একমত হতে হয়ত সময় লাগবে। তবে এ সমস্যার সমাধান যে দ্রুত করা উচিৎ,এ সমসার সমাধান যে মিয়ানমারেই নিহিত আছে, এই সমস্যার জন্য দায়ী না হয়েও বাংলাদেশকে যে ভুগতে হচ্ছে, সেজন্য বাংলাদেশের পাশে থাকা- এসব বিষয়ে তারা সবাই একমত। তিনি বলেন, যে বিষয়টিতে অনেকে একমত নন, তা হল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরও শক্ত কোনো পদক্ষেপের ক্ষেত্রে। অনেকে মনে করতে পারেন এটা কালকে হওয়া উচিৎ, অনেকে মনে করতে পারেন, আরও কিছুদিন চেষ্টা করে তারপর হওয়া উচিৎ, অনেকে মনে করতে পারেন- না এটা কোনো সামাধান বয়ে আনবে না। কিন্তু দোষটা যে মিয়ানমারের, সমাধান যে মিয়ানমারকে করতে হবে, সে বিষয়ে সকলেই একমত।
রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে দু’দিনের সফরে শনিবার বিকেলে কুয়েত এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে ইরাক থেকে সরাসরি কক্সবাজারে আসেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলটি। কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে দলটি উখিয়ার ইনানীর রয়েল টিউলিপ হোটেলে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, শরণার্থী সচিব আবুল কালাম, চট্টগ্রামের রেঞ্জের ডি আইজি এ এইচ এম মনিরুজ্জামান, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, জেলা পুলিশ সুপার ড. একে ইকবাল হোসেন, উখিয়া সার্কেল চাই লাউ মারমা, উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান, উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি একরামুল ছিদ্দিক ও উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ছিলেন।
গতকাল সকালে জিরো পয়েন্ট সীমান্তে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের দেখতে যান তারা। এরপর যান কুতুপালং ক্যাম্পে। সেখানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের দুটি প্রেজেন্টেশন দেখানো হয়। এরপর তারা রোহিঙ্গাদের কথা শোনেন। তবে সেখানে কোনও সরকারি কর্মকর্তারা ছিলেন না। আজ সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর মিয়ানমারের উদ্দেশে রওনা দেবেন তারা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ