শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ইসলামের শোষণমুক্ত শ্রমনীতি ও মেহনতী মানুষের মুক্তি

জিয়া হাবীব আহসান : বিশ্ব তখন শোষণমুক্ত শ্রমনীতির সরব স্লোগানে মুখরিত। ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে অসংখ্য শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে আমেরিকার শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেট। তখন থেকে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ প্রতি বছরের ১লা মে পালিত হয় যথাযোগ্য মর্যাদায়। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের সমস্যা নিরসনে জাতিসংঘের অধীনে একটি বিশেষ সংস্থা রয়েছে। সংস্থাটির নাম আই.এল.ও. বা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। এ সংস্থা শ্রমজীবী জনতার নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিতকরণে বিশ্বরাষ্ট্রসমূহকে গাইড লাইন ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে। জাতিসংঘ সনদের আলোকে প্রতিটি দেশের সংবিধানে শ্রমিকের অধিকার স্বীকৃত। এতে শ্রমিক শোষণ ও নিপীড়ন বন্ধে রয়েছে অসংখ্য আইন ও প্রবিধান। কিন্তু সভ্যতার দাবিদার আধুনিক বিশ্ব কি বাস্তবে আদৌ পেরেছে পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে?
মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা আজ তৃতীয় বিশ্বের দুঃখী দরিদ্র মানুষের শ্রমকে অহরহ শোষণ করে সম্পদের অঢেল পাহাড়কে করে তুলেছে আরো সমৃদ্ধ। যে গার্মেন্টস শ্রমিক কোটি কোটি মানুষের বস্ত্র তৈরী করে উন্নত বিশ্বে প্রেরণ করছে তার স্ত্রী ও সন্তানের দেহে কোন বস্ত্র নেই। যে শ্রমিক বহুজাতিক কো¤পানিতে কোটি কোটি মানুষের জন্য ওষুধ তৈরী করছে তার মৃত্যুর সময় মুখে দেওয়ার মতো ওষুধ পায় না, খাদ্যের অভাবে বিরাট বিরাট অট্টালিকায় শ্রমিকের হাড় ও মাংস একাকার হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সভ্যতার চরম উন্নতির এ যুগে সর্বত্রই মেহনতি মানুষগুলো লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, শোষিত ও অবহেলিত। পুঁজিবাদের সমর্থক ম্যানডেভিল তার বই “ফিবল অব দি বিজ” গ্রন্থে লিখেছেন, “গরীব ও অসহায় লোকদের থেকে কাজ নেয়ার একমাত্র উপায় হলো তাদেরকে গরীব থাকতে দাও এবং সব সময় তাদেরকে পরনির্ভরশীল করে রাখ। এদের যা প্রয়োজন তা কিঞ্চিত পূরণ কর। খেটে খাওয়া (শ্রমজীবী) মানুষকে স্বাবলম্বী করা আত্মঘাতী পদক্ষেপ বৈ কিছুই নয়।” এ জন্যে সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী বিশ্ব চায় না আমাদের মতো দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাবলম্বী হোক। তারা আজ স্বল্প মূল্যে আমাদের নারীশ্রম, শিশুশ্রম সব কিছুই শোষণ করছে। আধুনিক বিশ্ব যখন শ্রমিকের শ্রমকে পণ্যের সাথে তুলনা করছে তার শত শত বছর পূর্বে ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উৎপাদিত পণ্যে শ্রমিকের অংশীদারিত্বের কথা বলেছেন। দুনিয়ার কোন অঞ্চলে যখন শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা একেবারে অংকুরে ঠিক তখনই বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সাঃ) এর প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গড়ে-ওঠা ইসলামী রাষ্ট্রে নারী, পুরুষ, শ্রমিক, মেহনতী জনতা নির্বিশেষে সকল মানুষ মৌলিক অধিকার পূর্ণভাবে ভোগ করে ধন্য হয়েছিল।
আধুনিক মানবাধিকার-এর ধারণা পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ (ইউএন) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কিন্তু এর ১৩০০ বছর পূর্বে অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীতে মহাবিশ্বের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মানবাধিকারের সু¯পষ্ট ঘোষণা প্রদান করেন যা তিনি কথায় ও কাজে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে জীবন্ত নজির হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়েছিলেন তিনি। আল্লাহর নবী নিজেও শ্রমিক ছিলেন। তিনি বলেন, “আমি এক কিরাত মজুরিতে মক্কাবাসীদের বকরী চরাতাম”(বুখারী)। তিনি খেজুরের বিনিময়ে কূপের পানি উত্তোলনের কাজ করেছেন। অন্যের ক্ষেতে পানি ঢেলেছেন। মদিনার শাসক হওয়ার পরও সারা জীবন তিনি শ্রমজীবী মানুষদের কাতারে থেকে গেছেন। এজন্যে একজন শ্রমিকের দুঃখ তিনি ছাড়া আর কোন অশ্রমিক আইন প্রণেতার বেশি  বোঝার কথা নয়।
জঘন্য দাস প্রথার অবসানে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) : মহানবী (সাঃ) জঘন্য দাস প্রথাকে নিষিদ্ধ করে সুষ্ঠুভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, “তিন ধরনের লোক আছে তাদের বিরুদ্ধে আমি শেষ বিচারের দিন অভিযোগ উত্থাপন করব। একজন সে ব্যক্তি যে মুক্ত মানুষকে দাসে পরিণত করে। আরেকজন সে ব্যক্তি যে তাকে (মুক্ত মানুষকে) বিক্রয় করে এবং অন্যজন সে ব্যক্তি যে অর্থ খায়।” দাস প্রথার বিলোপ সাধনে মহানবী (সাঃ) এর নীতিমালা নিম্নরূপ :
মহানবী (সাঃ) তথা ইসলামের আদর্শ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-
১। ইসলাম দাসদের মুক্ত করার জন্য উৎসাহিত করে দাস সমস্যার সমাধান করতে বাস্তব আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছে।
উপায় হিসেবে দাসের মুক্তি দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে।
৩। স্বীয় মুক্তচিন্তার মাধ্যমে দাসকে মুক্ত করে দেয়াকে মহাপুণ্যের কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কতিপয় নজির নিম্নরূপ :
১) রাসুল (সাঃ) একাই ৬৩ জন দাসকে মুক্তি দেন। ২) রাসুল (সাঃ) এর স্ত্রী হযরত বিবি আয়েশা (রাঃ) ৬৭ জন দাসকে মুক্তি দেন। ৩) খলিফাতুল মুসলেমিন হযরত উমর (রাঃ) এক হাজার দাস ক্রয় করে তাদের মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ৪) আবদুর রহমান (রাঃ) ত্রিশ হাজার দাস ক্রয় করে তাদের মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
এভাবে ইসলাম প্রচারের ৩০/৪০ বছরের মধ্যে আরবের দাস সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। রাসুল (সাঃ) শুধু ঘোষণা করে ক্ষান্ত হননি, তিনি আবিসিনিয়ার ক্রীতদাস হযরত বিলাল (রাঃ)  কে মসজিদে নববীর মহাসম্মানিত মুয়াজ্জিন বানিয়েছিলেন এবং ক্রীতদাস জায়েদকে আপন ফুফাত বোন জয়নব -এর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন।
ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকদের মর্যাদা এবং মহানবী (সাঃ) এর শোষণমুক্ত শ্রমনীতির স্বরূপ :
মহানবী (সাঃ) এর ইসলামী রাষ্ট্রের নীতি ছিল শ্রমিক, চাষি এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে কেউ বিনা পারিশ্রমিকে খাটাতে পারবে না। তাদের ন্যায়-সঙ্গত পারিতোষিক দিতেই হবে। ইসলামই কেবল মানুষের কাজ করার অধিকার-এর সাথে সাথে শ্রমিকের মর্যাদাকেও স্বীকৃতি প্রদান করে। মহানবী (সাঃ) এর সামাজিক রীতি অনুযায়ী মানুষের পদমর্যাদা তার পেশার উপর নির্ভর করে না বরং তার ব্যক্তিগত গুণাবলী এবং সামাজিক কল্যাণে তার অবদানের উপর নির্ভর করে। ইসলামের দৃষ্টিতে একজন সৎ ও দক্ষ মুচি, একজন অসৎ ও অদক্ষ সুলতান হতেও উত্তম।
ইসলামে সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তি মহানবী (সাঃ) তাঁর আচরণের মাধ্যমে শ্রমের মর্যাদাকে অতি উচ্চে স্থাপন দিয়েছেন। তাঁকে অনেক সময় দেখা যেত যে, তিনি মজুরীর বিনিময়ে পানি টানছেন বা নিজের জুতা মেরামত করছেন। পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহকারী ব্যক্তিকে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) আল্লাহর বন্ধু বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, “শ্রমজীবীর উপার্জনই উৎকৃষ্টতর যদি সে সৎ উপার্জনশীল হয়।” তিনি আরো বলেছেন, “আল্লাহ তাঁর ঐ বান্দাকে দেখতে অপছন্দ করেন, যে ইহকালের ও পরকালের কর্ম থেকে বিমুখ” (মিশকাত)। আল্লাহর নবী ইসলামে শ্রমিকদের মর্যাদা প্রসঙ্গে বলেছেন, “ইসলামের সকল নবীই শ্রমিক তথা শ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। হযরত দাউদ (আঃ) কর্মকার ছিলেন। হযরত আদম (আঃ) কৃষক ছিলেন, হযরত নূহ (আঃ) সুতার ছিলেন, হযরত ইদ্রিস (আঃ) দর্জি ছিলেন এবং হযরত মুসা (আঃ) ছাগল চড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।” এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা কোন পর্যায়ে। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন মজুরও পরে রাষ্ট্রীয় কর্ণধার পর্যন্ত হতে পারেন।
শ্রমিকের পেশা গ্রহণের স্বাধীনতা : ইসলাম কায়িক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় শ্রমের মর্যাদা দিয়েছে এবং শ্রমিকের কর্মদক্ষতা বাড়াতে তাদেরকে পেশা গ্রহণের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। নবী (সাঃ) এর ফরমান, “সমস্ত দেশ ও জমিন আল্লাহর, আর সমস্ত মানুষ আল্লাহর বান্দা। তাই যেখানেই তুমি মঙ্গলজনক মনে কর সেখানেই বাস কর” (আল হাদিস)।
উপার্জনে নারী-পুরুষের অধিকার : ইসলাম উপার্জনে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রদান করেছে। নারীরা যা উপার্জন করবে তারাই তার মালিক হবে। তাদের অনুমতি ও সম্মতি ব্যতীত তাদের স¤পদে হস্তক্ষেপ করার অধিকার পুরুষের নেই। তবে সামাজিক অনাচার রোধে নারী ও পুরুষের আলাদা কর্মক্ষেত্রের কথা বলেছে ইসলাম। নারীদেরকে আধুনিক বিশ্ব যেভাবে পণ্যের মতো ব্যবহার করছে ও পশুর মতো খাটাচ্ছে ইসলাম তা সমর্থন করে না। ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে ওয়ার্কস ডেলিগেশনের সদস্য ব্রজকিশোরী শাস্ত্রী চীন সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, “ওখানে হালের বলদের পরিবর্তে নারীদের বাঁধা থাকার মতো মর্মান্তিক ও অসামাজিক দৃশ্য দেখেছি।” স্বীয় স্ত্রী দূরে কাজ করছে, যাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে না রাশিয়ায় এমন শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। [চলবে]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ