শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং টিআইবির দাবি

গতকাল ৩ মে ছিল বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যম দিবস। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন- বিএফইউজেসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান সেমিনার ও সমাবেশের আয়োজন করেছে। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই আলোচকরা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে দেশের কোনো গণমাধ্যমই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে দৈনিক আমার দেশ এবং দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও। দাবি উঠেছে নিষিদ্ধ ও বন্ধ করে দেয়া সকল গণমাধ্যম খুলে দেয়ার জন্য। বেকার ও চাকরিচ্যুত সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের অবিলম্বে চাকরি দেয়ার পদক্ষেপ নেয়ার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। 

ওদিকে বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যম দিবস তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকেন্দ্রিক দিবসের প্রাক্কালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশÑ টিআইবির একটি বিবৃতিও আলোচিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। আগেরদিন বুধবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে প্রাধান্যে এনে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা সংশোধন এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, মুক্ত পরিবেশে বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার বাধাহীন রাখার স্বার্থে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮,২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৮ ধারাগুলোকে পুনর্বিবেচনা করে সংশোধন করা দরকার। একই সাথে দরকার তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করাও। 

এ ব্যাপারে অংশিজনদের তথা গণমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের দাবি ও সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংসদীয় কমিটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেছেন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত আইনটি সব নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সাংবিধানিক অঙ্গিকার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। চূড়ান্তভাবে প্রণীত হলে এবং জাতীয় সংসদে পাস করা হলে আইনটি গণমাধ্যমকর্মীদের পাশাপাশি সব নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার চর্চার ক্ষেত্রে অধিকতর নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। সংবিধানে মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা দেয়া রয়েছে সে স্বাধীনতা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার কাছে অসহায় হয়ে পড়বে। 

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেছেন, সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত নয়টি ধারা সংশোধন না করা হলে দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। এ আইনের ফলে বিভিন্ন রকমের অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ ক্ষমতা অপব্যবহারের বিষয়ে তথ্য ও খবর প্রকাশ করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে। দোষী ও দুর্নীতিবাজরা আইনের আড়ালে ছাড় পেয়ে যাবে বলে সব ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপরাধের ব্যাপক বিস্তার ঘটতে থাকবে। পরিণতিতে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে দুর্নীতির প্রতিরোধ এবং সুশাসন নিশ্চিত করার যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে তা বাধাগ্রস্ত ও নস্যাৎ হবে। এসব সম্ভাবনা ও আশংকার কারণেই উল্লেখিত ধারাগুলো সংশোধন করা এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করা দরকার বলে বিবৃতিতে মতপ্রকাশ করেছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। 

আমরা টিআইবির নির্বাহী পরিচালকের বক্তব্য, ব্যাখ্যা, দাবি ও পরামর্শের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি এবং এসব দাবি ও পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। বলা দরকার, প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তো বটেই, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বিরুদ্ধেও শুরু থেকেই বক্তব্য এসেছে। সাংবাদিকসহ গণমাধ্যমকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশও কম করেননি। অন্যদিকে সরকার এগিয়েছে নিজেদের ইচ্ছামতো। এ দুটি আইন বিরোধী আন্দোলনের মুখে সরকারের পক্ষ থেকে কখনো কখনো সম্পাদক পরিষদ এবং সরকারপন্থী সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও আয়োজিত হয়েছে। কিন্তু কোনো উপলক্ষেই সম্পূর্ণরূপে দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়া বা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। 

সর্বশেষ উপলক্ষেও ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছেন, সাংবাদিকদের দমনের জন্য নয় বরং ডিজিটাল অপরাধ দমন ও প্রতিহত করার উদ্দেশ্যেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করা হচ্ছে। চমৎকার একটি ব্যাখ্যাও শুনিয়েছেন মন্ত্রী। গণমাধ্যমে বুধবার প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, দেশ যতো ডিজিটাল হচ্ছে, ডিজিটাল অপরাধও ততোই বাড়ছে। এজন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জরুরি হয়ে পড়েছে।

আমরা কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ না করে পারি না। কারণ, অপরাধ যতো ডিজিটালই হোক না কেন, সেগুলোকে ডিজিটাল পন্থাতেই চিহ্নিত করা সম্ভব। একইভাবে সম্ভব অপরাধীদের চিহ্নিত করে খুঁজে বের করা এবং আইনত শাস্তি দেয়াও। এজন্য দরকার আসলে সরকারের সদিচ্ছার। কারণ, ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম, খুন, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মতো সকল অপরাধের শাস্তিই প্রচলিত বিভিন্ন আইনে দেয়া সম্ভব। অন্যদিকে সরকার এগোচ্ছে আইনের আড়ালে এমন কিছু কঠিন ধারা-উপধারা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে, যার ফলে বিশেষ করে বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়সহ সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধেই কোনো তথ্য বা রিপোর্ট প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। ক্ষমতাসীনরাও থাকবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে অনেক ঘটনার কথাই জানা গেছে। কোনো কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে রিপোর্ট করার কারণে এমনকি মফস্বল এলাকার সাংবাদিকদেরও কয়েক মাস পর্যন্ত বিনাবিচারে হাজত খাটতে হয়েছে। এখনো অনেক সাংবাদিক কারাগারে রয়েছেন। 

এ ধরনের সম্ভাবনা ও আশংকার কারণেই টিআইবি যেমন দাবি জানিয়েছে, তেমনি দাবি উঠেছে সাংবাদিক ইউনিয়নসহ গণমাধ্যম কর্মীদের পক্ষ থেকেও। আমরাও মনে করি, আইনের আড়ালে অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার পরিবর্তে মতপ্রকাশ ও জনগণকে সঠিক তথ্য জানানোর সাংবিধানিক অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্যই সরকারের উচিত সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ