শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ইন্টারনাল ইস্যুর কারণে সার্ককে অকার্যকর দেখতে চায় না পাকিস্তান

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, পাকিস্তান থেকে ফিরে : [ কিস্তি-২ ]
নিজেদের ইন্টারনাল ইস্যুর কারণে সার্ককে (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) অকার্যকর দেখতে চায়না পাকিস্তান। দেশটির মতে, ইন্টারনাল সমস্যার কারণে সার্ক এখন অকেজো। এটি এখন একটি ‘ডেড’ বডি। এর পেছনে ভারতকে অনেকাংশে দায়ী করেছে পাকিস্তান। তারা সার্ককে গতিশীল করতে চীনকে অন্তভূক্ত করার পক্ষে। সম্প্রতি পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া একটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে এসব কথা বলেন দেশটির নীতিনির্ধারকরা।
অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার পর দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) এখন অস্তিত্ব সংকটে। সন্দেহ, অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার কারণে দেশগুলোর মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা কতটা গড়ে উঠবে তা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিষ্ঠার ৩৩ বছরে এসে এই অবস্থা। ২০১৬ সালের ৯ ও ১০ নভেম্বর পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি স্থগিতই আছে।  কারণ ভারত, ভুটান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ একযোগে ওই সম্মেলনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অবশ্য সম্মেলন স্থগিত হওয়া ও অস্তিত্ব সংকটের মতো পরিস্থিতি সার্কের ইতিহাসে নতুন নয়। তখন ভারত জানিয়েছিল, আন্তঃসীমান্ত অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধি ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সহায়ক নয়। ভুটান জানিয়েছে, আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ বেড়ে যাওয়ার ফলে সার্ক সম্মেলন সফলভাবে করার মতো পরিবেশ রয়েছে কিনা সে ব্যাপারে শঙ্কা থাকার কারণে ১৯তম সম্মেলন বর্জন করা হচ্ছে। আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশটিতে আরোপিত সন্ত্রাসবাদের কারণে সহিংসতা ও লড়াইয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি ও কমান্ডার ইন চিফকে সে পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। তাই আফগানিস্তান সম্মেলনে যোগ দিতে পারছে না। বাংলাদেশ বলেছে, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে তাই তারা সম্মেলনে অংশ নেবেনা। সে সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছিলেন, সার্কের প্রতিষ্ঠাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতা, কানেকটিভিটি ও সার্বিক সহযোগিতার বিষয়টি বিশ্বাস করে। সময় ও সুযোগ যখন আসবে বাংলাদেশ তখন সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবে। বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে অন্য কোনো রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও পাকিস্তান বারবার বলছে, তারা আঞ্চলিক সহযোগিতা ও শান্তি রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। এ অঞ্চলের মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে দেশটি কাজ করার বিষয়ে অঙ্গিকারবদ্ধ। উল্লেখ্য সার্কের নীতি হচ্ছে, একটি দেশ সম্মেলন বর্জন করলে তা বাতিল হয়ে যায়। অতীতেও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে সার্ক সম্মেলন বাতিল হয়েছিল।
গত ১৯ মার্চ দশ সদস্যের একটি মিডিয়া প্রতিনিধি দল পাকিস্তানে যায়। দলটি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের গভর্নর, পররাষ্ট্র সচিব, এডিশনাল তথ্য সচিব, এডিটরসহ বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষের সাথে বৈঠক করে। আট দিনের এই সফরে সাংবাদিক প্রতিনিধি দলকে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র, ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দেখানো হয়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্তা ব্যক্তিদের সাথে অনুষ্ঠিত এসব বৈঠকে উঠে আসে দেশটির সমস্যা, সম্ভাবনা, রাজনৈতিক অবস্থা, বিচার বিভাগের অবস্থা, মিডিয়ার স্বাধীনতা কতটুকু, বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অন্যদের সাথে তাদের সম্পর্ক, সার্কের অবস্থা, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মাঝে সম্পর্ক ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশী আলোচনায় আসে সার্ক এবং বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে। আলোচনায় দেশটির নেতৃবৃন্দ সার্ক প্রতিষ্ঠাসহ একে কার্যকর রাখতে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেন। তবে সার্কের বর্তমান অবস্থা নিয়েই তারা বেশী আলোচনা করেন।
২২ মার্চ ইসলামাবাদে সচিবালয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া টিমের সাথে প্রায় দুই ঘন্টা বৈঠক করেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব তাহমিনা জানজুয়া। এসময় তার সাথে দেশটির এডিশনাল ফাস্ট সেক্রেটারি (এশিয়া) ইমতিয়াজ আহমেদসহ বেশ কয়েকজন কর্তা ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।
তাহমিনা জানজুয়া ১৯৮৪ সালে পাকিস্তান পররাষ্ট্র বিভাগে তার চাকুরী জীবন শুরু করেন। তিনি তার দীর্ঘ বক্তব্যে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান পৃথক রাষ্ট্র হয়। এরপর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যদি প্রথমটি না হতো, তাহলে বাংলাদেশও স্বাধীন হতো না। এটাই ইতিহাস। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য পাকিস্তান তার অবস্থা বারবার ব্যাখ্যা করেছে। এখন আমরা অতীত নিয়ে কথা বলতে চাইনা। আমরা ভাগ হলেও একসাথে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে ভালো বুঝাপড়া আছে। ক্রিকেটে দুই দেশ অনেক এগিয়েছে।
বাংলাদেশের অবদানের কথা বলতে গিয়ে তাহমিনা জানজুয়া বলেন, পাকিস্তান ও ভারত পৃথক হবার সময় বাংলাদেশের অনেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই যে সার্ক গঠিত হলো এটাও বাংলাদেশের কনসেপ্ট। প্রথম দিকে এর সফলতা আসলেও দুর্ভাগ্য, ইন্টারনাল ইস্যুর কারণে সার্ক এখন অকেজো। তিনি বলেন, সার্ক কনসেপ্টটা ছিল বাংলাদেশের। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন সার্কের উদ্যোক্তা। প্রথম দিকে সার্কভূক্ত দেশগুলো বেশ ভালোই করছিল। কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনাল ইস্যুর কারণে সার্ক বলতে গেলে অনেকটা অকার্যকর। তিনি বলেন, আমরা চাই সার্ক কার্যকর হোক। সেই সাথে এর ব্যপ্তি বাড়ানো হোক। চীনকে অন্তভূক্ত করলে সার্কের গতি বৃদ্ধি পাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সার্কের গতি বাড়াতে বাংলাদেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বাংলাদেশ সেটি পারছে না। ভারতের নেগেটিভ মনোভাবের কারণে সার্ককে গতিশীল করা যাচ্ছেনা। যদি সার্ক নিয়ে নেগেটিভ মনোভাব পরিহার করে তাহলে আমরা এই অঞ্চলে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারবো। তিনি বলেন, সার্কের সবশেষ সম্মেলনে ভারত যোগ দেয়নি। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে এটির আয়োজক ছিল পাকিস্তান। তাদের অনিহার কারণে অন্যরাও শেষ পর্যন্ত সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে।
চীনের অর্šÍভূক্তির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, চীনকে নিলে কি হবে? আগে সার্ককে কার্যকর করতে হবে। এছাড়া ভারত চায়না চীনের এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হোক। ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ক ততটা ভালো নয়। চীন যদি সার্ক এর সদস্য হয় তাহলে ভারত সেভাবে প্রভাব খাটাতে পারবেনা। কিন্তু আমরা চাই, প্রয়োজনে চীন নিয়ে হলেও একসাথে কাজ করতে।
জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনেক মানুষই আমাদের মতো। যখন একটি ক্রিকেট ম্যাচ থাকে, তখন অনেক দর্শকই পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের সমর্থন করে এবং তাদের পতাকাও উত্তোলন করে। আমাদের শোয়েব আখতারের অনেক সমর্থক আছে। পাকিস্তানের অনেক শিল্পী এখনও বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। একইসাথে বাংলাদেশের অনেকেই এখানে জনপ্রিয়। বিশেষ করে বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন। এসময় তিনি কন্ঠশিল্পী রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিনসহ বেশ কয়েকজনের কথা উল্লেখ করেন।
একইদিন সচিবালয়ে দেশটির তথ্য, সম্প্রচার ও জাতীয় ঐতিহ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাফকাত জলিল মতবিনিময় করেন বাংলাদেশী মিডিয়া টিমের সাথে। তিনি সেন্ট প্লাসিডের উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং স্পষ্টতই তার শৈশব কাটে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। তিনি আলোচনায় চট্টগ্রাামের কিছু স্মৃতির কথা বলেন। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত চট্টগ্রামে লেখাপড়া করেছেন। দেশ স্বাধীনের বছর পরিবারের সদস্যদের সাথে তিনি পাকিস্তানে পাড়ি জমান। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা বেশ ভালো। স্বাধীনতার পরেও তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছেন। আলোচনায় তিনি জানান, পাকিস্তান ইনফরমেশন মন্ত্রণালয় বিপুলসংখ্যক সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন পোর্টালের সাথে কাজ করে। শুধুমাত্র ইসলামাবাদে প্রায় ৯৩ টি বেসরকারী টিভি চ্যানেল, (রাষ্ট্র পরিচালিত পিটিভি ব্যতীত) অপারেটিং হচ্ছে। দেশের পাঁচটি প্রদেশে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা প্রায় ৪১৫ টি। জলিল বাংলাদেশ সরকারের সাথে বাণিজ্য বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়া মেধাবী ছাত্রদের জন্য সুযোগ সুবিধা প্রদান, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া দলের ভিজিটরকে সাহায্য ও সহায়তা প্রদানের কথা বলেন। ভবিষ্যতে সাংবাদিকদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থার উদ্যোগের কথাও জানান তিনি। 
সার্ক নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। এইজন্য যে আমরা সার্ককে কার্যকর করতে পারলাম না। কারণ এখানে কোনো দেশের উপর প্রভাব খাটানোর সুযোগ নেই। সবাই স্বাধীন দেশ। যে যার মত করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখে। সার্ককে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত সবার। এটা তো চাপিয়ে দেয়া যাবেনা।
সার্কের বিষয়ে সিন্ধু প্রদেশের গভর্নর মো: জোবায়ের বলেন, সার্ক কার্যকর থাকলে এর সদস্য দেশ গুলোই লাভবান বেশী হবে। বিশেষ করে ছোটদেশগুলো। কিন্তু এখন কি হচ্ছে। এটা করা হয়েছিল সদস্য দেশগুলোর মাঝে সম্পর্ক উন্নয়ন, বাণিজ্য ঘাটতি দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসার ঘটানো ইত্যাদিও জন্য। কিন্তু এখন অবস্থা এখন এমন যে, সার্ক দেশগুলো তাদের মধ্যে ১%ও ব্যবসা করেনা। এতে করে আমাদেরই ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন, সার্ক এখন একটি ডেড (মৃত) বডিতে পরিণত হয়েছে। কারো কাছেই এর গুরুত্ব আছে বলে মনে হয়না। বিশেষ করে ভারতের কাছে। আমরা তাদের আচরণে হতাশ।
সার্ক নিয়ে হতাশার কথা জানালেন কাউন্সিল অব পাকিস্তান নিউজপেপার ইডিটরস (সিপিএনই) এর মহাসচিব আজিজুল হক। তিনি বলেন, সার্ক ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমানোর জন্যই এটা করা হয়েছিল। কিন্তু সার্ক এখন অকার্যকর।
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) দক্ষিণ এশিয়ার একটি সরকারি সংস্থা। এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান। ২০০৭ সালে আফগানিস্তানকে সার্কের সদস্য পদ দেয়া হয়। গণচীন ও জাপানকে সার্কের পর্যবেক্ষক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। সার্ক ১৯৮৫ সালের ৮ই ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যখন বাংলাদেশ,ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলংকা নেতারা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক,অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতা করার লক্ষ্যে এক রাজকীয় সনদপত্রে আবদ্ধ হন। নেপালের কাঠমান্ডুতে সার্কের সদর দফতর অবস্থিত।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ