বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

দুই যুগেও ফুলতলার রবীন্দ্র কমপ্লেক্স পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি

খুলনা অফিস : খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণদিহি গ্রামে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি। ফুলতলা বাজার থেকে এর দূরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটার। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা দেবীর বাবার বাড়ি এবং মাতামহী দিগম্বরী দেবীর বাড়ি ছিল এ এলাকাতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি ও মামাবাড়ি ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণদিহিতে আর তার পূর্ব-পুরুষরা খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে বিয়ে হয়েছিল ভবতারিনী ওরফে মৃনালিনী দেবীর। মৃনালিনীর বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। আর রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ২২ বছর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন পীরালী বংশের লোক। রবীন্দ্রনাথ বর সেজে দক্ষিণদিহিতে আসেননি এমন জনশ্রুত রয়েছে তবে ভারতের কোলকাতার জোড়া সাঁকোতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। দক্ষিণদিহি গ্রামে রবি ঠাকুরের শ্বশুর ছিলেন বেনী মাধব রায় চৌধুরী। তার পুত্র নগেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ওই বাড়ির দ্বিতল ভবনসহ ৮ দশমিক ৪১ একর জমির মালিক ছিলেন। নগেন্দ্রনাথের দুই ছেলে বীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ও ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ৭ দশমিক ৮ একর জমির স্বত্বাধিকারী হন। পরবর্তীতে দ্বিতল ভবনসহ এই জমি সরকারের অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৯৫ সালে খুলনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হক দক্ষিণদিহিতে রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি দখলমুক্ত এবং সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। ২০০০ সালের ৮ আগস্ট বাড়িটি দায়িত্বভার হস্তান্তর করা হয় প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের ওপর। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর দক্ষিণদিহিতে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্র কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে ৪৯ লাখ টাকা চেয়ে চিঠি দেয়। মন্ত্রণালয় ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। ওই টাকা দিয়ে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভবন সংস্কার, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, বিদ্যুৎ সংযোগ ও অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করে।
এর আগে দ্বিতল ভবনের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয়। সবেদা তলায় নির্মিত হয় মৃণালিনী মঞ্চ। কিন্তু বাড়িটি ঘিরে রবীন্দ্রনাথের কর্মময় জীবনের উপর সংগ্রহশালা কাম লাইব্রেরি, অডিটোরিয়ামসহ রবীন্দ্র চর্চাকেন্দ্র, রেস্ট হাউস নির্মাণের দাবি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। উপেক্ষিত রয়েছে রবীন্দ্র কমপ্লেক্স ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা, পিকনিক স্পট নির্মাণ, কমপ্লেক্সে প্রবেশের তিনটি সড়ক প্রশস্তকরণও। এখানে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে প্রস্তাবিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাখা ক্যাম্পাস বা স্বতন্ত্র ইনিস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশনের নাম পরিবর্তন করে দক্ষিণদিহি রেলস্টেশন এবং খুলনা-বেনাপোলগামী ট্রেনকে মৃণালিনী এক্সপ্রেস নামকরণের দাবিও বাস্তবায়ন হয়নি।
অবশ্য দক্ষিণদিহিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুড়বাড়ি ২০১৫ সালের ১০ মে ‘দক্ষিণদিহি রবীন্দ্র স্মৃতি যাদুঘর’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্ত কুমার পালের রবীন্দ্রজীবনীর বিবরণ অনুযায়ী, ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মৃণালিনী দেবীর বিয়ে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর বেণীমাধব রায় চৌধুরী দেশ ভাগের বহু আগে থেকে কোলকাতায় বসবাস করতেন। তার একমাত্র ছেলে নগেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ওরফে ফেলু বাবু জমিদারি দেখার জন্য মাঝে-মধ্যে দক্ষিণদিহিতে আসতেন। ফেলু বাবুর ছেলেরা তখন কেউ দক্ষিণদিহিতে আবার কেউ কোলকাতায় বসবাস করতেন। ১৯৪০ সালে এ পরিবারের সবাই দেশত্যাগ করেন।
এর আগে ফেলুবাবু ও তার স্ত্রী বাড়িসহ ৭ দশমিক ৮ একর জমি বাদে সব সম্পত্তি দক্ষিণদিহির আরেক জমিদার বিজনকৃষ্ণ দাসকে বন্দোবস্ত দেন। বাড়ি ও সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় নায়েব নবকুমারের ওপর।
১৯৬৫ সালে বিজনকৃষ্ণ দাস দেশ ত্যাগ করেন। পরে নায়েব নবকুমারের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। এ অবস্থায় বেদখল হয়ে যায় বাড়িটি। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে বাড়িটি উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের। দীর্ঘদিন জল্পনা কল্পনার পর অবশেষে ১৯৯৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বাড়িটি অবৈধ দখলমুক্ত হয়। এরপর ফুলতলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মিসেস শামিমা সুলতানা, সহকারী কমিশনার ভূমি অমিতাভ সরকারসহ স্থানীয় চেয়ারম্যান, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের সহায়তায় বাড়িটি দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হকের নেতৃত্বে ফুলতলায় রাজনীতিবিদ, সুধীজন, বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে এক মতবিনিময় সভায় ওই বাড়িটিকে রবীন্দ্র কমপ্লেক্স করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই থেকে কমপ্লেক্স ভবনের উন্নয়নসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। দ্বিতল ভবনের সামনে স্থাপন করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মৃনালীনি দেবীর আবক্ষ মূর্তি। শুধুমাত্র সীমানা প্রাচীরের কাজটি সমাপ্ত হয়েছে। কিছুটা ভারতের শান্তি নিকেতনের আদলে রবীন্দ্র কমপ্লেক্স গড়ে তোলার পরিকল্পনা থাকলেও দুই যুগেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ