শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধ বেড়েছে॥ ঈদের পরে তিন খুনের সঙ্গে জড়িত ১০ কিশোর

নুরুল আমিন মিন্টু, চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধ বেড়েছে। ঈদের পরে দুই দিনে খুন হয়েছে তিনজন। প্রতিটি হত্যাকান্ডের সঙ্গে কিশোর অপরাধীরা জড়িত। এদের পিছনে রয়েছে বড় ভাইরা। তারা আবার সরকার দলীয় নেতা। এসব নেতারা আছেন সরকারি দলের বড় বড় মাপের নেতাদের ছত্রছায়ায়। সরকারি দলের নেতাদের ছত্রছায়ার ফলে কিশোর অপরাধ প্রবনতা বাড়ছে। চুরি, ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনের মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। কিশোরদের অপরাধের নৃশংসতার মাত্রা তাদের মূল্যবোধ এবং মানবিকতাবোধকে নতুন করে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়া কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। নগরীর ১৬ থানা এলাকায় প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং রয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
তবে পুলিশের ভাষ্য, “স্বাভাবিকভাবেই কিশোরদের বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতার অভাব আছে। তারা যে অপরাধ করছে, এই অপরাধের ফলে কী হবে, সেটা তারা চিন্তা করছে না। রাজনৈতিক দলের কথিত ‘বড় ভাইদের’ কথায় অসংখ্য কিশোর অপরাধে জড়িয়ে নিজেদের জীবন নিজেরাই ধ্বংস করে ফেলছে।”
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দরিদ্রতা হলো কিশোর অপরাধের প্রধান কারণ। দরিদ্রতার কারণে কিশোরদের যে চাহিদা বা ইচ্ছে থাকে সেগুলো পূরণ হয় না। এজন্য তারা হতাশ হয়ে যায় এবং অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ‘সঙ্গদোষ’ কিশোর অপরাধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আমরা যাদের সঙ্গে চলাফেরা করি তাদের একটা প্রভাব সবসময় আমাদের মধ্যে থাকে। এখন কোনো কিশোর যখন খারাপ মানুষের সঙ্গে মিশে তখন সঙ্গদোষের কারণে সে অপরাধীতে পরিণত হতে পারে। ওই খারাপ ব্যক্তি কিশোরটিকে আরো খারাপ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়তেও উৎসাহিত করতে পারে।কিশোর অপরাধ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা জানান, স্বাভাবিকভাবেই কিশোরদের বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতার অভাব আছে। তারা যে অপরাধ করছে, এই অপরাধের ফলে কী হবে সেটা তারা চিন্তা করছে না। রাজনৈতিক দলের কথিত ‘বড় ভাইদের’ কথায় অসংখ্য কিশোর অপরাধে জড়িয়ে নিজেদের জীবন নিজেরাই ধ্বংস করে ফেলছে।
বর্তমান প্রজন্মের কিশোরদের নিয়ন্ত্রণ করতে শিক্ষক ও বাবা-মায়েরা ব্যর্থ হচ্ছে মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা স্কুল শিক্ষকদের কড়া শাসনে বেড়ে উঠেছি। আর এখনকার শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের মারবে দূরে থাক, ভয়ে কিছু বলতে পর্যন্ত পারে না। একেকজন কিশোর একেক রাজনৈতিক নেতার অনুসারী দাবি করে দাপিয়ে বেড়ায়। এছাড়া পারিবারিক বন্ধনটা ভালো না হলে একজন কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। পরিবারে তাকে শাসন করার কেউ না থাকলে তখন ওই কিশোরের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। অনেক কিশোর অপরাধী ধরার পর তাদের বাবা-মায়েরা আমাকে বলেছেন, তাদের দোষের কারণে সন্তান অপরাধে পা বাড়িয়েছে। তারা সন্তানের খোঁজ-খবর রাখতেন না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মোবাইল ও ইন্টারনেট-কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখছে বলে ‘স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট খুবই সহজলভ্য হয়ে গেছে। কিশোরদের হাতে হাতে এখন ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে। কিন্তু ইন্টারনেট দিয়ে ভালো ও গঠনমূলক কাজ অনেক সময় করছে না কিশোররা। ইন্টারনেটের অপব্যবহারজনিত কারণে কিশোরদের অপরাধ হচ্ছে অনেক বেশি। ফেসবুকে প্রতারণা করে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায়সহ বহু অপরাধ হচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তাই কিশোরদের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি অভিভাবকদের নজর রাখা উচিত।
সমাজ বিজ্ঞানিরা বলছেন, কিশোরদের মধ্যে স্মার্টফোনের নেশা আছে। এই নেশার ফলে অকালেই তাদের মনের কোণে বাসা বাঁধছে ‘নোমোফোবিয়া’ নামের এক নীরব ঘাতক। এর ক্ষতিকারক প্রভাবে ছোট-বড় সবার মধ্যে অন্য কোনো বাহ্যিক কারণ ছাড়াই অকালে দেদারে বাড়ছে ডিপ্রেশন (অবসাদ), উৎকণ্ঠার (অ্যাংজাইটি) মতো মানসিক রোগ। যার জেরে কিশোরদের মধ্যে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে এই বিষয়ে গবেষণা হয়েছে। তারা বলছে, স্মার্টফোনের নেশা না থাকা স্বাভাবিক কিশোরদের মস্তিষ্কের অ্যান্টেরিয়র সিঙ্গুলেট কর্টেক্সে গাবা এবং জিএলএক্স এর অনুপাত যা থাকে, নোমোফোবিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে তা থাকে কয়েকগুণ বেশি। বাড়তে থাকে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ। গাবার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বাড়ে ঝিমুনি, স্নায়ুবৈকল্য। একই সঙ্গে, গাবা ও ক্রিয়াটিন অনুপাত এবং গাবা ও গ্লুটামেট অনুপাতও স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে যাওয়ায় শরীরে এসে ভিড় করে অনভিপ্রেত একাধিক উপসর্গ। সমাজবিজ্ঞানিরা জানান, কিশোরদের পরিবার সময় দিচ্ছে না। হাতে তুলে দিচ্ছে মোবাইল। ইন্টারনেটের আসক্তির ফলে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে কিশোররা। ইন্টারনেটে অপরাধের নানা কৌশল তারা শিখে যাচ্ছে। নানা পর্নো সাইটে তারা প্রবেশ করছে। এ ছাড়া যত ধরনের ভিডিও গেইম আছে প্রায় সবগুলোই যুদ্ধ, মারামারি বিষয় নিয়ে। অল্প বয়সে খুন, মারামারি এসব বিষয়ের সঙ্গে একজন কিশোর পরিচিত হয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের গেইমগুলো কিশোর মনে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে সমাজের মধ্যে মূল্যবোধের বড় ধরনের অবক্ষয় হয়েছে। এটা কারোর অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
১৭ জুন (রোববার) রাতে নগরীর হালিশহর আর্টিলারি রোডে সিনেমা দেখে ফেরার পথে মোহাম্মদ সুমন (১৭) ও তার বন্ধুদের মোবাইলসহ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এসময় দুস্কৃতিকারী কিশোরদের ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সুমনকে ছুরিকাঘাত করে কিশোররা। রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান সুমন। এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে ও বুধবার ভোরে হালিশহরের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ১০ কিশোরকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।তারা কারো বয়স ১৫ বছর, কারো ১৬, কারো ১৭, কারো ১৮। বয়সের এ অল্প ব্যবধান প্রভাব পড়েনি তাদের বন্ধুত্বে। এ বন্ধুত্ব আড্ডা দেওয়ার। সেই আড্ডা থেকে সুযোগ পেলে পথচারীদের থেকে হাতিয়ে নিত টাকা ও মোবাইল। কিন্তু কখনো খুন করেনি, তবে ছুরি নিয়ে ভয় দেখাতো। তবে, ভয় দেখাতে গিয়েই তারা খুন করে বসে সুমনকে ।
একই দিন রাত ৯ টার দিকে নগরীর চট্টেশ্বরীর ২ নং পল্টন রোডে মো. আবু জাফর অনিক(২৬) কে বাবার সামনে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। অনিক হত্যার ঘটনায় সোমবার (১৮ জুর) সকালে ১২ জনকে আসামী করে চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন অনিকের বাবা মো. নাছির উদ্দিন। মামলার আসামীরা হলেন, মহিউদ্দীন তুষার (৩০), মিন্টু (৩২), ইমরান শাওন (২৬), ইমন (১৬), শোভন (২৪), রকি (২২), অপরাজিত (২২), অভি (২১), বাচা (২২), এখলাস (২২), দুর্জয় (২১) এবং অজয় (২১)।
গত ১৮ জুন (সোমবার) রাতে নগরীর বাকলিয়া থানার তক্তারপুল এলাকায় ছুরিকাঘাতে জসিম উদ্দিন (২২) খুন হন। বুধবার (২০ জুন) ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত চট্টগ্রাম, ফেনী ও কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার পাঁচজন হলেন- মো. মোবারক (১৮), মোহাম্মদ রাজু (২৩), মোহাম্মদ রনি (২১), মোহাম্মদ নুরু (২০) ও মো. বাদশা (১৯)।
চট্টগ্রাম নগরীতে সন্ধ্যার পর কোনো কিশোর বা শিক্ষার্থীকে বাইরে আড্ডা দিতে দেখলে গ্রেফতার করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম। এ ব্যাপারে সিএমপির প্রতিটি থানায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। গত ২০ (বুধবার) সিএমপি কার্যালয়ে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। পরিবারে সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে কিশোর অপরাধ বাড়ছে বলে তিনি জানান।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ