শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সালাহউদ্দিন আইয়ুবী : এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম

খাদিজা আক্তার দুলি : “আমরা এই যুগেও মসজিদুল আকসায় সেই আজানের সুর আবার উচ্চকিত করতে চাই। নব্বই বছরের মত সময় ধরে এই মসজিদ আজানের প্রতীক্ষায় কোন মুয়াজ্জিনের পথ পানে চেয়ে আছে। তোমরা মনে রেখো মসজিদুল আকসার আজান বিশ্বের সমস্ত প্রান্তরে আবার ও ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলবে।”
সব যুগেই বাতিল তাঁর ভঙ্গুর পিরামিড এর চূড়ায় উঠতে সবচেয়ে বেশী প্রতিবন্ধক মনে করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি মুসলিম মিল্লাতকে। তারা সূক্ষ্ম কৌশল হিসেবে আঘাত হানে এই মিল্লাতের নৈতিকতা, চারিত্রিক পবিত্রতা আর সাংস্কৃতিক ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর। আর বাতিলের এই ফাঁদে পা দেয়া জাতিকে পুনর্গঠন করে সঠিক মর্যাদায় ফিরিয়ে দিতে আবির্ভূত হয় ইসলামী আন্দোলনের অনেক প্রাণশক্তি। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী এমনই এক দুর্বার, অপ্রতিরোধ্য, দুঃসাহসী প্রাণশক্তি। কিংবদন্তি এই সুলতান রক্ত গলিত পথ পাড়ি দিয়ে একের পর এক রাষ্ট্র জয় করে ফিরিয়ে এনেছেন মুসলমানদের হারানো অতীত ইতিহাসকে। শুধু যুদ্ধ জয়ই নয়, বীরত্ব আর মহানুভবতায় শত্রুর চোখেও তিনি ছিলেন “দি গ্রেট সালাহউদ্দিন”।
আলোর পথিকৃৎ : সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ৫৩২ হিজরির (১১৩৮ খ্রিষ্টাব্দে) মেসোপটেমিয়ার তিকরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম সালাহউদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুবী। সালাহউদ্দিন হচ্ছে লকব, যার অর্থ “বিশ্বাসের ন্যায়পরায়ণ”। তিনি কুর্দি বংশোদ্ভুত এবং মিসর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান। সালাউদ্দিন আইয়ুবী বিভিন্ন বিষয়ে অনেক পারদর্শী ছিলেন। ইউক্লিড, পাটিগণিত, আইন এবং ধর্মীয় বিষয়ে খুব ভাল জানতেন। তাছাড়া আরবের ইতিহাস ও আরব ঘোড়ার রক্তধারা সম্পর্কেও তাঁর অনেক জ্ঞান ছিল। তিনি কুর্দি ও তুর্কি ভাষায় কথা বলতে পারতেন।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ছোট থেকেই বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের স্বপ্ন দেখতেন। ইসলামি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলকে (বায়তুল মুকাদ্দাস) ক্রুসেডারদের হাত থেকে প্রায় ৯০ বছর পর রক্ষা করে মুসলমানদের ইসলামি রাষ্ট্রের ছায়ায় আশ্রয় প্রদান করেন।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ছোটবেলায় গভর্নর নিজামুল মূলক-এর মাদ্রাসায় পড়াশুনা ও যুদ্ধ বিদ্যার জ্ঞান লাভ করেন। পড়াশুনার পাশাপাশি যুদ্ধ কৌশল শেখার প্রতি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বেশ ঝোঁক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই বিষয়ে আগ্রহের জন্য তার চাচা তাকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। অল্প সময়ের ব্যবধানেই তিনি এ বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ৫৪৯ হিজরিতে সালাহউদ্দিন ও তার পিতা দামেস্কের রাজ দরবারে চাকরি গ্রহণ করেন।
দ্বাদশ শতাব্দীর আগ থেকেই ইউরোপ, ফ্রান্স ও জার্মান ইসলামি রাষ্ট্র গুলো ভেঙ্গে ফেলে ক্রুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন দিক থেকে চক্রান্তে মেতে উঠে। সাথে সাথে তারা চালাতে থাকে নৃশংস আক্রমণ। মুসলিম আমির, গভর্নরদেরকে তাদের মূল লক্ষ্য- উদ্দেশ্য থেকে ঘুরিয়ে ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠে তারা। তারই ফলাফলে মুসলিম জাতির কাছ থেকে খৃষ্টান সম্প্রদায় ছিনিয়ে নেয় তাদের প্রাণের স্পন্দন প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস।
১১৬৩ সালে ক্রুসেডারদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সামরিক সাফল্য লাভের জন্য আইয়ুবীকে মিসরের রাজ দরবারের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা করা হয়। তখন মিসরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আল-আদিত। আল-আদিত এর মৃত্যুর পর ১১৬৯ সালের ২৩শে মার্চ সব জুলুম অত্যাচার থেকে মুসলিম জাতিকে হেফাজতের জন্য আর ক্রুসেডারদের হাত থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করার জন্য তাকে মিশরের গভর্নর ও সেনা প্রধান করা হয়।
ষড়যন্ত্র ও বিরোধীদের কৌশল : এরপরই ক্রুসেডাররা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা দুনিয়ার বুক থেকে ইসলামের নাম নিশানা চিরতরে মুছে ফেলার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র করত। সবচেয়ে বেশি আঘাত হানত নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে। এর জন্য-
প্রথমত: তাদের কন্যাদেরকে মুসলিমদের চরিত্র হননের প্রশিক্ষণ দিত। আর মেয়েদেরকে এটা বলেই বুঝ দিত যে ক্রুশের জন্য এটা সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ। তাই আমীরদের কাছে তারা সুন্দরী মেয়ে আর মদ পাঠিয়ে দিত। তারা জানত মুসলিমদের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তাদের ঈমানের শক্তি, এই শক্তির বলেই সংখ্যায় স্বল্প, আর স্বল্প রসদ নিয়েও প্রতিবারেই বিজয়ী হয় মুসলমানরা। তাই অনৈতিকতার এই বিষবাস্প দিয়েই মুসলমানদের ঘায়েল করতে চাইত তারা।
দ্বিতীয়ত : মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর ফাটল তৈরি করে নিজেদের চলার পথকে সুগম করাই ছিল ক্রুসেডারদের একমাত্র কাজ। এ জন্য তারা মুসলমানদের পরস্পরের ভেতর অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরী করে দিতো, যার ফলশ্রুতিতে দিনের পর দিন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে অনেক মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে ফেলত মুসলমানরা।
তৃতীয়ত : বাতিল শক্তিকে আপাতত বিচ্ছিন্ন মনে হলেও তার ধর্ম হচ্ছে, সত্যের কোন একক শক্তি যখন আওয়াজ তুলতে শুরু করে বাতিল তখন তার সমস্ত শক্তিকে এক করে সত্যের আওয়াজকে স্তব্ধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। সেই ধারাবাহিকতায় সুলতান আইয়ুবীর ফিলিস্তিনের শোবক ও কার্ক দূর্গ পরাজয়ের প্রতিশোধ স্বরূপ ক্রুসেডাররা পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণকালে স্পেনের নৌ-বহরও তাদের সাথে যুক্ত হয়, যুক্ত হয় ফ্রান্স, জার্মানী ও বেলজিয়াম। সাথে আরো যোগ হয় গ্রিস ও সিসিলির নৌ-বহর। আবার জেরুজালেম হাত ছাড়া হওয়ার পরও পোপ দ্বিতীয় আরবানুসের আহ্বানে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল সমগ্র খৃষ্টান বিশ্ব।
চতুর্থত : সুলতান আইয়ুবী যেখানে মুসলমানদের আক্রমণ করে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো উদ্ধার করে মুসলমানদের মুক্ত করবেন সেখানে ক্রুসেডাররা তাদের গোয়েন্দা বিভাগ দিয়ে মিশরে বিভিন্ন সমস্যা তৈরী করত যাতে আইয়ুবীর মিশর ঠিক করতে করতেই সময় পার হয়ে যায়। বায়তুল মুকাদ্দাস আর রক্ষা করার সুযোগ না পান।
রক্ত ঝরা দিন : সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মুসলিম মিল্লাতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কিশোর বয়স থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে কাটিয়েছেন। দুর্গম পাহাড়, গভীর জংগল, কঠিন মরুভূমি সর্বত্র একের পর এক যুদ্ধ করে রক্ত ঝরিয়ে ছিনিয়ে এনেছিলেন মুসলিমদের হারানো গৌরব। মানুষের চোখ দিয়ে ইতিহাসের পাতায় এমন রক্ত আগে কখনো দেখা যায়নি। কৈশোরের তিনি মসজিদুল আকসার মিম্বর ধরে শপথ করেছিলেন...“আমি বেঁচে থাকতে কখনো বায়তুল মুকাদ্দাস হতে ইসলামী পতাকা সরাতে দিবো না”
এ শপথের কথা স্মরণে রেখেই তিনি সারা জীবন নিজেদের জন্য বিশ্রামকে হারাম করে ছুটেছেন এ প্রান্ত হতে ও প্রান্তে।
আইয়ুবী মিসরের গভর্নর হওয়ার পর পরই সর্বপ্রথম সেখান থেকে খৃষ্টানদের চক্রান্তে পা দেয়া আমিরদেরকে কৌশলে সরিয়ে দেন। আর সেজন্য ক্রুসেডের দালালেরা তাকে মেরে ফেলার ফন্দি আঁটে। সুন্দরী নারী দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোন কিছুতে তারা সফল হতে না পেরে বেছে নেয় ভিন্ন পথ। সেনাবাহিনীতে থাকা সুদানি সেনাদের মধ্যে বিদ্রোহ করার চেষ্টা করে। আইয়ুবী কৌশলে এ বিদ্রোহও দমন করেন।
যুদ্ধ কৌশল : আইয়ুবী ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। এই যোদ্ধার রণকৌশল ছিলো অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত। প্রখর দূরদৃষ্টি নিয়ে তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। সবচেয়ে ভয়ানক কৌশল ছিল“গেরিলা হামলা”। গেরিলা বাহিনী শত্রু সেনাদের পেছনের অংশে আঘাত করেই মুহূর্তের মধ্যেই উধাও হয়ে যেত।
মূলত সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এমন একদল যোগ্য ও দক্ষ  সৈনিক তৈরী করেছিলেন, যাদের কাছে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে রাত আর দিন পুরোটাই ছিল সমান। যারা সুলতানের একটা নির্দেশেই জীবন বিসর্জন দিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে যেত। আর এর জন্য সব রকম ক্ষতি মেনে নিতে দ্বিধা করত না।
তাইতো আকসা আক্রমণের সময় শত্রু বাহিনীর কাছে নিজেদের সম্মান না হারিয়ে জাহাজের কমান্ডার এভাবেই বললেনÑ“আল্লাহর কসম! আমরা সম্মানের সাথেই মরবো। শত্রুরা এ জাহাজ দখল করতে ছুটে আসছে। তোমরা হাতিয়ার ফেলে হাতে কুড়াল নাও। জাহাজ ডুবিয়ে দাও।”
যেসব সৈনিকরা জীবিত ছিল তারা পাটাতনের নিচে গিয়ে জাহাজ ভাঙ্গা শুরু করল। জাহাজে পানি ঢুকছে, অথচ কোন সৈনিক সাঁতরিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেনি সকলেই জাহাজের সাথে সমুদ্র তলে ডুবে গেলো।
নেতার আনুগত্যে জীবন দেয়ার মতো এমন নজরানা পেশ করার সাহস যদি এই আন্দোলনের সৈনিকদের না থাকত তাহলে বিজয়ী হওয়াটা হয়তো তাদের জন্য এত সহজ হতো না।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সর্বপ্রথম ফিলিস্তিনের শোবক দূর্গ অবরোধ করে সেটা জয় করেন। পরে নুরুদ্দীন জঙ্গীর সহায়তায় ক্রাক দুর্গও জয় করেন।
দুর্গগুলো জয়ের প্রতিশোধ স্বরূপ ক্রুসেডাররা পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয় এবং তারা মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। আইয়ুবী তার গোয়েন্দা বিভাগের মাধ্যমে এ খবর পেয়ে যান। খবর পেয়ে তিনি ওখানকার সব অধিবাসীদের অন্যত্রে সরিয়ে দেন আর সৈন্যদের সাধারণ জনগণের ঘরে লুুকিয়ে থাকতে বলেন। এদিকে ক্রুসেডাররা আক্রমণ করতে এসে কোন সৈন্য না পেয়ে খুশি হয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রবেশ করে। ঠিক এসময়েই লুকিয়ে থাকা সৈন্যরা বের হয়ে ক্রুসেডারদের উপর আক্রমণ করে তাদেরকে নিঃশেষ করে দেয়। এভাবে আলেকজান্দ্রিয়া মুসলমানদের দখলে থেকে যায়।
এদিকে ১১৭৪ সালে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তার প্রাণপ্রিয় চাচা নুরুদ্দীন জঙ্গীকে হারান; যিনি এ পর্যন্ত সব যুদ্ধেই সুলতানকে শক্তি সাহস ও পূর্ণ সহযোগিতা দিয়ে এসেছিলেন। সুযোগ পেয়ে ক্রুসেডাররা আনন্দে আত্মহারা হয়ে তৈরী করে এক গভীর চক্রান্ত। তারা নুরুদ্দীনের রেখে যাওয়া মাত্র ১১ বছর বয়সের ছেলেকে ক্ষমতায় বসায়। যাতে নাবালক ছেলেটার কাছ থেকে ফায়দা লাভ করা যায়। কিন্তু আইয়ুবী তা হতে দেননি। তিনি মাত্র ৭০০ জন সৈন্য নিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সিরিয়ায় আক্রমণ করেন। সিরিয়াকে আবার নিজ দখলে নিয়ে আসেন। অতঃপর তিনি সিরিয়া ও মিসর কে এক করে দেন। সেখানে থেকেই তিনি “সুলতান” উপাধি লাভ করেন।
শুরু থেকে এ পর্যন্ত যেসব আমীররা ক্রুসেডারদের সাথে হাত মিলিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চাইত, তাদের সাথে যুদ্ধ করতে সুলতানের অনেকগুলো বছর কেটে গেলো। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও সুলতান আল-আকসার বিজয়কে মন থেকে সরাতে পারেননি। একটার পর একটা অঞ্চল দখল করছেন আর আল-আকসা তার অন্তরে আরও ব্যাকুলতা তৈরী করেছে। এজন্য অনেক যুদ্ধ ও কষ্টের পর সুলতান হালব, হাররান ও মসুল দখল করে নেন। এগুলো দখল করতে বায়তুল মুকাদ্দাসের পথে আর কোন বাধা ছিলনা।
তবে এ অভিযান ছিল খুবই বিপদসংকুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। ক্রুসেডারদের সামরিক শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বই কেবল বেশি ছিলো না, পারিপার্শ্বিক অবস্থার দিক থেকেও তারা ছিল খুবই সুবিধাজনক স্থানে। তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল মজবুত ও সংহত। অপরদিকে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল খুবই নগন্য। প্রয়োজনীয় রসদও ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু আল্লাহর পথের এ সৈনিকদের ঈমানী আবেগ ছিলো অত্যন্ত টগবগে।
এ অবস্থায় সুলতান তার সৈনিকদের বলেলেনÑ “বিজয় ছিনিয়ে আনতে হলে আমাদের ভুমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সমস্ত নৌযানগুলো আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলার মতো সাহস ও হিম্মত রাখতে হবে। পিছু হটার সব পথ বন্ধ না করলে বিজয় আমাদের পদচুম্বন করবে না। সুতরাং এই অনুভূতি নিয়ে আমাদের ময়দানে পা বাড়াতে হবে যে, এটাই আমার জীবনের শেষ যাত্রা, আর কোনদিন আমরা কেউ স্বদেশ ও স্বজনদের কাছে ফিরে যেতে নাও পারি।”
সুলতান এবার আক্রা আক্রমণ করলেন। ২-৩ দিন অবরোধ এর পর আক্রাও মুসলমানদের হাতে চলে আসল। তারপর সুলতান মাহমুদ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ “আসকালীন” অবরোধ করেন। প্রায় ৩৪ বছর পর এই অঞ্চলটি মুসলমানদের মাধ্যমে আবারও স্বাধীন হল। আসকালীন থেকে মাত্র ৪০ কিঃমিঃ দুরে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস।
প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধার : ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই মুসলমান আমিরদের সহায়তায় তৎকালীন ক্রুসেডাররা মুসলমানদের প্রথম কিবলা “বায়তুল মুকাদ্দাস” দখল করে। তারা নগরীতে প্রবেশ করে মুসলিমদের গণহারে হত্যা করা শুরু করে। নারীদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করে, শিশুদের মাথা কেটে নেয়। নিরুপায় মুসলিমরা সেই দিন মসজিদকে পবিত্র স্থান মনে করে আল আকসাসহ বেশ কিছু মসজিদে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সেখানেও তারা চালাতে থাকে ইতিহাসের নির্মম রক্ত খেলা। যাকে পাচ্ছিল তাকেই হত্যা করছিল। মুসলমানদের রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে মসজিদের বাহিরে পড়ছিলো, খৃষ্টানদের ঘোড়ার পা রক্তে ডুবে যাচ্ছিল আর অদ্ভুত এক আনন্দে ভাসছিল তারা। মেয়েদের মসজিদ থেকে জোর পূর্বক বাহিরে টেনে এনে উলঙ্গ করে সতীত্ব হরণ করছিল এই ক্রুসেডাররা। যে ভারী কাজগুলো ছিলো পুরুষদের জন্য সেই কাজ নারীদের দিয়ে করানো হচ্ছিল। এভাবে করতে করতে যখন বুঝতো এদের দিয়ে আর কোন কাজ হবে না তখন জবেহ করে তার গোশত রান্না করে খেত।
মহান আল্লাহ নিজেও যেন এই জুলুম আর সহ্য করলেন না। ১১৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেন। অপরপক্ষে খৃষ্টানরাও তাদের পবিত্র ভূমি ছাড়তে নারাজ। এবার আইয়ুবী তাঁর সাথীদের উদ্দেশ্যে বললেনÑ“শহীদদের যে জাতি ভুলে যায় সে জাতিকে আল্লাহও ভুলে যান। তাদের ভাগ্যে সিলমারা হয়ে যায়। লওহে মাহফুজে চির অভিশাপে পড়ে যায় তারা। এখন তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোমরা কিয়ামতের দিন অভিশপ্ত জাতি হয়ে উঠবে নাকি সেই জাতির মত উঠবে, যে জাতির জন্য আল্লাহর রাসূল (স:) আল্লাহকে বলবেন-হে আল্লাহ এই সে জাতি যাদের কোরবানী ও আত্মত্যাগের সামনে কাফেরদের ঝঞ্ঝা-তুফান প্রতিহত হয়েছিল আর তোমার সত্য দ্বীনের সম্মান ও গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছিল।”
এমন আবেগময়ী ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে শুরু হল প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। দু’পক্ষেই হল অনেক হতাহত। শেষ পর্যন্ত অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ৫৮৩ হিজরির ২৭ রজব শুক্রবার সম্মানিত বায়তুল মুকাদ্দাসে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করলেন সুলতান আইয়ুবী। কিংবদন্তী এই সুলতান থরথর কাপা শরীর নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করেন। বাঁধভাঙা জোয়ারের ন্যায় অশ্রুসজল হয়ে বিনীত মস্তকে নত হয়ে যান তার প্রভুর শানে।
মূলত বায়তুল মুকাদ্দাসের বিজয় ইসলামের ইতিহাসে এক স্বর্ণকমল সফলতা। ইসলামী রাষ্ট্রগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা, মুসলমানদের যুলুম, অত্যাচার থেকে বাঁচানো আর প্রথম কিবলাকে রক্ষা করাই ছিল সুলতানের উদ্দেশ্য। মুসলিমরা ক্রুসেডের এই যুদ্ধে বিজয়ী হওয়াতে প্রচন্ড এক ধাক্কা খেল ইউরোপ মহাদেশ।
সংগ্রামী সালাহউদ্দিন : এই সময়ে খৃষ্টান বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো চিন্তা করল আইয়ুবীর বিরুদ্ধে এখনো যদি কোন শক্তি গড়ে তোলা না যায় তাহলে সমস্ত ফিলিস্তিনও মুসলিমদের দখলে চলে যাবে। তাই সমস্ত খৃষ্টান রাষ্ট্র মিলে এক ঐক্য জোট তৈরী করল। ৫২০টি যুদ্ধ জাহাজ আর ৬০০০০০ সৈন্য নিয়ে আবারও হামলা চালাতে চাইল বায়তুল মুকাদ্দাসে। প্রখ্যাত রণকৌশলী সুলতান সুকৌশলে তাদের আকসার দিকে নিয়ে এসে এখানেই ব্যস্ত রাখতে চাইলেন যাতে এই শক্তিকে এখানেই শেষ করে দিয়ে আল্লাহর পবিত্র ঘর বায়তুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা করা যায়। আকসা আক্রমণ করে ক্রুসেডাররা নারী শিশু সহ ৩০০০ মুসলিমের হাত-পা বেঁধে তাঁদের হত্যা করে ফেলে।
অপরদিকে মুসলমান সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১০০০০। এই দশ হাজার সৈন্য প্রাণপণ লড়াই করে তিন লাখ সৈন্যকে ধরাশয়ী করে ফেলে।
সুলতান বুঝলেন বায়তুল মুকাদ্দাসকে পাওয়ার জন্য শত্রুপক্ষ আশেপাশের অঞ্চলগুলোও দখল করতে চাইবে। তাই সুলতান নিজেই কাছাকাছি সব অঞ্চলগুলো তছনছ করে দিলেন। ফলে সম্রাট রিচার্ড যতই সামনে এগোতে লাগলেন শুধু ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। রিচার্ড মুসলমান সৈনিকদের নির্ভীকতা দেখে বুঝতে পারলেন বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করা এত সহজ হবেনা। আসলেই যে জাতি নিজ ধর্মের জন্য এতো কোরবানী দিতে পারে তাদেরকে দুনিয়া থেকে উৎখাত করার দু:সাহস কে করতে পারে? এদিকে রিচার্ড গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলেন। মানবতার এই রাষ্ট্রনায়ক সুলতান আইয়ুবী দেখতে গেলেন রিচার্ডকে। নির্বাক হয়ে রিচার্ড বললেÑ “সত্যিই আপনি মহান! সালাহউদ্দিন। সত্যিই আপনি এক অনন্য যোদ্ধা।”
১১৯২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রিচার্ড সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে একটি সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষর করলেন এবং তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে ইংল্যান্ডে যাত্রা করলেন।
১১৯৩ সালের ৪ মার্চ এই মহান নেতা চলে যান তার প্রিয় প্রভুর সান্নিধ্যে।
যুগসন্ধিক্ষণ : প্রয়োজন এক জন আইয়ুবীর : সভ্যতার পালা বদলে দীর্ঘ আটশত বছর পরে মুসলমানদের ভেতর পারস্পারিক অনৈক্যের কবলে পড়ে পবিত্র আল আকসায় আবার উড়ল ইহুদীদের পতাকা। সেই একই কৌশল। অনৈতিকতার বিষাক্ত ছোবল গ্রাস করে নিল মুসলিম সভ্যতা, সংস্কৃতি। মুসলমানদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে অট্টউল্লাসে নৃত্য করছে বাতিল শক্তি। শুধু ফিলিস্তিন নয় একের পর এক দখল করছে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো। চালানো হচ্ছে মানবিকতার উপর এক ভয়াল নির্যাতন। পারলে মুসলমানদের কলিজা চিবিয়ে আনন্দ করছে বর্বর হায়েনারা। এই পরাশক্তিগুলো দমনে আজ প্রয়োজন এক “গ্রেট সালাহউদ্দিনের”, যার দুঃসাহসিকতা দেখে বৈরী হাওয়া মুছে দিবে সব নীচতা, হীনতা আর অমানবিকতার সব আস্ফালন। প্রস্ফুটিত হবে এক নতুন সূর্যোদয়ের॥

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ