মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

সৌন্দর্য ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের শখের বিলাস বনসাই

মুহাম্মদ নূরে আলম : গাছ মানেই বিশাল। যতটা সম্ভব আকাশের দিকে উঠে যাওয়া। কিন্তু বনসাই অন্যান্য গাছের চাইতে কিছুটা আলাদা প্রকৃতির। এই গাছ লম্বায় অনেক ছোট হয়। অনায়াসে ঘরে ও বারান্দার টবে রাখা যায়। শহুরে মানুষ এই বনসাই বৃক্ষের সৌন্দর্যের কাছে নত। শৈল্পিকবোধ আর বুদ্ধি দিয়ে শহরের মানুষ বনের গাছটিকে মনের করে নিচ্ছেন। মানুষের মনের জগৎকে সাজিয়ে তুলতে প্রকৃতির কোনো জুড়ি নেই। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ছাড়াও মানুষের সৌন্দর্য চেতনা গঠনে বৃক্ষ, লতা, পুষ্পের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। জৈন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধ্যান মগ্নতার মধ্য দিয়ে বনসাইয়ের সৃষ্টি। এরা মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সেতু বন্ধন রচনায় আগ্রহী। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ তার পরিশ্রম মেধা কল্পনা অনুযায়ী শিল্পকলার চর্চা করে আসছে। একে কেন্দ্র করেই গাছকে মূল উপাদান ধরে বনসাই নামের জীবন্ত শিল্পকর্মের সৃষ্টি। এই শিল্পকর্মটিকে আমাদের দেশে  জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বনসাই সৌন্দর্য ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের শখের বিলাস, অফিস ও ফ্লাটবাসায় দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বনসাই। সোসাইটির আয়োজিত প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে মানুষের নান্দনিক রুচিবোধ গড়ে উঠেছে। একটি বনসাই পূর্ণাঙ্গ রূপ নিতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। সাধারণত গাছভেদে বনসাইয়ের দাম ২ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিভিন্ন নার্সারীতে এসব গাছ পাওয়া যায়। এছাড়া বৃক্ষ মেলায় অহরহ দেখা যায় বিক্রি করতে। 

বনসাইয়ের ইতিহাস : বনসাই অর্থ ট্রের মধ্যে ফলানো। শক্ত কান্ড রয়েছে এমন গাছের খর্বাকৃতি করার শিল্পকে বনসাই বলা হয়। বনসাই তৈরিতে নান্দনিকতার ছোঁয়া থাকে। বনসাই শব্দটি জাপানী; চীনা পেনজাই শব্দ থেকে বনসাই শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় পাত্রে/ টবে গাছের বিভিন্ন ধরনের চারা জন্মানোর কথা জানা যায়। ৪০০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে পাত্রে গাছ লাগানো হত। এরকম তথ্য সে সময়কার রাজনৈতিক নথিপত্র ঘেটে জানা যায়। ঐ সময়ে পাথর কেটে পাত্র তৈরী করে সে পাত্রে গাছ লাগানো হত। তৃতীয় ফারাও রামেসেস পাত্রে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগিয়ে অনেক মন্দিরে দান করেছিলেন। প্রাচীন কালে ভারতে টবে পাত্রে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানোর প্রচলন ছিল। সে সময়ে ঔষধ ও খাবারের জন্য পাত্রে গাছ লাগানো হত। এক হাজার বছর আগে চীনে এর প্রচলন শুরু হলেও দ্বাদশ শতাব্দীতে জাপানীদের নান্দনিক ছোঁয়ায় এটি শিল্পে পরিণত হয়।

ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা অনুপাতে যে পরিমাণ গাছ থাকার কথা তার সিকি ভাগের উপস্থিতি থাকলেও মানুষের জন্য অন্তত সুবিধা হতো। তার ওপর যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও  ইন্ডাস্ট্রি বর্জ্যর কারণে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি ও বাতাস। সব মিলিয়ে দিন দিন বাড়ছে ঢাকার বাতাসে সিসার পরিমাণ। নগরবিদদের ধারণা, সহসাই এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে না পারলে মহাসংকটে পড়বে ঢাকা শহর। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে পৃথিবীর দেশে দেশে নগর পরিকল্পনায় যোগ হচ্ছে প্রকৃতির অংশগ্রহণ। সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি। বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটির কয়েকটি প্রদর্শনী খুব কাছে থেকে দেখেছি। গাছ প্রস্তুত থেকে শুরু করে প্রতিটি গাছের পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ ও যতœ চলে সারা বছর ধরে। তাই বছর জুড়েই থাকে বনসাই শিল্পীদের কমবেশি ব্যস্ততা। বর্ষাকালে গাছপালার শাখা-প্রশাখা এমনিতেই পাতা পল্লবে ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠে। এমনই অপরূপ সৌন্দর্যের আধার নিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের চারুকলায় বনসাই প্রদর্শনী । বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বনসাই শিল্পীদের সংখ্যা যেমন দিন দিন বাড়ছে তেমনি বনসাইয়ের প্রতি বাড়ছে সাধারণ মানুষের আগ্রহও। 

দেশের শীর্ষস্থানীয় বনসাই সংগঠন রেডিয়েন্ট বনসাই সোসাইটির সদস্য ও বনসাই শিল্পী লায়লা আহমেদ এর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ২ নং জয়নুল গ্যালারিতে চলছে বনসাই প্রদর্শনী।  এ প্রদর্শনী চলছে ২৩ থেকে আজ ২৯ জুন পর্যন্ত। প্রদর্শনী প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলছে। লায়লা আহমেদ এর দ্বিতীয় একক বনসাই প্রদর্শনীতে কথা সাহিত্যিক ও নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়–য়ার সভাপতিত্বে  উপস্থিত ছিলেন, অধ্যাপক শিশির ভট্রাচার্য্য, সাংবাদিক প্রভাস আমিন, সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফি প্রমুখ। প্রায় ২০০ প্রজাতির বনসাই রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীর পাশাপাশি বনসাই বিক্রিরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রদর্শনীতে ৫০০ টাকা থেকে ৭০,০০০ টাকা পর্যন্ত দামের বনসাই রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে দর্শনার্থীদের পদচারণায় জমে উঠেছে প্রদর্শনী। বর্তমানে তার এ বাগানের টবে স্থান পাচ্ছে বট, পাকড়, তেতুল, নিম, হিজল, তমাল, লেবু, বেল, কদবেল, ডালিম, গাব, ডুমুর, শ্বেতচন্দন, বাবলা, শ্যাওড়া, জারুল, কামিনী, ছাতিম, কৃষ্ণচূড়া, বকুল, শিমুল, চটকা, দেবদারুসহ প্রায় দুই শতাধিক প্রজাতির গাছের বনসাই। এ ছাড়াও রয়েছে ৫০  প্রজাতির নানা ধরনের ক্যাকটাস। এর মধ্যে বট, পাকড়, তেঁতুল, বকুল, দেবদার, অর্জুন, দারুলসহ একাধিক প্রজাতির বনসাই রয়েছে যার বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর।

প্রদর্শনীতে বনসাই শিল্পী লায়লা আহমেদ দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, যারা শহরে থাকেন তাদের ছোট ছেলেমেয়েদের  অনেকেই আমাদের দেশের বিভিন্ন গাছপালা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। তাই তাদের এসব গাছপালা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার ক্ষেত্রে এ প্রদর্শনী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরো বলেন, বনসাই অমূল্য সম্পদ, স্টাইল, সিস্টেম ও বয়সের উপর ভিত্তি করেই এগুলোর দাম নির্ধারণ করা হয়। এর ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। যদি বনসাই শিল্পী বাড়ানো যায়, তাহলে এগুলো রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। উল্লেখ্য, প্রদর্শনীতে আগত দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন বনসাই তৈরির কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করেন বনসাই শিল্পী লায়লা আহমেদ।  প্রদর্শনীতে ৪০ থেকে ৫০ বছরের পুরনো কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন বট ও ঘূর্ণিগাছের বনসাই ছিল সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। নিসর্গ প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা বনসাই শিল্পী লায়লা আহমেদ ভালোবাসেন প্রকৃতিকে। তার এই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই সূচনা তার বনসাই শিল্পের। পরিবারের ঐকান্তিক আগ্রহ ও নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলেই এই শিল্পের অগ্রযাত্রার লক্ষ্যে তিনি নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন।

ছোট থেকে শুরু করে বড় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির বনসাই রয়েছে তার কালেকশনে। বিভিন্ন প্রজাতির কতগুলো বনসাই নিয়ে তিনি এই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। তার সৃষ্ট বট ও দেশী গাছের বনসাই প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ ছিল। তিনি বলেন, বর্তমান সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের এই চরম দুঃসময়ে বনসাই হতে পারে প্রতিষেধক।  ডিজিটাল যুগের যান্ত্রিকতায় আপনার ও আপনার সন্তানদের সুরক্ষায় আপনার ঘরের কোনায় অথবা ব্যালকনিতে গড়ে তুলতে পারেন একটি সবুজ বনসাই উদ্যান। 

বনসাই পরিচর্যার নিয়ম: বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি ফোন : ০২- ৮১২২৬৮৬ মোবাইল: ০১৭১১-৮১০২৬২ এবং মায়াবী বনসাই: শিল্পী লায়লা আহমেদ ০১৭১৫-৯০৯১২৪ এই নাম্বারগুলোতে যোগাযোগ করে বনসাই কিনতে পারেন। যে জায়গা উপযুক্ত পানি নিষ্কাশন সুবিধা  রয়েছে এবং সূর্যের আলো পৌঁছে এমন জায়গা বেছে নিতে হয় বনসাইয়ের জন্য। অর্থাৎ পরিবেশটা অবশ্যই খোলামেলা হতে হয়। দোঁ-আশ ও বেলে মাটি বনসাইয়ের জন্য উপযুক্ত। তবে যে বনসাই গাছটি বড় টবে আছে সেই টবে রেখেই পরিচর্যা করা যায়। কয়টি গাছের বনসাই করা হবে তার উপর জায়গার পরিমাণ নির্ভর করে। পাখি থেকে বনসাইয়ের কুড়ি বাঁচাতে নেট ব্যবহার করতে হয়। মাটি তৈরী বিভিন্ন জাতের বনসাইয়ের জন্য আলাদা ভাবে মাটি তৈরী করতে হয়। মাটি তৈরীতে জৈব সার ও দো-আঁশ বা পলি মাটি ব্যবহার করতে হয়। জৈবসার ও দো-আঁশ মাটির মিশ্রনে জৈব সারের পরিমাণ বেশী থাকতে হয়। একনজরে মাটি তৈরী দো-আঁশ মাটি পরিমাণ মতো কাঠের ছাই ৭৫ গ্রাম ইট গুড়ো ১৩০ গ্রাম খড়ি মাটির গুড়ো ৫০ গ্রাম হাড় গুড়ো ৫০ গ্রাম কম্পোস্ট ১/২ কেজি শুকনো গোবর পরিমাণ মতো পঁচা গোবর পরিমাণ মতো মোটা বালু অল্প পরিমাণ। 

 যেখানে থাকতে পারে বিভিন্ন প্রজাতির বনসাই। নেট, ফেসবুক অথবা মোবাইলের পরিবর্তে সন্তানের হাতে তুলে দিন একটি সবুজ বৃক্ষ। তাকে পরিচর্যা করতে বলুন। বিভিন্ন প্রজাতির গাছের প্রতি তাকে আকৃষ্ট করে তুলুন। দেখুন না আপনার সন্তানের মনোজগতে কি ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন আপনি! শুধু শখ বা বিনোদনই নয়, এটি হতে পারে অর্থনৈতিক মুক্তির উপায়ও। সঠিকভাবে বনসাই চাষ করে শখের পাশাপাশি হতে পারেন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। বাংলাদেশের বনসাই শিল্পীরা  সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কোনো বিকল্প নেই।

বিমানবন্দর সড়কে বনসাই সৌন্দর্য!: বিমানবন্দর সড়ক থেকে বনানীর দিকে আসতে নিকুঞ্জ পর্যন্ত রাস্তায় প্রায় এক’শ বটজাতীয় বনসাইগাছ লাগানো হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) কর্মকর্তারা জানান, বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে অত্যাধুনিকভাবে সাজানোর অংশ হিসেবে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কাজটি পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি চীন থেকে এনে ফাইকাস বনসাইগুলো লাগায়। কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, রাধাচূড়া, কদমসহ রঙিন সব দেশি ফুল যখন রাজধানী রাঙায়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ