শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

স্বপ্নভূমি হামপি

আখতার হামিদ খান : প্রায় পাঁচশো বছর আগে পর্তুগীজ ইতিহাসবিদ ডোমিং পয়েজ হামপি বা বিজয়নগরকে স্বপ্নভূমি বলে সম্বোধন করেছিলেন। সেই সূত্র ধরে চলে যেতে হয় আরও দূরে। ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে সঙ্গম রাজবংশের রাজারা প্রাচীন হামপি শহরের ওপর তৈরি করেছিলেন এই বিজয়নগর। রাজা কৃষ্ণদেব রায় (১৫০৯-১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ) এই রাজধানী শহর সাজিয়েছিলেন বিশাল সব রাজপ্রাসাদ এবং মন্দির তৈরি করে। সীমানাও বাড়িয়েছিলেন অনেক দূর পর্যন্ত। এটাই ছিল দক্ষিণ ভারতে সবচেয়ে শক্তিশালী হিন্দু রাজ্য। এই রাজ্যের শক্তিমত্তার পতন শুরু হয় ১৫৬৫ সালে যখন পাশ্ববর্তী বাহামাই রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটে বিজয়নগরের ওপর। বিজয়ের নগরী হয় পরাভূত ও বিধ্বস্ত। বেদনাদায়ক ইতিহাসের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এর গৌরবগাথা। এই রাজ্যের পরিধি ছিল আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী স্থানে দাক্ষিণাত্য মালভূমি থেকে ভারতীয় উপদ্বীপ পর্যন্ত। নগরীর ধ্বংসাবশেষগুলো বড় বড় বোল্ডারের মত এলোমেলো হয়ে এবং দেহে বন্যরূপ নিয়ে দৈবাধীনভাবে পড়ে আছে একে অপরের ওপর। যখন মানুষের তৈরি অবকাঠামোগুলো থমকে গেছে, প্রকৃতি এই ধ্বংসলীলার ওপর এমন এক ভয়ালসুন্দর রূপ আরোপ করেছে যা শত শত বছর থেকে পর্যটকদের টেনে আনছে। এর গৌরবময় ধ্বংসাবশেষগুলো কাল্পনিক ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে আকষ্মিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার আগেই হামপি একটি বিখ্যাত পবিত্র স্থান হিসেবে পরিগণিত হত। এটি রামায়ণে উল্লেখিত বালীর শাসনাধীন কিষ্কিন্ধ্যা অঞ্চলের অধীন ছিল। সপ্তকাণ্ড রামায়ণের অনেক স্থানে বালী ও সুগ্রীবের দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং হনুমান, রাম-সীতা ও লক্ষণের নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে হামপির নাম জড়িত।
তুঙ্গাভদ্রা নদী বরাবর বর্তমান কালের আনেগণ্ডি দুর্গ সেই বানর রাজ্যের অধীর ছিল। হামপির হেমকুট পর্বত, মাতাঙ্গ তুঙ্গাভদ্রার প্রাচীন নাম পামপা। পার্বতী, যিনি বিরুপাক্ষরূপ শিবকে বিয়ে করেছিলেন, তিনি তার নিজের নামে এই নগর নির্মাণ করেন। হামপি নামটি এসেছে পামপা অথবা পামপাপতি শব্দ থেকে।
বিজয়নগর যখন রাজনৈতিকভাবে শক্তিমত্তার চরমে অবস্থান করছিল তখন এই রাজ্যটি দক্ষিণ ভারতে হিন্দুত্ববাদের রক্ষা প্রাচীর হিসেবে পরিগণিত হত। বিশেষ করে, দিল্লির সুলতানদের ও পার্শ্ববর্তী রাজ্য গোলকোনডা, আহমেদনগর, গুলবারগা এবং বিদরের আক্রমণ প্রতিহত করত। এই বাহামাই রাজ্যগুলো ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দের তালিকোটা যুদ্ধে বিজয়নগরের গৌরবময় ও ঘটনাবহুল ইতিহাসের অঘোষিত ‘ইতি’ টানে। হামপির অধিকাংশ ইমারত তৈরি করেছিলেন কৃষ্ণদেব রায় (১৫০৯-২৯)। বিটঠাল এবং কৃষ্ণ মন্দির, বিরুপাক্ষ মন্দিরের প্রবেশ পথগুলো, নরসিংহ এবং গণেশের বিশাল মূর্তিসমূহ, রাজকীয় প্রকান্ড প্লাটফরম, পুষ্করিণীর সিঁড়িযুক্ত চমৎকার পুকুর এবং আরও অনেক অবকাঠামো এই খ্যাতিমান শাসকের কীর্তি বহন করছে।
হামপিতে এসে হেমকূট পাহাড়ের পিরামিড ছাদ সদৃশ্য ছোট ছোট মন্দিরগুলো দেখে আপনার দিন শুরু করলে ভ্রমণটা উপভোগ্য হবে বলে আশা করা যায়। এখানকার অধিকাংশ মন্দিরই কিন্তু বিজয়নগর যুগের আগে তৈরি। এই পাহাড়ের ওপর উঠলে বিরুপাক্ষ মন্দির এবং তুঙ্গাভদ্রা নদীসমেত পুরো এলাকাটাই একনজরে দেখে নেয়া যায়। ছবি তোলার জন্যে এমন দৃশ্য সহজেই মেলে না।
বায়ান্ন মিটার উঁচু পূর্ব দিকের প্রবেশ পথটি এবং ৭০০ মিটার লম্বা বিরুপাক্ষ মন্দিরের প্রবেশ পথ হামপির ব্যবসা কেন্দ্র। এই প্রবেশ পথটি দিয়ে এগিয়ে এলে দেখা যাবে দুটি অভ্যন্তরীণ উঠান এবং বেশ কয়েকটি পুরনো ও নতুন সমাধিক্ষেত্র। অভ্যন্তরীণ উঠানের মাঝখানে রয়েছে মনোহর মন্ডপসমৃদ্ধ একটি মন্দির। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত বিরুপাক্ষ লিঙ্গম এর চমৎকার সিলিং এ এখনও সেই বিজয়নগর আমলের পুরনো অনেক চিত্রকর্ম আঁকা রয়েছে। এখানেও অসংখ্য সমাধিক্ষেত্র রয়েছে। সন্ন্যাসী বিদ্যারণা এর সমাধি এরমধ্যে অন্যতম। এই সন্ন্যাসী আশীর্বাদে ১৩৩৬ সালে এই রাজধানী শহরটি স্থাপিত হয়েছিল। হামপিতে শুধুমাত্র এই বিরুপাক্ষ মন্দিরেই প্রতিদিন পূজা-অর্চনা করা হয়।
বিটঠাল মন্দির, যা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্থাপত্য হিসেবে সংরক্ষিত হচ্ছে, দেখতে হলে পুরো সকালটাই লাগবে। হামপিতে এই মন্দিরটি কৃষ্ণদেব রায়ের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এখানকার কল্যাণ মন্ডপটি সবচেয়ে অলংকারসমৃদ্ধ অবকাঠামো। এখানে ধাবমান ঘোড়ার অলংকরণ এবং জালির থাম রয়েছে। আরও রয়েছে অনেক উঁচুমানের ভাস্কর্য।
বিজয়নগরের ভাস্কর্যশিল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভাস্কর্যটি রয়েছে এখানে। সেটি হচ্ছে- কেন্দ্রীয় সমাধির দিকে মুখ করা পাথরের তৈরি একটি ছোট ঘোড়ার গাড়ি। বিটঠাল মন্দিরের প্রধান অট্টালিকাটির খাস কামরার পাশে একটি মাঝারি আকৃতির স্তম্ভ রয়েছে যাকে ভাস্কর্যশিল্পের একটি জাদুঘর বললে অত্যুক্তি হয় না। এর বিশাল বিশাল স্তম্ভগুলোতে রয়েছে চমৎকার সব ভাস্কর্য।
প্রধান প্রবেশপথের মুখে সরু সরু স্তম্ভগুলো। খোদাই করা হয়েছে সঙ্গীতের স্বরলিপি দিয়ে যা দর্শনার্থীরা বিস্ময় ভরে উপভোগ করেন। যদিও এই ভবনটির কাজ শেষ হয়নি, তবুও এটি হামপির সর্বাপেক্ষা মনোহর মন্দির। এটি ভারতীয় স্থাপত্য এবং ভাস্কর্য ঐতিহ্যের অহংকার।
চোল স্থাপত্যশিল্পের নমুনায় তৈরি হয়েছে কৃষ্ণ মন্দির। এর অলংকরণে রয়েছে আভিাজত্যের ছোঁয়া। ওড়িশা সফরের সফলতাকে স্মরণীয় রাখার জন্য ১৫১৩ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণদেব রায় এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। বিজয়নগরে এই শাসকের স্থাপত্য নিদর্শনের ভিতর আরও রয়েছে ৬.৭ মিটার উঁচু নরসিংহের মূর্তি। একটি বাসুকী নাগের চন্দ্রাতপরে নিচে বসে আছেন তিনি। এর পাশে রয়েছে একটি বড় শিবলিঙ্গ যার ভিত্তি পানির নিচে। এছাড়াও রয়েছে গণেশের দুটি বিশালাকৃতির চমৎকার ভাস্কর্য।
প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্যে রয়েছে একটি আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক স্থাপত্য। খিলানের মত দেখতে দুটি সুবিপুল পাথর রয়েছে এখানে যাকে স্থানীয় লোকেরা বড়বোন, ছোটবোন বলে আখ্যায়িত করে। রাজকীয় ভাবগাম্বীর্য নিয়ে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাজার রাম মন্দির। অলংকরণসমৃদ্ধ ছোট এই মন্দিরটির খ্যাতি রয়েছে কষ্টিপাথরের তৈরি চারটি বাঁকানো স্তম্ভ এবং বহির্ভাগের সারি সারি ভাস্কর্যের জন্যে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ