শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

১৭ দিন শিশুদের আগলে রাখা সেই কোচ

১১ জুলাই, সিএনএন, বিবিসি, স্টাফ-নিউ জিল্যান্ড: ঢুকেছিলেন তিনিই প্রথম। বের হয়েছেন সবার পরে। বৃষ্টির ঝুঁকি নিয়েও কিশোর ফুটবলাররা থাম লুয়াং গুহায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল তার কারণেই। থাইল্যান্ডের ওয়াইল্ড বোর্স ফুটবল দলের কোচ একাপল আকে চান্থাওং তাই বিতর্কিত হয়েছেন। নিন্দুকেরা বলেছে, এমন দুর্গম আর ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কিশোরদের নিয়ে গিয়ে মোটেও ঠিক কাজ করেননি তিনি। তার অনুমতির কারণেই ১৭ দিনের ‘অন্ধকার যাপন’ বাস্তবতায় কাটাতে হলো কিশোরদের। তবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, এই কোচ গুহার ভেতরের সেই অন্ধকার দিনগুলোতে আলোকশিখা হয়ে জ্বলেছেন। ডুবুরিরা বেরিয়ে এসে সাক্ষ্য দিয়েছে, একাপল আকে নিজেকে উজার করে দিয়েছেন কিশোরদের আগলে রাখতে। ওই শিশুদের অভিভাবকরাও তাই আস্থাশীল ছিলেন কোচের ওপর। ছেলেরা গুহায় থাকা অবস্থাতেই তারা বলেছিলেন, একাপলের প্রতি তাদের আস্থা আছে। ভরসা ছিল বন্ধুদেরও। কাছের মানুষরা তাকে সমাজের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মানুষ হিসেবেই জানেন। সবার কাছেই তিনি বিশ্বাস, মানুষের জন্য মমতা, ভালোবাসা আর নিরাপদ আশ্রয়’। স্বজনদের একজন তাই মনে করছেন, এমনও হতে পারে যে রোদ থেকে শিশুদের বাঁচাতে তিনি তাদের নিয়ে গুহায় ঢুকে পড়েছিলেন!

গত ২৩ জুন ফুটবল অনুশীলন শেষে ২৫ বছর বয়সী কোচসহ ওই ১২ কিশোর ফুটবলার গুহাটির ভেতরে ঘুরতে গিয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টিতে গুহার প্রবেশমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা আর বের হতে পারেনি। তার ভূমিকাকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ’ মনে করছেন অনেকে। তবে নিজ এলাকায় পরোপকারের জন্য খুবই জনপ্রিয় একাপল। সমাজকর্মী ও আধ্যাত্ম সাধনার জন্য তার খ্যাতি আছে। অবহেলা কিংবা দায়িত্বহীনতার অভিযোগকে তাই উড়িয়ে দিয়েছেন পরিচিতজনরা। থামা কান্তাওয়ং নামে তার একজন আত্মীয়ের ভাষ্য, ‘ও দলকে ভালোবাসে। যখনই কোথাও যেত, বাচ্চাগুলোর সঙ্গে সেঁটে থাকতো। অভিভাবকরাও তাই ভরসা করতো ওকে।’ কোচের দায়িত্বহীনতার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে  কান্তাওয়াং বলেন, ‘সে খুবই ভালো মানুষ। বাচ্চাদের ভালোবাসে। সবাইকে সাহায্য করে। খুব বিনয়ী।’

সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কান্তাওয়াং কোচ একাপলের অতীতে ফিরে যান। জানান, ছেলেবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়েছে। অল্পদিন পর গত হয়েছেন ভাই। এতিম একাপল তখন বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে আশ্রয় নেয়। মঠেই এক দশকের শৈশব। মাঝে মাঝে কেবল একটু সময়ের জন্য বের হওয়া আর দাদীকে দেখতে আসা। কান্তাওং বলেন, সেই সময়টা ওর জন্য খুবই কঠিন ছিল। ২০ বছর বয়সে আবারও জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় একাপলের। ভিক্ষুর জীবন ছাড়লেও মন্দিরগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তার। প্রার্থনা ও সমাজসেবায় ব্যস্ত থাকতেন তিনি। কাতাওয়াং বলেন, আকে সবসময়ই অন্যদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ।

গুহায় প্রবেশের ৯ দিন পর ২ জুলাই গুহার ভেতরে শনাক্ত করা যায় কোচ আকে আর ১২ কিশোর ফুটবলারকে। গুহার উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া ডুবুরিরা তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানান, আটকে পড়াদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন কোচ। কেননা নিজে না খেয়ে কিশোরদের খাইয়েছেন তিনি। আত্মীয় কাতাওয়াংও সেই বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, সবসময়ই অন্যদের প্রতি মনোযোগী অকে। গুহায় আটকে থাকা প্রথম ৯ দিন সে শিশুদের সাহায্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। সোমবার রাতে ওয়াইল্ড বোর ক্লাবের সিনিয়র দল অনুশীলন শুরু করেছে। জুনিয়র টিম আটকা পড়ার পর তারা সব অনুশীলন স্থগিত করেছিলো। তারা জানায়, এমন অবস্থায় তারা অনুশীলন চালাতে পারে না। তবে উদ্ধার অভিযান সফল হতে থাকার পর তারা উদ্ধারকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতেই অনুশীলন শুরু করে। সপ্তাহে কয়েকবার ট্রেনিং দিলেও তেমন সম্মানি পেতেন না আকে। তবে টাকার কথা কখনও মাথায় নেয়নি। কান্তাওয়াং জানত, সে ফুটবল ভালোবাসতো, ভালোবাসত শিশুদের।

অনুশীলনরত সিনিয়র দলের সদস্যরা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, অকের প্রতি তাদের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার কথা। তারা জানান, শিশুদের জন্য যে কোনও কিছু করতে ঝাঁপিয়ে পড়ার বাতিক আছে আকের। কায়ে হায়ে লাহুনা নামে এক খেলোয়াড়ের ভাষ্য, কোচ খুবই ভালো মানুষ। সবসময়ই শিশুদের সঙ্গে খেলতেন। তাদের নিরাপত্তার বিষয়েও সার্বক্ষণিক নজর ছিল তার।’ কিশোর ফুটবলাররা যেই গুহায় আটকা পড়ে তার কাছেই অনুশীলন করেন সিনিয়র দলের সদস্যরা। লাহুনা বলেন, ‘যখন আমরা আটকে পড়ার খবর জানতে পারি, সাথে সাথেই ১১ জন সেখানে চলে যাই। পরদিন ভোর চারটা পর্যন্ত আমরা প্রবেশমুখে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।’ সিনিয়র টিমের কোচ পান্নাওয়াত জংকাম তাই আস্থাশীল। বলেন, ‘ও যখন বেরিয়ে আসবে, দেখবেন সবই ঠিক থাকবে। আমরা আগের মতোই তার সঙ্গে থাকব।’

গুহায় আটকে পড়া কিশোরদের বন্ধু অতাপর্ন খামেং। কোচ আকের সঙ্গেও তার সম্পর্ক দারুণ। যখন থেকেই আটকে পড়ার খবর শুনেছেন তখন থেকেই তার শঙ্কা সবাই ফিরবে তো। তবে আকের প্রশংসা করেছেন তিনি। অভিভাবকদের মতো করেই তার উপরই ভরসা ছিল তার। উদ্ধার অভিযান শেষ হওয়ার আগে সে বলেছিল ‘আমি আকেকে ভালোবাসি, তাকেই ভরসা করি। তিনি নিশ্চয়ই সবার খেয়াল রাখছেন। যারা আটকে আছে তারা সবাই নায়ক। তবে সবসময় বড় নায়ক আমাদের কোচ। আমি নিশ্চিত তিনি তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে শিশুদের সহায়তা করে যাচ্ছেন।’ খামেং মনে করে, কোচ এই দোষ হয়তো নিজেই নিতে চাইবেন। ‘তার ব্যপারেই আমি চিন্তিত। আমি খুব শিগগিরই তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আবার ফুটবল খেলতে চাই।’ সংবাদমাধ্যমের কাছে আর্তিময় কণ্ঠে বলে খামেং।

আকে আসলেই নিজের ওপর দোষ নিয়েছেন আগেই। গুহা থেকেই হাতে লেখা এক চিঠিতে কোচ কিশোরদের স্বজনদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, সব ছেলেই ভালো আছে। অনেক মানুষই তাদের খোঁজ-খবর রাখছেন। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, শিশুদের দেখাশোনার জন্য সবকিছু করব। আপনাদের সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ। আমি সব অভিভাবকের কাছে ক্ষমা চাইছি। তবে অভিভাবকদের অনেকেই জানিয়েছেন, তারা কোচকে কোনও দোষ দিচ্ছেন না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ