শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মৃৎশিল্পে দুর্দিন : কুমারদের মানবেতর জীবন যাপন

লালমনিরহাটের মৃৎ শিল্প আজ প্রায় বিলুিপ্তর পথে। মোগলহাটের ৫০টি কুমার পরিবারের এখন দুর্দিন যাচ্ছে। সদর উপজেলার মোগলহাট এর ১শ’ বছরের পুরনো গ্রাম কুমোরপাড়ার কুমোরদের বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ। কুমোররা স্ত্রী-সন্তান এবং পরিবারের অন্যাদের নিয়ে কাজ করেও দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করতে পারছেনা। অর্থাভাবে তাদের শিশুরা পড়াশুনা করতে পারছেনা। বাবার পরিশ্রমের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে মহিলারাও স্বামীর সাথে কাজ করছে। শুধু কাজ আর কাজ। কাজ ছাড়া এখানকার দৃশ্যপট চিন্তা করাই দূরূহ। তাদের সাথে একান্ত কথোপকথনে জানা যায়, তাদের পৈতৃক ব্যবসা দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্লাষ্টিকের তৈরি নানা রকমারী জিনিস মৃৎ শিল্পের জিনিসকে ঢেকে রেখেছে। মানুষ দিন দিন মাটির তৈরি জিনিস ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে। যারা মাটির তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার করছে তারা নিতান্ত গেঁয়ো আর ফুটপাতের মানুষ প্লাষ্টিকের তৈরি দ্রব্যাদি দামে সস্তা এবং তুলনামূলক টিকসই হওয়ার কারণে মানুষ এগুলোর দিকে বেশি ঝুকে পড়েছে। ৫ বছর পূর্বেও এখানকার কুমোররা মাটির জিনিসপত্র তৈরি ও বাজার জাত করে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে সুখে জীবন যাপন করতো। এখন শুধুমাত্র গরুর পানি পানের বোল আর বিভিন্ন মেলা উৎসবে। শিশুদের খেলনা ছাড়া আর কোন জিনিসই চলে না । এতে যে পরিমাণে আয় হয় তাতে সংসার চালানো কষ্টের ব্যাপার। কুমোররা বলেন, তারা একসময় বিভিন্ন খাল-বিল থেকে মাটি সংগ্রহ করে তা দিয়ে তৈজষপত্র বানাত। কিন্তু বর্তমানে সেই সকল খাল বিল থেকে এঁটেল মাটি সংগ্রহ করতে তাদের ভূমির মালিকদের টাকা দিতে হয়। কড়ির কেনা মাটি এনে পেশা চালাতে তারা হিমসিম খাচ্ছে। এক সময় ভূমি মালিকদের সহানুভূতি ছিল কুমোরদের জন্য কিন্তু আজ তারা এঁটেল মাটি কুমোদের নিকট টাকায় বিক্রি করছে। নিজ পেশাকে জীবিত রাখতে কুমোররা বাধ্য হয়ে এঁটেল মাটি কিনে মাটির দ্রব্যাদি বানাচ্ছে। মোগলহাটের কুমোর পাড়ার কুমোররা সাত সকালে উঠে এঁটেল মাটি পায়ে দলিত করে এবং সুর্যোদয়ের সাথে সাথে মাটির জিনিস পত্রের প্রাথমিক স্তর তৈরি করে রোদে শুকায়ে সপ্তাহে ২দিন তাতরা মাটিতে আগুন ধরায়। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থেকে তারা তাদের ইট ভাটিতে আগুন লাগিয়ে সাদা মাটির দ্রব্যাদি আগুনে পুড়ে পরে নানা রঙে আঁকিয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে বাজারজাত করে। কুমোরেরা অভিযোগ করে বলেন যে, তারা কষ্টের মাঝেও দেশের অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। কিন্তু সরকারের কোন সুদৃষ্টি তাদের প্রতি নেই। তার উপর স্থানীয় ছোট খাট এনজিওগুলো তাদেরকে ঋণ দিতে ঋণের বোঝায় ভারি করে তুলছে। ফলে তাদের অনেকেই ঋণের ভার সহ্য করতে না পেরে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রি করে ঋনের টাকা পরিশোধ করে পথে বসেছে। শ্রীনকী বালা, প্রমীলা বালা, অমূল্য চন্দ্র ও নগেন্দ্র চন্দ্র রায়সহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, এখানকার কুমোরদের প্রত্যেক সংসারে ২টি ১টি করে কন্যা সন্তান রয়েছে। তারা বয়সে বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের ভাগ্যে বিয়ের আসরে বসার সপ্ন জুটছে না। কারন যৌতুকের অভাবে তাদের বিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে তারা জানান, এখনকার ৫০টি পরিবারে প্রায় ৩০টি পরিবারেই তাদের যুবতী কন্যাদের নিয়ে প্রতিদিন চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছে। এখানকার কুমোর পাড়াটি সীমান্ত এলাকায়। মাত্র ২০ গজ ব্যবধানে ভারত। চারদিকে খোলামেলা পরিবেশ। তবুও এখানকার কুমোররা চোরাকারবারীর মত লাভজনক কাজে জড়াচ্ছে না। তারা প্রত্যেককে কুঁড়ে ঘরে দিনাতিপাত করছে। বৃষ্টিবাদলের দিনে তাদের দুঃখের সীমা থাকে না। কুঁড়ে ঘরের উপর দিয়ে বৃষ্টির পানি তাদের ঘরে চাল চুয়ে মেঝেতে পরে এতে তারা বাধ্য হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে জড়সড় হয়ে জেগে রাত কাটায়। সরকারিভাবে এসব কুমোরদের সুদমুক্ত ঋণ অথবা যথোপযুক্ত সাহায্য দেয়া হলে মোগলহাটের কুমোররা পৈতৃক পেশায় মনোনিবেশ করে দেশের মৃৎ শিল্পের ঐতিহ্যকে গতিশীল রাখতে সচেষ্ট থাকবে এবং নিজেদের উন্নয়নে সফলকামী হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ